পি কে সরকার প্রবোধ ৬ নম্বর সেক্টরে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছেন তো বটেই, একইসঙ্গে ভারতের জলপাইগুড়িতে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোদ্ধাদের নীতিগত অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সমকালের সঙ্গে আলাপে ব্যক্ত করলেন তাঁর ব্যক্তিগত অনুধাবন ও যুদ্ধস্মৃতি।

'২ জুন ১৯৭১। শিকারপুর বর্ডারের ইছামতী নদী ভেলায় পার হয়ে ভারতের করিমপুরে রাতে পা রাখলাম। আমাদের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করল মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রত্যয়ী যুবা পুরুষ। তারা স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত। করিমপুর সীমান্ত ঘেঁষা একটি গ্রাম। তখন মধ্যরাত। এক কৃষক পরিবারের স্ত্রী সমাদর করে খেতে দিলেন। এদিন অনেকদিন পর ভাত জুটল। মাছ, তরকারি, প্রতিটি ব্যঞ্জন কাঁসার বাটিতে। দুধ দিয়ে ভাত খেলাম দুই ভাই- আমি ও পরিতোষ। মাতৃসম ওই নারীকে আজও আমার ভক্তিভরা প্রণাম।'

সেই রাতে ওই বাড়িতেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না বলে জানান পি কে সরকার প্রবোধ। তিনি বলেন, 'চারদিকে শরণার্থী মানুষের ঢল। মানবিক বিপর্যয়ের সুনামিতে শুধুই অশ্রুপাত। চারদিকে ক্লান্তি, অনাহার, মৃত্যু।'
বীর এ মুক্তিযোদ্ধার ভাষায়, 'শরণার্থীদের এই ছিল নির্মম নিয়তি। গৃহস্থের গরুর গাড়িতে হলো রজনী যাপন। শুয়ে শুধু চিন্তার খোসা ছাড়ালাম। মায়ের আঁচল ছিঁড়ে দেশ ছাড়লাম সেদিন সীমান্ত অতিক্রমের অভিপ্রায়ে। পথ চলতে অজস্র কান্না, মৃত্যু, বেদনাবিধুর দৃশ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আজও আমি বেঁচে আছি।'

এ পর্যায়ে পি কে সরকার প্রবোধের নিজ বর্ণনায় যুদ্ধস্মৃতির রোমন্থন শোনা যাক-
'তখন উত্তপ্ত চৈত্র মাস। পূর্ববাংলার প্রকৃতিতে পাতা ঝরার দিন। এক নতুন ভোরের রক্তিম সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষায় কৃষ্ণনগর (ভারত) থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ খেজুরিয়া ঘাট (ফারাক্কা) পার হয়ে এলাম মামাবাড়ি জলপাইগুড়ি শহরে। সেখান থেকে হলদিবাড়ী সীমান্ত বেশি দূরে নয়। প্রতি রাতে ভারতীয় সেনাদের মর্টারিং সাপোর্টে হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানের গুলির আওয়াজ শুনতে পেতাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, যুদ্ধে যাব। মা, ভাই, বোন রয়ে গেছে অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানে। একদিন কেষ্ট মামা আমাকে নিয়ে গেলেন হলদিবাড়ী বর্ডারে। সেখানে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার মাহবুব ভাই শারীরিক ও অস্ত্রের শর্ট কোর্স ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠাতেন। আমি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলাম। ফরিদপুরের লোক জেনে তিনি আমাকে কিছু বাড়তি সুযোগ ও আপ্যায়ন করতেন- এ কথা ভোলার নয়।

২০ জুলাই ১৯৭১। আমাদের ৬ নং সেক্টর অপারেশন এরিয়া বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম কে বাশার ও সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ওই দিনই তেঁতুলিয়া ব্র্রিজ অবস্থানে রাজাকারদের তাড়ানোর জন্য আমাদের অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। সুবেদার আহমেদের নেতৃত্বে আমরা ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা রাইফেল ও হালকা মেশিনগান নিয়ে ভ্যানযোগে যাত্রা করলাম।

রাত ৮টার দিকে আমরা অকুস্থলে পৌঁছে প্রথম ফায়ার ওপেন করি। একজন ব্রিজ পাহারারত রাজাকার আমাদের সহজ টার্গেট ছিল। এক সহযোদ্ধার গুলিতে সে ধরাশায়ী হয়। আমাদের মারণসীমার মধ্যে তখন রাজাকারের অবস্থান সুস্পষ্ট। কিন্তু প্রাথমিক গুলির ধকল সামলে নিয়ে রাজাকাররা কাউন্টার ফায়ার শুরু করল। গুলি করার ধরন দেখে মনে হলো এর মধ্যে পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা আছে। বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলি হচ্ছিল।

