- সারাদেশ
- স্বপ্ন পূরণের দিন, গর্বের দিন
স্বপ্ন পূরণের দিন, গর্বের দিন

আজ স্বপ্ন পূরণের দিন, শত বাধা পেরিয়ে প্রমত্ত পদ্মায় সেতু নির্মাণের গর্বের দিন। পদ্মা সেতু নির্মিত হবেই- কয়েক বছর আগেও কথাটি রাজনৈতিক বক্তব্য গণ্য হতো। ভোটারের মন ভোলানো নেতার বোনা অলীক স্বপ্ন মনে হতো; কিন্তু আজ তা গৌরবময় এক বাস্তবতা। আজ শনিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রত্যাশার পদ্মা সেতুতে যান চলাচল উদ্বোধন করবেন।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। বাংলাদেশের কারিগরি সামর্থ্যের প্রতীক। এতদিন ধনী দেশগুলো বিশাল বিশাল সেতু, টানেল, বাঁধের মতো অবকাঠামো নির্মাণ করে বিশ্বকে চমক দিয়েছে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও সামর্থ্যের জানান দিয়েছে। পদ্মা সেতু সারা দুনিয়ায় বার্তা দিয়েছে, বাংলাদেশও পারে।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তানসহ বহু দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন পদ্মা সেতুর মতো বিশাল স্থাপনা সফলভাবে নির্মাণ করতে পারায়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার সাহসের প্রতীক। পদ্মা সেতু তাঁর সাহসেই নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। বাকি সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ তদারকি করেছে মাত্র।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে সারাদেশ উৎসবে মেতেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে সেতু এলাকা পর্যন্ত সড়ক সেজেছে। উদ্বোধন স্মরণীয় করে রাখতে নবনির্মিত পদ্মা সেতু সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। তবে ভয়াল বন্যার কারণে সব এলাকায় উৎসব হচ্ছে না। তার পরও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখো মানুষ এরই মধ্যে হাজির হয়েছেন পদ্মা সেতু এলাকায়, উদ্বোধন উৎসবে শামিল হতে।
গত দুই যুগে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ায়, পদ্মা সেতু নির্মাণ আর সম্ভব নয় বলে ধরে নিয়েছিলেন অনেকে। এর আগে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা বা সক্ষমতা ছিল না বাংলাদেশের। সেখানে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের পদ্মা সেতু কীভাবে বিদেশি ঋণ ছাড়া নির্মাণ সম্ভব! দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞরা সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন। আশঙ্কা ছিল ঋণ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়তে পারে। তেমনটা হলে আজ শ্রীলঙ্কার যে দশা হয়েছে, বাংলাদেশেরও একই পরিণতি হতে পারত।
তবে এসব আশঙ্কা ও হিসাব উল্টে দিয়ে বাংলাদেশ সেতু নির্মাণ করে দেখিয়েছে। সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে প্রায় আট বছর পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকিতে ছিলেন আজকের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি একবার সমকালকে বলেছেন, বিদেশি ঋণদাতারা সরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ যেভাবে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে, তাতে অনেকেই মনে করতে পারে জেদ করে কাজটি করা হয়েছে। আসলে তা নয়। লাভ-লোকসানের চুলচেরা হিসাব করেই নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুতে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তাতে কোনো ঝুঁকি নেই। এই বিনিয়োগ লাভসহ উঠে আসবে।
২০০৫ সালে প্রকাশিত পদ্মা সেতুর সম্ভাবত্য যাচাই সমীক্ষাও একই কথা বলছে। ২ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ পদ্মা সেতুর সুফলভোগী হবেন। তবে বাস্তবতা বলছে, দক্ষিণবঙ্গের প্রায় চার কোটি মানুষের জীবনকে সহজ করবে পদ্মা সেতু। ইতিহাসের প্রথমবার দেশের রাজধানীর সঙ্গে সরল পথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে খুলবে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার। দক্ষিণবঙ্গে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পর্যটন সর্বক্ষেত্রের উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে পদ্মা সেতু।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে ২১ জেলার মানুষের যে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, তার মূল্য অর্থনৈতিক হিসাবের চেয়ে ঢের বেশি। পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেছেন, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শুধু সময় সাশ্রয় ও স্বাচ্ছন্দ্য আসবে না, আর্থিক সচ্ছলতাও আসবে।
অবশ্য চালুর পর পদ্মা সেতু প্রকল্প লাগোয়া এলাকার মানুষের জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। দুই পাড়ে জমির দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। আবাসন ও শিল্প-কারখানার জন্য জমি কিনতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে আরও কয়েক বছর আগেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, নকশার ২৫০ কোটি টাকা ঋণ এবং সমীক্ষার ৩০০ কোটি টাকা অনুদান প্রকল্পের ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি সরকারি রাজস্বের টাকা। প্রকল্পের হিসাব টাকায় করা হলেও আমদানি ও ঠিকাদারের বিল ডলারে মেটাতে হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। ২০১৮ সালে সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও, চার বছর তাতে বিলম্ব হওয়ায় টাকা জোগানের চাপ কিছুটা কম পড়েছে।
১৯৯৮ সালে পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা হলেও দুই বছরের প্রাক-সমীক্ষা শেষে ২০০১ সালের ৪ জুলাই এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু। এই সেতুর গভীরতম পাইল ১২৫ দশমিক ৪৫ মিটার, যা এক বিশ্বরেকর্ড। কোনো সেতুর জন্য এত গভীর পাইলিং করতে হয়নি। সেতুর জন্য নদীর বুকে ২৬২টি পাইলিং করতে হয়েছে, যা ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। নদীর ১৩০ মিটার গভীরেও পাথরের স্তর না পাওয়ায়, প্রকল্পের মাঝপথে নকশা বদল করতে হয়েছে। ২২টি পিলারে একটি করে বাড়তি পাইল করতে হয়েছে। এই কঠিন পথ বাংলাদেশ পাড়ি দিয়েছে। বিদেশি পরামর্শকদের সহযোগিতা থাকলেও মূল কাজটি বাংলাদেশের প্রকৌশলীরাই করেছেন।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান স্থাপন করা হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর শেষ স্প্যান বসে। যুক্ত হয় পদ্মা নদীর দুই পাড়। দেড় বছর পর আগামীকাল রোববার সকাল থেকে সেতুতে চলবে গাড়ি। সুখে-দুঃখে স্বজনের কাছে নির্বিঘ্নে যেতে পারবেন দক্ষিণের মানুষ। ফেরিতে বিলম্বের কারণে চাকরির পরীক্ষায় বসতে না পারার হতাশা আর কোনো যুবককে পোড়াবে না।
প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে, ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেতুর পাইলিংয়ের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগের দিন শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের চর চান্দ্রা গ্রামের ফারহানা বেগম মিলি দুঃখভরে বলছিলেন, পুরো ১০ ঘণ্টা লেগেছিল তাঁর হাসপাতালে পৌঁছাতে। তাঁর বিশ্বাস, ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলে গর্ভের সন্তানটিকে জীবিত ভূমিষ্ঠ করতে পারতেন। মিলিদের সেই দুঃখ দূর হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে। গর্বের পদ্মা সেতুতে।
মন্তব্য করুন