- বিজয় দিবস
- স্বীকৃতি পাচ্ছেন 'যুদ্ধশিশুরা'
স্বীকৃতি পাচ্ছেন 'যুদ্ধশিশুরা'

১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি। সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরে বীরাঙ্গনা মা জয়গুন নেছা খানমের কোলজুড়ে আসে নিমসানা আক্তার খানম। সামাজিকভাবে জয়গুন হেয় প্রতিপন্ন হলেও সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু বিপত্তি বাধে 'বাবা'র নাম না থাকায়। পরে প্রতিবেশী ও শিক্ষকদের পরামর্শে জয়গুনের ওপর নির্যাতনকারী চারজনের মধ্যে একজনের নাম দেওয়া হয়। সুবেদার লাল খান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্য মেজর আজিজ খান, ক্যাপ্টেন দাউদ খান ও ক্যাপ্টেন রফিকও নির্যাতন করে তাঁকে। কিন্তু লাল খান ভয়াবহ নির্যাতন করায় 'বাবা'র নামের জায়গায় তার নামই দেন বীরাঙ্গনা জয়গুন। কিন্তু ষাটোর্ধ্ব এই নারী এখনও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। অথচ জীবনের প্রতি পরতে পরতে বয়ে বেড়াচ্ছেন 'বীরাঙ্গনা'র গ্লানি। শুধু নিজেই নন, ধর্ষণের শিকার হয়ে জন্ম দেওয়া সন্তানকেও ভুগতে হচ্ছে। অথচ মা-মেয়ে কেউ-ই পাননি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অনাদরে, অবহেলায় জীবন কাটছে তাঁদের।
যুদ্ধশিশু নিমসানা, সুধীর দাস, মেরিনা খাতুনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নানাভাবে বঞ্চনার শিকার এসব যুদ্ধশিশু চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হলেও শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী 'রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি' দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। সরকারও তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে হাঁটছে। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) সূত্রে জানা গেছে।
ইতালীয় চিকিৎসক দলের এক সমীক্ষায় যুদ্ধশিশু জন্মদানকারী নারীর সংখ্যা ৪০ হাজার বলা হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের (আইপিপিএফ) হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা দুই লাখ। একটি সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা তিন লাখ বলে উল্লেখ করা হয়। তবে এ সংখ্যা নির্ধারণে অনুসৃত পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বলা যায় না। ফলে যুদ্ধশিশুর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা এখনও হিসাবের বাইরে। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষী এই যুদ্ধশিশুরা। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের যৌন নির্যাতনে তাঁদের জন্ম। নির্যাতন ও তৎকালীন সমাজের বিরূপ দৃষ্টির সামনে ধর্ষণের শিকার সেসব নারী ছিলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ফলে সন্তান লালন-পালনের মতো অবস্থায় ছিলেন না তাঁরা। প্রতিবেশী ও লোকচক্ষুর আড়াল করতে অনেক নারীই সে সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। যদিও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নথিপত্রে নেই। আবার অনেকে স্বেচ্ছায় জন্মদানের পর সন্তানকে শিশু ভবনে রেখে যান। স্বাধীন হওয়ার পর সেসব শিশুকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার অনেকে জন্ম-পরিচয় গোপন রেখেই বাংলাদেশের মাটিতে বেড়ে উঠেছেন।
একাত্তর-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে যত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেগুলোর মধ্যে দুস্থ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ডের সভাপতি বিচারপতি কে এম সোবহান, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার মার্গারেট মেরি এবং আইপিপিএফের ড. জিওফ্রে ডেভিস, ওডার্ট ফন শুল্জ প্রমুখের সাক্ষাৎকারও ছিল। তাঁদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, স্থানীয় বাঙালি চিকিৎসকদের সহায়তায় ব্রিটিশ, মার্কিন ও অস্ট্রেলীয় চিকিৎসকদের একটি দল ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ২৩ হাজার বীরাঙ্গনার গর্ভপাত ঘটায়। ১৯৭২ সালের শুরুতে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। এর পর বিদেশ থেকে চিকিৎসক দল বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন। তাঁরা ঢাকায় গর্ভপাত করানো বা সন্তান জন্মদানের জন্য 'সেবা সদন' নামে পরিচিত বেশ কয়েকটি চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
তবে দেশে এসব শিশুর অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল পুরান ঢাকার ইসলামপুর রোডে গড়ে ওঠা মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটি বা শিশু ভবন। এখান থেকেই ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই কানাডার সমাজকর্মী বনি কাপুচিনোর সংগঠন 'ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন' ১৫ যুদ্ধশিশুকে কানাডায় নিয়ে যায়। এ পথ ধরেই যুদ্ধশিশুদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে যুদ্ধশিশু প্রশ্নটির অবসান ঘটে। তত দিনে দত্তক হিসেবে বিদেশের মাটিতে যাঁরা যাওয়ার, তাঁদের অভিবাসন সম্পন্ন হয়। আর যাঁরা দেশে রয়ে যান, তাঁরা স্বজনের কাছে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু তাঁদের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছিল না। বাবার নাম উল্লেখ করতে না পারায় তাঁরা কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাননি। চলতি বছর এক আবেদনের পর সরকার তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন দেশে বসবাসকারী যুদ্ধশিশুরা।
