- চতুরঙ্গ
- নারীর আবিস্কার, পুরুষের নোবেল?
নারীর আবিস্কার, পুরুষের নোবেল?

কিছুদিন আগেই ঘোষিত হয়েছে নোবেল পুরস্কার ২০২০। এ বছর সর্বমোট ১১ ব্যক্তি ও ১টি প্রতিষ্ঠানকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও সাহিত্য- এই তিন বিষয়ে মোট ৪ জন নারী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সম্প্রতি নোবেলে নারীর উপস্থিতি বাড়লেও ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রচলনের পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৯৩৪ জন নোবেল বিজয়ীর মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ বা ১২০ বছরে ৫৭ জন। অর্থাৎ বলা চলে প্রতি ২ বছরে একজনের চেয়েও কম। এর মধ্যে ম্যারি কুরির দু'বার নোবেল প্রাপ্তি হিসাব করলে সংখ্যাটি ৫৮তে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে কিছু বিষয়ে পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনও বেশ পিছিয়ে আছেন নারীরা। যেমন ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল চালু হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র দু'জন নারী এ বিষয়ে নোবেল পেয়েছেন। তেমনিভাবে পদার্থবিজ্ঞানে এ পর্যন্ত মাত্র ৪ জন ও রসায়নে ৭ জন নারী নোবেল পেয়েছেন। রসায়নে এ বছরই প্রথমবারের মতো যৌথভাবে পুরস্কার জিতেছেন দুই নারী বিজ্ঞানী। এর আগে এককভাবে বা পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পেলেও দুই নারী বিজ্ঞানীর যৌথভাবে নোবেল জয় এবারই প্রথম।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে যেসব আবিস্কারের জন্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে সেগুলো অন্তত ২০ থেকে ৩০ বছর আগে করা হয়েছে। কারণ নোবেল দেওয়ার আগে দীর্ঘ সময় ধরে একটি আবিস্কারকে যাচাই-বাছাই করা হয় এবং এখন থেকে ২০-৩০ বছর আগে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেও এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। ১৯৮১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই ২০ বছরে নোবেল জিতেছেন মাত্র ১১ জন নারী। ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যাটি দ্বিগুণেরও বেশিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এই ২০ বছরে বিভিন্ন বিষয়ে অবদানের জন্য নোবেল জিতেছেন ২৮ জন নারী।
তবে শুধু গবেষণায় পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ কম বলেই কম সংখ্যক নারী বিজ্ঞানী নোবেল জিতেছেন এমনটাও কিন্তু সব ক্ষেত্রে সত্য নয়। অনেক সময় একটি আবিস্কারে নারী ও পুরুষ বিজ্ঞানী সমানভাবে অবদান রাখলেও পুরুষ বিজ্ঞানীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মাতিলদা প্রভাবে খুব পরিস্কারভাবে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মাতিলদা প্রভাব অর্থ হলো- যেসব নারী বিজ্ঞানীর কাজ তাদের নামে স্বীকৃতি না পেয়ে তাদের পুরুষ সহকর্মীদের নামে স্বীকৃতি পেয়েছে সে বিষয়ে কথা বলা। ১৮৮৩ সালে আমেরিকান একজন নাগরিক অধিকারকর্মী মাতিলদা জসলিন গেজ তার 'ওমেন অ্যাজ ইনভেন্টর' প্রবন্ধে সর্বপ্রথম এ প্রভাবটি ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তী ময়ে ১৯৯৩ সালে মার্গারেট ডব্লিউ রোসিটার এটির নামকরণ করেন মাতিলদা এফেক্ট।
রোসিটার এখানে বেশ কয়েকজন নারী বিজ্ঞানীর উদাহরণ দিয়ে দেখান কীভাবে এসব নারী বিজ্ঞানীর কাজ তাদের নামে স্বীকৃতি না পেয়ে তাদের সহকর্মী পুরুষ বিজ্ঞানীদের নামে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথমেই তিনি উলেল্গখ করেন, দ্বাদশ শতাব্দীর একজন ইতালিয়ান নারী চিকিৎসকের কথা। ট্রোটুলা নামের এই চিকিৎসকের লেখা বইগুলো তার মৃত্যুর পর পুরুষ লেখকদের নামে পরিচিতি পায়। যার ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়। এমনকি বৈজ্ঞানিকদের জীবনী নিয়ে যে অভিধানটি রয়েছে সেখানেও তার নাম নেই।
