
আফসান চৌধুরী
আমি ১৯৭৮ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি। আমার কাছে মনে হয়, ১৯৭৮ সালে যে মুক্ত পরিবেশে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করতে পারত, সেই পরিবেশ এখন আর নেই। এই পরিবেশ না থাকার পেছনে রাজনৈতিক সমস্যা অনেক বেশি জড়িত। আমরা যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করি তখন সময়টা ছিল বিএনপি সরকারের অধীন। দেখা যাচ্ছে বিএনপি সরকারই মনে করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার একটা প্রকল্প থাকা উচিত এবং সেই প্রকল্পে নিবেদিত মানুষ কাজ করেছে। আজকে যদি আওয়ামী লীগ সরকার এ রকম কোনো প্রকল্প করে সেখানে বিএনপির লোকজন কাজ করতে চাইবে না এবং বিএনপির লোকজন যদি নতুন করে এমন কিছু করে সেখানে আওয়ামী লীগের কেউ যাবে না। এই দুটি দল নিজেদের ভেতর বিবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ওপর একরকম চাপ তৈরি করেছে।
যে আরাধ্য পরিবেশ আমাদের রাজনীতিতে নেই, সমাজে নেই, সেই পরিবেশ ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও নেই। এখন আমাদের এখানে যারা ইতিহাস চর্চা বা গবেষণা করছেন, তাঁরা দলীয়ভাবে ইতিহাস দেখছেন। দলীয় ইতিহাস চর্চা করতে গেলে যা হয়, অনেক বাস্তব তথ্য পাশ কাটিয়ে নিজেদের সুবিধামতো তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যে তথ্য শুধু দলীয় ভাবনাচিন্তার সাথে মিলবে। এই প্রবণতায় অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। এতে করে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ধারাটা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ধারা, বিএনপির ধারা। তৃতীয় আরেকটা ধারা আছে, বামদের ধারা। বামরা যেহেতু এখন দুর্বল, তাদের ইতিহাস চর্চাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই মোট ত্রিধারা আসার ফলে যা হয়েছে, রাজনৈতিক দলকে ভিত্তি করে আমরা ইতিহাস চর্চাটা করছি। ১৯৭৮ সালে আমরা যখন ইতিহাস চর্চা শুরু করেছিলাম তখন কিন্তু এই পরিবেশটা ছিল না। এ সংকট গত ১৫-২০ বছরে অনেকটা বেড়েছে।
দলগুলো যখন বলে সঠিক ইতিহাস চাই, তখন সেটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জায়গা থেকে বলে। উদ্দেশ্যটা হলো, এর ফলে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সুযোগ বাড়বে, নিজস্ব রাজনৈতিক যে ভাবনাটা আছে সেটার ভিত দৃঢ় হবে। যারা এই রকম দলীয় গণ্ডির ভেতরে থেকে ভাবে তাদের পক্ষে অন্য জায়গায় যাওয়াও সম্ভব হয় না। আর এটা ইতিহাস চর্চার অন্তরায়। দেশবিরোধী ইতিহাস আর দেশপ্রেমী ইতিহাস- ইতিহাস চর্চাটা এই দুই ভাগেও বিভক্ত হয়ে এখন সবার মনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমরা সবাই মূলত দেশপ্রেমী ইতিহাস চর্চা করতে চাই। তখন যেটা হয়, মানুষ আর তথ্যের দিকে তাকায় না। আসলেই কী ঘটেছিল, তা উদ্ঘাটনের প্রবণতা থাকে না তার ভেতর। এর পরিবর্তে কোন তথ্যে আমার দল, মত, আদর্শের সুবিধা হবে- সেটাই শুধু উদ্ঘাটনের প্রবণতা মনে জাগে। এ পরিবেশ থেকে মুক্তি বোধ হয় আমরা আর পাব না। দুর্ভাগ্যবশত গত চার থেকে পাঁচ বছরে একটা বিষয় লক্ষ্য করছি। এখন সাধারণ মানুষের কাছে গেলে সাধারণ মানুষও তার ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বুঝেশুনে বলে। সে ততটুকুই বলছে যতটুকু বললে তার কোনো অসুবিধা হবে না এবং ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধা পাওয়া যাবে। এটা এত প্রবলভাবে উপস্থিত যে স্বয়ং আমারই অন্তত পাঁচটা অভিজ্ঞতা হয়েছে গত কয়েক বছরে।
