-samakal-64162038177ab.jpg)
গাজীপুরের শ্রীপুরের ওয়াদ্দার দিঘি - সমকাল
দিঘির স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। কূলে সিঁড়ির ধাপে বসে কাপড় ও বাসন ধুয়ে নিচ্ছেন কয়েকজন নারী। তিন দিকে ভূমিহীন মানুষের বসতি। পূর্বদিকে বিস্তর সবুজ মাঠ। উত্তর-পশ্চিম কোণে মসজিদ-মাদ্রাসা। আসরের নামাজ পড়ার জন্য দিঘির পানিতে অজু সেরে নিলেন শিক্ষার্থী ও মুসল্লিরা। তাঁরা বললেন, শিশুপালের দিঘি নামে বিশাল এ জলাশয় কখনও শুকায় না। শোনা যায়, এর বয়স প্রায় ১ হাজার ২০০ বছর।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা সদরের তিন কিলোমিটার উত্তর দিকে ৩২ বিঘা জমির ওপর খনন করা এই দিঘি ‘ওয়াদ্দার দিঘি’ নামেও পরিচিত। কবে, কীভাবে এটি খনন করা হয়েছে– সেই ইতিহাস সাধারণ মানুষ জানেন না। গাজীপুরবিষয়ক গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড. ফরিদ আহম্মেদ বলেন, দিঘিটির বয়স ১ হাজার ২০০ বছরের বেশি। মধ্যযুগ শুরুর পর আসাম থেকে শিশুপাল নামে এক রাজা এসেছিলেন ভাওয়াল অঞ্চলে। অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে এসেই সামন্ত রাজাদের কাছ থেকে পুরো অঞ্চলের কর্তৃত্ব কেড়ে নেন তিনি। শাসন করতে থাকেন বিশাল এ অঞ্চল। তখন এলাকাটি ‘চেদি রাজ্য’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল কাপাসিয়ার কলমেশ্বর। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় এলাকাটি শাসন করেন শিশুপাল। শ্রীপুর উপজেলার শৈলাট এলাকায় তিনি একটি বিশাল উদ্যান নগরী গড়ে তোলেন। নগর রক্ষার জন্য চারদিকে পরিখা খনন করা হয়। এই পরিখাকে তখন ‘গড়খাই’ বলা হতো।
ফরিদ আহম্মেদের মতে, শিশুপালের শাসনামলে কলমেশ্বর থেকে শৈলাট যাওয়ার জন্য গোসিঙ্গা হয়ে একটি রাস্তা তৈরি করা হয়। রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর পানির চাহিদা মেটাতে এ রাস্তার পাশে ৩২ বিঘা জমির ওপর দিঘিটি খনন করেন তিনি। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ পর্যালোচনা ও গবেষণার পর ধারণা করা হয়, দিঘিটি অষ্টম শতকের পরপরই খনন করা হয়েছিল। শিশুপালের প্রস্থানের পর তাঁর সর্বশেষ উত্তরাধিকার রানী ভবানী পাল অঞ্চলটি শাসন করেন। তাঁর শাসনকাল ছিল খুব কম। এরই মধ্যে সেন রাজারা চলে আসেন। তাঁদের অত্যাচারে পাল বংশের লোকজন পালাতে শুরু করেন। তবে কোনো কোনো এলাকায় দু-একজন থেকে যান। ভবানী পাল কোথায় গিয়েছিলেন জানা যায়নি।
ফরিদ আহম্মেদ জানান, ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলে ফকির-দরবেশদের শাসনকাল। ফকির ও দরবেশরা ইসলাম প্রচারে এসে শিশুপালের দিঘি ব্যবহার করেছেন। এরপরই দিল্লি থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন পাহলোয়ান শাহ গাজী। তিনি দিল্লির বাদশাহর জায়গিরদার হন। শুরু হয় ইসলামী শাসনামল। পাহলোয়ান শাহ শুধু শাসনই নয়, আনুষ্ঠানিকভাবে অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণও করতে থাকেন। তাঁর অনুসারী ও ধর্ম প্রচারকরা শিশুপালের দিঘি ব্যবহার করেছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে দিঘিটির পত্তন দেওয়া (নির্দিষ্ট মেয়াদ ও খাজনার শর্তে গৃহীত ভূমিস্বত্ব) হয়। ব্রিটিশ শাসকের কাছ থেকে দিঘির পত্তন নেন এক মুসলমান। তখনই শিশুপালের নাম ধূসর হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে পত্তন নেওয়া মুসলমান ব্যক্তির নামানুসারে এর নামকরণ হয় ‘ওয়াদ্দার দিঘি’।
শ্রীপুর পৌর মেয়র আনিছুর রহমান বলেন, শ্রীপুরের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত হয় এই দিঘির পাড়ে। ঈদের নামাজ পড়েন লাখো মানুষ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, দিঘির পাড়ে অন্তত ৫০টি ভূমিহীন পরিবারের বসবাস। এটি যাতে দূষিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখেন তাঁরা। তাঁদের সতর্কতার কারণে টলমল করে দিঘির পানি। সরকারিভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করা হলে দিঘিটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে।
মন্তব্য করুন