আ মার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ লালবাগ এলাকার সরু গলিপথের মাঝামাঝি ইট, চুন-সুরকির একতলা হাবেলি বাড়িতে। সেই সরু গলিটা শেষে গিয়ে মিশেছে বুড়িগঙ্গার তীরে। পুরান ঢাকার পূর্ব প্রান্তের জুরাইন হতে পশ্চিমের কাটাসুর পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে উত্তরের এই অঞ্চলটি ছিল শহরের একমাত্র জনপদ। কালের বিবর্তনে তা আজ পুরান ঢাকা নামে খ্যাত। ঢাকা বিস্তৃত হয়েছে উত্তর দিকসহ প্রায় সবদিকেই। নতুন ঢাকা সেজেছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। পুরান ঢাকা জীর্ণশীর্ণ অবহেলিত তাচ্ছিল্যের মূর্ত প্রতীক। অথচ ঢাকা শহর গড়ে ওঠে আজকের পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করেই। নগরায়ণের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় ছিল নদী ও নদীপথের অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন গড়ে ওঠেনি। নদীপথের যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত্তিতেই ঢাকা শহর গড়ে উঠেছিল বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীর ঘেঁষে।

বুড়িগঙ্গার বুকে কামরাঙ্গীর চর ছিল এক বিস্ময়ের দ্বীপ। যার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। সেই বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে বড় বড় লঞ্চ-স্টিমারসহ সব নৌযান চলাচল করত এবং আজও করে। কামরাঙ্গীর চরের উত্তরের বহমান নদীটি বুড়িগঙ্গার শাখা নদী; বর্ষা মৌসুমে এই শাখা নদীর আকৃতি ও আয়তন বড় নদীর সমান হয়ে যেত। কামরাঙ্গীর চর থেকে উত্তরের পুরান ঢাকার তীর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার প্রস্থ শাখা নদীটি এখন কয়েক গজের মরা খালবিশেষ।

কামরাঙ্গীর চরের মানুষের জীবনযাপন-ভাষা ছিল গ্রামীণ। গাছগাছালি সমৃদ্ধ গ্রামীণ এই জনপদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যেতাম। যেতাম এয়ারগান দিয়ে বালি হাঁস-ঘুঘু শিকার করতেও। কামরাঙ্গীর চরের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অতীত এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। নেই গাছপালাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সেই জনপদটি। আমাদের গরুর দুধের চাহিদা পূরণ করত কামরাঙ্গীর চরের গ্রামীণ মানুষ। যাদের অনেকের জীবিকা ছিল গরু পুষে দুধ বিক্রি করা। স্থানীয় বাজারগুলোতে কামরাঙ্গীর চর ও কলাতিয়ার চাষিরা তাদের উৎপন্ন টাটকা সবজি-তরকারি প্রতিদিন সকালে বিক্রি করতে আসত। শ্যামবাজার আড়ত থেকে কেনা সবজি তরকারির চেয়ে টাটকা হওয়ায় কলাতিয়ার সবজি তরকারির চাহিদা ছিল বেশি। উল্লেখ্য, বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটির খেয়া পারাপারের পেশায়ও যুক্ত ছিল কামরাঙ্গীর চরের অনেক মানুষ।

দক্ষিণের তীর ঘেঁষে বর্তমানের বেড়িবাঁধের উত্তরে ছিল বিশাল জেলেপল্লি। সারা রাত জেলেরা বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে জাল টেনে সকালে বাজারে তাজা-টাটকা মাছ বিক্রি করত। শীর্ণ বুড়িগঙ্গার পানি বর্জ্যের দূষণে মাছহীন হয়ে পড়েছে। জেলেরা তাদের পেশায় থাকতে পারেনি। জেলেপল্লিও নেই। শাখা বুড়িগঙ্গা নদীর কয়েক গজের সরু খালটি টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। তাও থাকত না, যদি না পয়োময়লা নিষ্কাশনের একমাত্র ব্যবস্থাটা না থাকত। এমনকি বৃষ্টির পানিরও। ভারী বৃষ্টিতেও পুরান ঢাকার এই অঞ্চলটিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না। অথচ নানা আবর্জনায় বেড়িবাঁধের স্লুইসগেটের পথ বন্ধ হয়ে সেখানে পচা-দুর্গন্ধময় জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সেই জলাশয়ের পানিতে উৎপন্ন হচ্ছে মশা। মশার তাণ্ডবে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা।
লালবাগের শহীদনগর-ইসলামবাগ নামক ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাও বুড়িগঙ্গার শাখা নদীকে ভরাট করেই গড়ে উঠেছে। শীত মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়া তীরের বেলে মাঠে আমরা খেলাধুলা করেছি। লালবাগ শ্মশান ঘাটের দক্ষিণের খালি জায়গাজুড়ে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা বসত। স্থানীয়দের ভাষায় ‘চৈত পূজার মেলা’। সেই মেলা আমাদের জন্য ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সন্ধ্যায় মেলা থেকে বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরতাম। চৈত্রসংক্রান্তির শেষ বিকেলে বৃষ্টি ছিল অনিবার্য, আজকে যা দেখা যায় না। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের নিষ্ঠুর আচরণের কারণে প্রকৃতিও বদলা নিচ্ছে নানাভাবে। এখন শহরজুড়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয় ঘটা করে। নিরানন্দ নাগরিক জীবনে ক্ষণিকের আনন্দের স্রোত বয়ে যায় সত্য, তবে তা কেবলই ভোগের পর্যায়ে। সেখানে জাতীয়তার চেতনার গভীরতার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন। পহেলা বৈশাখে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ব্যবসাকেন্দ্রে দল বেঁধে ক্রেতার ছদ্মবেশে মিষ্টি খেতে যেতাম। যেতাম কারও কারও বাড়িতেও। স্থানীয় মুসলমানদের অবশ্য পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে তেমন দেখিনি।