তার এ তালিকায় এমন কিছু নারী বিজ্ঞানীও রয়েছেন যাদের আবিস্কারের জন্য তাদের পুরুষ সহকর্মী নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। যেমন, ১৯৩৪ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে যৌথভাবে নোবেল পেয়েছেন জর্জ হুইপেল, জর্জ রিচার্ড মিনট ও উইলিয়াম পি মারফি কিন্তু তাদের নারী সহকর্মী ফ্রিদা রবসচিত রবিনসকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে জর্জ হুইপেল তার পুরস্কারের অর্থ ফ্রিদার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন, কারণ হুইপেলের প্রায় সব প্রবন্ধেই ফ্রিদা কো-অথর ছিলেন। তেমনিভাবে ১৯৪৪ সালে রসায়নে, ১৯৫০ ও ১৯৫৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে, ১৯৫৮ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে ও ১৯৭৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রেও আবিস্কারগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকা নারী সহকর্মীদের বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিককালে যদিও অনেক দেশ নারী-পুরুষের সমতায় অনেকখানি এগিয়ে গেছে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য এখনও বিদ্যমান। ২০১২ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পুরস্কার ও স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকান নারীরা এখন পর্যন্ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পুরস্কারের পাশাপাশি প্রচারণা ও পরিচিতির ক্ষেত্রেও পুরুষ বিজ্ঞানীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলে দাবি করেন কতিপয় সুইস গবেষক। ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে একজন সুইস গবেষক উল্লেখ করেন, সম্প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত অনুষ্ঠানগুলোতে নারী বিজ্ঞানীদের তুলনায় তাদের সহকর্মী পুরুষ বিজ্ঞানীদের বেশি ডাকা হয়।
আবার শুধু যে নারী বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেই এরকম হচ্ছে এমনটাও নয়। মাতিলদা প্রভাবের মতোই ম্যাথিউ প্রভাবে দেখানো হয়েছে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনেক ক্ষেত্রেই সুপরিচিত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করা তুলনামূলক কম পরিচিত বিজ্ঞানীরা সমপরিমাণ অবদান রাখা সত্ত্বেও কম স্বীকৃতি পাচ্ছেন। ম্যাথিউ প্রভাবটি ব্যাখ্যা করেন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে মার্টন। তিনি বেশ কয়েকটি উদাহরণ টেনে দেখান যে, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারগুলোর ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী বা অনেক ক্ষেত্রে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। কিন্তু পুরস্কার দেওয়ার সময় ওই গ্রুপের সর্বোচ্চ খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা তাদের খ্যাতির জন্য বারবারই স্বীকৃতি পাচ্ছেন। এমনকি মার্টনের স্ত্রী হ্যারিয়েট জাকারম্যানও মাতিলদা প্রভাবের ফলে ম্যাথিউ প্রভাবের কো-অথর হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে মার্টন তুলনামূলক বেশি পরিচিত হওয়ায় ম্যাথিউ প্রভাবটি তার নামেই স্বীকৃতি পায়।
এভাবেই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিস্কারে নারী বিজ্ঞানীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও, সবসময় তারা পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের প্রথম প্রকাশ্য তৃতীয় লিঙ্গের নিউরোবাইয়োলজিস্ট বেন ব্যারেস তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। ব্যারেস তার জন্মের পর থেকে ৪৩ বছর পর্যন্ত নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং পরে লিঙ্গ পরিবর্তন করে পুরুষে পরিণত হন। তিনি জানান, নারী থাকা অবস্থায় তার লিঙ্গীয় পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে তার বৈজ্ঞানিক অবদানগুলোকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হতো। তাই গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার পাশাপাশি প্রয়োজন নারীর কাজের যথাযথ স্বীকৃতি ও সঠিক মূল্যায়ন, যেটি নারীকে বিজ্ঞানে অবদান রাখতে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলবে, হোক না সেটি বন্ধুর পথ।
মন্তব্য করুন