তরুণ গবেষক যাঁরা আমার সঙ্গে কাজ করছেন, বয়স বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না, তাঁরা মানুষের কাছ থেকে অদ্ভুত সব তথ্য নিয়ে আসছেন। মানুষ এখন এসব বলছে। নিশ্চিন্তে বলে যাচ্ছে। কারণ, জানে- এতে করে হয় সে নিরাপদে থাকবে, নাহয় কোনো সুবিধা পাবে। এই পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করা আদৌ সম্ভব কিনা, আমি বুঝতে পারছি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা একটা বড় সংকট। এবং এই সংকট থেকে আমরা সামষ্টিকভাবে কোনো উত্তরণও যে চাইছি তা আরও বড় সংকট। আমরা চাই, আমার ইতিহাসটাই শুধু থাকুক। আমরা বলি, চাই সঠিক ইতিহাস। সঠিক ইতিহাস বলে কি কিছু আছে? সঠিক ইতিহাস বলতে আমরা বোঝাতে চাই- যে ইতিহাসটা পাচ্ছি, তা আমার ধারণামতে যা ঠিক, সে ইতিহাসটাই কিনা। এ কথা সব দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তারা দ্বন্দ্ব করবে- কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল, কে কী বলেছিল অথবা কে চলে গেছে। এসবের বাইরে তো বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চা হয় না। এটা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। এ রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকা সহজ নয়। তথ্যদাতা মানুষ ভাবছে এ রাজনীতি থেকে যেখানে মুক্ত থাকার সুযোগ নেই, সেখানে যাবারও দরকার নেই।
একক সঠিক ইতিহাস বলে কিছু নেই। বিষয়টা ব্যাখ্যার দাবিদার। ইতিহাস একটা হয় না। এ কথাটা অনেককে বোঝানো অসম্ভব। আমি দেখেছি যখন কোনো আন্তর্জাতিক সেমিনারে যাই তখন তুলনামূলক সহজ হয় অনেক কিছু বোঝানো।
একটা দেশে তো কেবল একটা জনগোষ্ঠী থাকে না। সেখানে শতেক জনগোষ্ঠী থাকে, হাজার রকম মানুষ থাকে। তাদের থাকে হাজার রকম অভিজ্ঞতা। আমরা যদি বলি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের অভিজ্ঞতা আর নারীর অভিজ্ঞতা একই, তাহলে এর চেয়ে অদ্ভুত আর কোনো কথা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে নারী ও পুরুষের অভিজ্ঞতা ব্যাপকভাবে আলাদা। কোনোটা কারও চেয়ে উঁচু বা নিচু নয়। ভিন্ন। তেমনিভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা আর বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা এক নয়। এটা তো প্রমাণেরও অপেক্ষা রাখে না। তবু লোকে এ নিয়ে বিতর্ক করছে। এর ফলে যেটা হচ্ছে- আমরা একক ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছি। ভারত যেমন অখণ্ড ভারত করতে চেয়েছিল, পাকিস্তান যেমন অখণ্ড পাকিস্তান রাখতে চেয়েছিল, তেমনই আমরা এখন চাইছি অখণ্ড বাঙালির ইতিহাস তৈরি করতে। কিন্তু অখণ্ড বাঙালি বলে কিছু নেই। বাঙালি বিবিধ। বাঙালির ইতিহাসও বিবিধ। কতটা বিবিধ তার প্রমাণ হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে যখন যৌথ-বাংলা আন্দোলন হয়েছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাই বলেছিল- আমরা একসাথে বাংলা করব না। একে যদি ইতিহাসবিদ বা ইতিহাস রচয়িতারা গণ্য করেন তাহলে বুঝতে পারবেন বাঙালির একক ইতিহাস বলে কোনো কিছু নেই। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস বলে একটা কিছু হতে পারে।
ইতিহাসের বহুবিধতা আমাদের মাঝে চর্চিত হয় না। আমরা ডাইভার্সিটির চর্চা করি না। আমরা অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে আমাদের জীবন-ইতিহাস ও জীবনের দিকে তাকাই বলে আমাদের ইতিহাস চর্চায় সমস্যাটা হচ্ছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে বিধায়, যাদের ভেতর যুদ্ধের স্মৃতি খানিকটা হলেও স্পষ্ট তাদের বয়স একাত্তরে অন্তত দশ বছর ছিল ধরে নেওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে এখন যাদের বয়স অন্তত ষাট, তাদের মনে একাত্তরের স্মৃতি ধরা আছে। বাংলাদেশে মানুষ বাঁচেই আর কত বছর। পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা আর যথেষ্ট