একমাত্র সমতল ভূমি ছাড়া আমাদের সামনে কাভার করে ফায়ারিংয়ের কোনো অবস্থা ছিল না। বাধ্য হয়ে আমাদের সাইড রোল করে নিরাপদ অবস্থানে আসতে হয়েছিল। হঠাৎ তারই মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু। বোমাসদৃশ কিছু আমার পায়ের কাছে নিক্ষিপ্ত হলো। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। বারুদের গন্ধ আর ব্যথায় আমি জ্ঞান হারালাম। পরে শুনেছি আমার পা থেকে জালের কাঠিসদৃশ একটি বোমার স্পিল্গন্টার অপসারণ করা হয়েছিল।

একদিন আমাকে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে দেখতে আসেন এমএলএ (রংপুর-১১) আব্দুর রউফ ও এমএলএ (দিনাজপুর-১) মোশারফ হোসেন। সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কর্নেল কেহের সিং। এরই মধ্যে জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জ থানাধীন ধানঈশ্বরী গ্রামের ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ যুব শিবির চালু করা হয়। এই শিবিরে সাংকেতিক নাম ছিল দিল্লি ক্যাম্প। সেখানে একজন পলিটিক্যাল মোটিভেটর প্রয়োজন। আমার শিক্ষা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু উচ্চারণ দক্ষতা সবই তাঁরা পরখ করলেন। আমি তখনই মৌখিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলাম। প্রতিদিন সকাল ৭টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আমার মোটিভেশন পিরিয়ড রুটিনমাফিক ছিল। তা ছাড়া মেডিকেল চেকআপ ও ভারতীয় সামরিক ব্যক্তিদের আগমনে দোভাষীর কাজ করতে হতো। মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চতর প্রশিক্ষণে যাওয়ার সময় বা প্রয়োজনে সরাসরি রণাঙ্গনে যাওয়ার সময় অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাদের জন্য শেষ মোটিভেশন করতে হতো। প্রথম দুই মাস আমি একমাত্র মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে এখানে দায়িত্ব পালন করি। এরপর আসেন এম এ রহিম (ফরিদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক), আতাউর রহমান (ক্যাম্প ইনচার্জ), আমিনুর রহমান (ডেপুটি ক্যাম্প ইনচার্জ), মিঠু ভাই ও প্রফুল্ল কুমার দেব।

শেষের দিকে বাইরের শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা প্রায় নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। এখানে পানবাড়ী ক্যাম্পে বসবাসরত উত্তরাঞ্চলের প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া বেতার শিল্পী হরলাল রায় অনেকবার এসে সংগীতের সুর মূর্ছনায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই শিবিরে যোগদানের আগে আহত হয়ে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলাম অনেক দিন। মা, ভাই-বোন, মামারা দেখতে এসেছিলেন। সবাই নিষেধ করেছিলেন পরবর্তী যুদ্ধে যোগদান না করতে। আমি তা শুনিনি, অশ্রুপাতও করিনি। কিন্তু সহযোদ্ধা চক্রধরের বিদায় বেলায় আমাকে প্রণতি জানানোর সময় সেদিন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল সংবরণ করতে পারিনি। যাওয়ার সময় আমার নোটবইয়ে লিখে গেলেন তাঁর শেষ লেখা- 'দাদা বিদায়'। রণাঙ্গনে চক্রধর শহীদ হন। এমন অনেক স্মৃতি আজও আমাকে তাড়া করে।'

মূলত ৬ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স বুড়িমারী ছিল দেশের অভ্যন্তরে একমাত্র মুক্তাঞ্চল। বীর মুক্তিযোদ্ধা পি কে সরকার মনে করেন, এ সেক্টরের যোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বকীয়তার দাবিদার। 'এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা অসম বীরত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন,' বলেন তিনি। জানা যায়, দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী মুক্তিযোদ্ধারা বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরে ছিলেন। পি কে সরকার বলেন, 'একাত্তরে আমাদের জন্য যুদ্ধের ময়দান ছিল, পায়ের তলায় মাটি ছিল, আত্মগোপনের প্রয়োজনে প্রাকৃতিক নদী, খাল-বিল, জঙ্গল ছিল। হানাদারদের জন্য ছিল এটা বিদেশ-বিভুঁই। ভারতীয় হাই কমান্ড যুদ্ধ জয়ের জন্য বাহিনীকে তিন সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তি ও মিত্রবাহিনী মাত্র ১৩ দিনে সাফল্য লাভ করে।'

'এরই মাধ্যমে কবর রচিত হয় ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের, তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের, বলেন পি কে সরকার। 'ফলত, পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হয় আরেকটি দেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।'

লেখক, স্টাফ রিপোর্টার, ফরিদপুর