প্রতি বর্ষা মৌসুমে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে নৌকাবাইচ ও সাঁতার প্রতিযোগিতা হতো, এখনকার কয়েক গজের পয়োময়লা নিষ্কাশনের সরু খালটিতে। তখন আয়তনে সেটা ছিল দুই কিলোমিটার প্রস্থ। দূরদূরান্তের আত্মীয়-পরিজন নৌকাবাইচ দেখতে আসত। স্থানীয় সবার বাড়ি হতো উৎসবমুখর আতিথেয়তায়। বাড়িতে বাড়িতে চীনা বাদাম, বুট-ভুট্টার খই ভাজা হতো নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে। সব বয়সী বাদাম, খই খেতে খেতে নদীর তীরের ঘাটে এবং নারীরা তীরের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নৌকাবাইচ ও সাঁতার প্রতিযোগিতা উপভোগ করত। সবই এখন স্মৃতি। বর্ষাকালে স্থানীয় যুবকরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বজরায় পিকনিক করতে যেত মিরপুরের বেগুনবাড়িতে। নদীপথে তাদের বজরা-ভ্রমণ ছিল প্রতি বর্ষায় নিয়মিত। শনিবার বিকেলে রওনা হয়ে পরদিন বিকেলে ফিরে আসত সবাই। রঙিন কাগজ দিয়ে বজরা সাজিয়ে মাইক বাজিয়ে নদীর বুক চিরে তাদের সেই নৌভ্রমণ এখন স্মৃতিমাত্র।

অপরিকল্পিত নগরায়ণে আজ আমাদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় পুরান ঢাকা ক্রমেই হারিয়েছে তার পরিধি-আলো-বাতাস-নদীর বহমানতাসহ সমস্ত নাগরিক সুবিধা।  আমাদের গলিগুলোতে এবং মূল সড়কে ছিল কারুকাজ করা লোহার ল্যাম্পপোস্ট। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পৌরসভার লোক কাঁধে মই ঝুলিয়ে হাতে কেরোসিন তেলের টিনের বাতি নিয়ে এসে লোহার ল্যাম্পপোস্টে মই দিয়ে উঠে কাচের লম্বাটে চৌকোনা বাক্সের দরজার এক পাশ খুলে ভেতরের কুপিতে তেল ঢালত, সলতে পরিষ্কার করে দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দিত কুপি। আবার সকালে এসে ওরাই কুপি নিভিয়ে দিয়ে যেত। চৌকোনা লম্বাটে সেই কাচের বাক্সের একদিকের দরজা খোলা যেত। ওপরের অংশে বাতাস যাওয়া-আসার ব্যবস্থাও ছিল। ওই বাক্সটিই আজকের ঢাকা সিটি করপোরেশনের মনোগ্রাম। অনেক পরে গলির মোড়ে মোড়ে গজারি গাছের ল্যাম্পপোস্ট বসল। তাতে বিদ্যুতের বাতি জ্বলল। ক্রমে আমরাও বাড়ির হারিকেন পাল্টে বিদ্যুতের আলোতে অভ্যস্ত হলাম। একে একে পাল্টে গেল সবই। কিন্তু পুরান ঢাকা এগোয়নি। ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে আধুনিক নাগরিক সুবিধা থেকে। আধুনিক ঢাকার নাগরিকদের কাছে পুরান ঢাকা কিম্ভূতকিমাকার এক জনপদ বই ভিন্ন কিছু নয়।

মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক
নতুন দিগন্ত