তথ্যও সংগ্রহ করতে পারছি না। এজন্যই আমার একটা কাজ নিয়ে খানিকটা সন্তুষ্টি আছে। ২০১৮ সালে কাজটা করেছি। এক জেলার একটা গ্রামে গিয়ে যতটা সম্ভব তথ্য আমরা নিয়ে এসেছি গণহত্যা ও গণনির্যাতনের ওপর। তথ্যগুলো আছে আমার কাছে কিন্তু আমি জানি না কবে ছাপা হবে ওসব বা আদৌ হবে কিনা। এখন দরকার হলে আমি দ্বিতীয়বার গিয়ে অনেক তথ্যই আর সংগ্রহ করতে পারব না। কারণ, যাঁদের স্মৃতি ছিল তাঁদের অনেকেই এ চার বছরে মারা গেছেন। আমরা ইতিহাস নিয়ে অপরাজনীতি করতে গিয়ে মানুষের সত্য অভিজ্ঞতা আহরণের এ সুযোগ হেলায় নষ্ট করছি। এ থেকে উত্তরণ বোধ হয় সম্ভব না। কারণ আমাদের রাজনীতির যে ইতিহাস চর্চা, তা আমাদের স্বাভাবিক ইতিহাস চর্চার প্রচেষ্টাকে ছাপিয়ে গেছে। বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চা বোধ হয় এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ। ইতিহাসবিদদের অনেকেই ইতিহাস চর্চা করতে চান না, তাঁরা দল চর্চা করছেন, আওয়ামী লীগেরই হন বা বিএনপিরই হন। এ থেকে সরে আসা কঠিন। এর বাইরে আরও যে সমস্ত কাজ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ওপর, সেগুলো আমাদের একটু বিচার-বিবেচনা করে পড়া উচিত। এমনকি যুদ্ধের দলিলপত্রও আমার মতে বিচার করে পড়া উচিত।
যুদ্ধের দলিলপত্রের ক্ষেত্রে আমি নিজেও কিছু আপত্তিকর বিষয় দেখেছি। দেখা গেল পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোথাও যুদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তান আর্মির পঞ্চাশজন মরে গেছে, আমাদের কেউ মরেনি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা। আমি এ নিয়ে সেনাবাহিনীর একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটা কী করে সম্ভব! আপনাদের কেউ মারা গেল না আর পাকিস্তান আর্মির পঞ্চাশ-ষাটজন মরে গেল? তিনি উত্তর দিলেন, আমাদের অনুপ্রেরণা দরকার ছিল, তখন ওরকম ব্যাপার ছিল- সেরকম বাস্তবতা ছিল, সে কারণে কেউ কেউ এমন করে লিখেছে।
শুনে আমি আর বাগ্বিতণ্ডা করতে চাইনি। চাইও না। যে কারণে আমি যুদ্ধের ইতিহাস থেকে দূরে থাকি। যুদ্ধের ইতিহাসের দলিল কই? বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বোধ হয় অনেক খণ্ডের একটা সংকলন বের করেছে। আমার প্রশ্ন হলো- দলিলগুলো কই, যে দলিলগুলো থেকে বিচার-বিশ্নেষণ করে তাঁরা ঠিক করেছেন কোন তথ্য গ্রহণযোগ্য আর কোন তথ্য তা নয়? এসব প্রশ্নের মীমাংসা আমাদের হবে না।
সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস যদি চাই তো তাতে অনেক কোটর থাকে, অনেক সংখ্যক ঘর থাকে। সেই সব ঘর যদি পূর্ণ হয়, তাহলে তখন আমরা বলতে পারি, এই হলো আমাদের ইতিহাস। আমাদের ইতিহাসে এই এতগুলো ঘর আছে, এতগুলো ধারা আছে। সব মিলে গোটা ইতিহাসটা দাঁড়াল। আমরা কিন্তু বলতে পারি না যে, আমাদের একটা ধারা, একটা শ্রেণি, একটা গোত্রের কেবল একটাই ইতিহাস রয়েছে।
সকল শ্রেণির সকল গোষ্ঠীর ইতিহাস হচ্ছে আমাদের ইতিহাস। যে সাধারণ প্রান্তিক মানুষ, যারা জনসংখ্যার নব্বই ভাগ, তাদের ইতিহাস হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের প্রধান ধারা। আমাদের মূলধারা মুজিবনগর না। আমাদের মূলধারা হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। এ ভাবনা আমরা লালন করতে পারছি না। অভিজাত শ্রেণি ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করছে। করছে বলেই আজ এই সংকট উপস্থিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের ইতিহাস আমরা জানি না, জানতে চাইও না। তাদের আমরা ইতিহাসের অংশ মনে করি না। আমরা মনে করি, যারা দুই-পাঁচজন গিয়ে গান গেয়েছিল তাদের ইতিহাস সাধারণ মানুষের ইতিহাসের চেয়েও অনেক বড়। প্রকারান্তরে মনে করি সাধারণ মানুষ ইতিহাসের অযোগ্য। এ ধারণা আমাদের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে চেতনে কি অবচেতনে অত্যন্ত প্রবল। আমরা কেবল মধ্যবিত্ত-অভিজাতদের ইতিহাসকেই ইতিহাস মনে করি। বাকিটুকু অস্বীকার করে মনে করতে থাকি প্রকৃত ইতিহাস মধ্যবিত্তের ইতিহাস। শ্রেণিদ্বন্দ্ব চলছে। এই শ্রেণিদ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াচ্ছে কাদের কাছে? গ্রামের মানুষের কাছে। গ্রামের মানুষ ইতিহাসে সবচেয়ে সবল। ইতিহাস চর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা দেখতে পাবেন, শেষ পর্যন্ত ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সাধারণ মানুষের হাতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জিতত না, যদি সাধারণ মানুষ তার পক্ষে না থাকত। সাধারণ মানুষ পক্ষে না থাকলে কোনোদিন কোনো যুদ্ধে কেউ জিততে পারবে না। কিন্তু আমরা তাদের সঞ্চিত ইতিহাস আহরণ করি না। আমরা যা করি, খুঁজে বের করি ইতিহাসে আমাদেরটুকু কোথায়, আমাদের প্রতিষ্ঠার উপকরণটুকু কোথায়।
আমাদের এমন আকাঙ্ক্ষা কোথা থেকে আসে? শ্রেণিগত অবস্থানজনিত একটা ধারণা থেকে আসে- আমি সবল! তাই আমি চাই আমার ইতিহাসটা থাকুক। তো তোমার ইতিহাসটার দিকে তাকালে কী দেখা যায়? দেখা যায় যে তোমার ইতিহাসে তুমিই প্রধান। এভাবে আমাদের এখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাস, দলকেন্দ্রিক বা কোনো ক্ষমতাবানকেন্দ্রিক ইতিহাস হয়। আমরা সদম্ভে মূলধারা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করি কোনটাকে? আমাদেরটাকে। আমাদের ধারাটাই মূলধারা। আর বাকি ধারা কোনো ধারাই নয়।
আজকে যদি বাংলাদেশের গ্রামের দিকে তাকানো যায় তো দেখা যাবে গ্রাম কত সবল। বাংলাদেশের গ্রামের রাষ্ট্রকে দরকার নাই। রাষ্ট্রের দরকার বাংলাদেশের গ্রামের মানুষকে। এই যে পরিবর্তনটা ঘটে গেছে আমাদের ইতিহাসবিদরা কিন্তু তা লক্ষ্য করছেন না। একটা মৌলিক পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে বিগত পঞ্চাশ বছরে। এবং এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে ভদ্রলোক-সুশীল সমাজের ইতিহাসে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নাই। এখন মধ্যবিত্ত সুশীলরা যে ইতিহাস তৈরি করছেন তা শুধু তারাই পড়েন। এর বাইরে যায় না। সেইসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণিটি হচ্ছে এই মধ্যবিত্ত সুশীল শ্রেণি। দুর্বল শ্রেণির ইতিহাস চর্চা চলছে আমাদের মাঝে।
ইংরেজ আসার পর থেকে আন্দোলন বিদ্রোহ করে, দালালি না করে, ঐতিহাসিকভাবে যে সমাজ আজ অনেক বেশি সবল হয়ে গেছে, সাধারণ সমাজ, তারা কিন্তু ইতিহাসটাকে একবার ধরেছে, আর ছাড়বে না। তারা আর একাত্তর সালে কী হয়েছিল তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। আগামীতে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। বাংলাদেশের আজকের রেমিট্যান্স সূচক দেখেই বোঝা যায় তারা কতটা সবল। রেমিট্যান্সের যে টাকা বাংলাদেশে এখন আছে তার ওপর শুধু সমাজ নয়, রাষ্ট্রও নির্ভরশীল। তবুও ভালো রেমিট্যান্সের মাত্র অর্ধেক আসে বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাকি অর্ধেক তো হুন্ডির মাধ্যমে সরাসরি দেশের মানুষের পকেটে চলে যায়। এই বাস্তবতা অস্বীকার করে লাভ নেই। সাধারণের সবল হয়ে ওঠার এরচেয়ে বড় সূচক আর কী হতে পারে।
ইতিহাস চর্চার এই রাজনৈতিক সংকটের যুগে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের ভেতরে সাধারণ মানুষের আরেকটা বিকল্প রাষ্ট্র তৈরি হয়ে গেছে এবং ক্রমেই তা সবল হচ্ছে। আমরা একে অস্বীকার করার চেষ্টা করে ঠিক না ভুল করছি তা আগামীই বলে দেবে।
লেখক, সাংবাদিক, গবেষক
বিষয় : বিজয় দিবস ২০২২
মন্তব্য করুন