বিদেশের ভূমিতে বেড়ে ওঠা যুদ্ধশিশুরা: যুদ্ধশিশুদের একজন ক্রিস বুনস্ট্রার। কানাডার পূর্বভাগে অবস্থিত কিউবেক প্রদেশে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর শৈশব কেটেছে অন্যান্য যুদ্ধশিশুর মতোই। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কীভাবে তাঁর জন্ম- সেসব বিষয়ে দত্তক নেওয়া মা-বাবাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করতেন। এ কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতেন তাঁরা। পরে সেই নির্মম কঠোর সত্যের ঐতিহাসিক বিবরণ শুনিয়েছিলেন পালিত মা-বাবা। বিদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা রায়ান, ল্যারা, রাজিব, আমিনা এবং রানি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁদের জন্ম, অতীত সম্পর্কে যা কিছু শুনেছেন; সেসবের সত্যতা যাচাই করতেই দেশে আসা। লেখক মুস্তাফা চৌধুরীর '৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস', 'যুদ্ধশিশুদের প্রথম সফর নিজের জন্মদেশে' উপশিরোনামে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বিশদ বর্ণনা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের যে অনাথ আশ্রম থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছিল, সে আশ্রমটি তাঁদের সচক্ষে দেখার সুযোগ হয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের লোকজনের চেহারার মিল থাকলেও সংস্কৃতির অমিল ছিল ব্যাপক। ওই গ্রন্থে ১৫ জন যুদ্ধশিশুর কথা বলা হয়েছে। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্বর, হিংস্র, নরপিশাচ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
যাচাই-বাছাই চলছে: চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি বেওয়ার সন্তান মোছা. মেরিনা খাতুন যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার আবেদন করেন। এর পরই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্যাতন-নৃশংসতার শিকার নারীদের সন্তানদের 'যুদ্ধশিশু' হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। ইতোমধ্যে যাচাই-বাছাইয়েরও কার্যক্রম চলছে। জামুকার ৮২তম বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পর যুদ্ধশিশুর চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাবার নাম লেখার প্রয়োজন হবে না। বাবার নাম ছাড়াই তাঁরা রাষ্ট্রের সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারবেন। বাবার নামের স্থানে লেখা থাকবে 'প্রযোজ্য নয়'। প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে জানা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া বলেন, 'চলতি বছর একজন বীরাঙ্গনার সন্তান আমাদের কাছে আবেদন করেছিলেন। তাঁর আবেদনের পর জামুকার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।'
স্বীকৃতি মিললেও পাবেন না আর্থিক সুবিধা: দেশে ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৩২ জন সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ২০ হাজার টাকা করে মাসিক সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া সম্মানী ভাতার পাশাপাশি সাধারণ, শহীদ ও যুদ্ধাহত এবং খেতাবপ্রাপ্ত- এই তিন শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসব ভাতা, মহান বিজয় দিবস ভাতা ও বাংলা নববর্ষ ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তবে যাচাই-বাছাই শেষে যেসব যুদ্ধশিশু গেজেটভুক্ত হবেন, তাঁরা কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না বলে জানা গেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, 'যাঁরা যুদ্ধশিশু, তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। পিতার নাম ছাড়াই তাঁরা যেন রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারেন, সে জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়, তা যুদ্ধসন্তানরা পাবেন না।'
'যুদ্ধশিশুরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন'- সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন গবেষক ও লেখক মুস্তাফা চৌধুরী। তিনি বলেন, 'দেরিতে হলেও একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্তটি প্রশংসনীয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে যুদ্ধশিশুরা পিতার পরিচয় ছাড়াই সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন।' লেখক ও গবেষক সালেক খোকন বলেন, 'রাষ্ট্র যখন স্বীকৃতি দেবে, তখন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে। তাঁদের প্রতি মানুষের সম্মান বাড়বে। এটা ইতিবাচক দিক।'
নারীপক্ষের আন্দোলন: ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর বিজয়ের মাসে একেকটি প্রতিপাদ্য নিয়ে 'আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার' আয়োজন করে আসছে নারীপক্ষ। তবে ২০২১ সালে 'একাত্তরের যুদ্ধসন্তানদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি'র দাবিতে কাজ শুরু করে সংস্থাটি। ওই বছর দুই দফা দাবিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নারীপক্ষের সদস্য ও সাবেক সভানেত্রী রেহানা সামদানী কণা। দাবি দুটি হলো- দত্তকসূত্রে বিদেশে অবস্থানরত সব যুদ্ধসন্তানকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নাগরিকত্ব গ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশে বসবাসরত যুদ্ধসন্তানদের পরিচয়কে সম্মানসূচক অবস্থানে স্থাপনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চলতি বছর যুদ্ধশিশুদের স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক।
নারীপক্ষের যুদ্ধসন্তান '৭১ প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নূরে মাকসুরাত সেঁজুতি জানান, নারীপক্ষ ২০১১ সাল থেকে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করছে '৭১ এর যে নারীদের ভুলেছি' কর্মসূচির মাধ্যমে। কাজ করতে গিয়েই যুদ্ধসন্তানদের স্বীকৃতির বিষয়টি উঠে আসে। তার আলোকেই ২০২১ সাল থেকে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করে নারীপক্ষ।
মন্তব্য করুন