
পুলক চ্যাটার্জি
'ঊনসত্তরের উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের সময় আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলাম। তৎকালীন স্বরূপকাঠি ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের (প্রয়াত) নেতৃত্বে স্বরূপকাঠিতে সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সংশ্নিষ্ট থাকতাম। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হানা দেয় স্বরূপকাঠিতে। ওই দিন পাকিস্তানি বাহিনী স্বরূপকাঠির জগৎপট্টি গ্রামের সাহাপাড়া, জগন্নাথকাঠি, অলংকারকাঠি, কৃষ্ণকাঠি ও কামারকাঠি গ্রামে ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়। তখন বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই।'
কথাগুলো বলেছেন নজরুল ইসলাম। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি। সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও তিনি স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নজরুল ইসলাম বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর স্বরূপকাঠিতে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য তৎকালীন সদর ইউনিয়ন পরিষদে এক সভা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা কাজী শামসুল হকের (প্রয়াত) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, স্বরূপকাঠির সর্বত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হবে। এর আগেই স্বরূপকাঠি হাই স্কুল মাঠসহ হাবিব হাওলাদারের অয়েল মিল মাঠে ও ইন্দুরহাটে আলমগীর বাহাদুরের নেতৃত্বে স্বরূপকাঠিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।'
স্বরূপকাঠি হাই স্কুল মাঠে এবং হাবিব হাওলাদারের অয়েল মিল মাঠে প্রশিক্ষণ নেন নজরুল ইসলাম। আনসার কমান্ডার মোফাজ্জেল হোসেন ও বেলায়েত হোসেন এবং পুলিশ বাহিনীর দু'জন সদস্য তাঁদের দলটিকে প্রশিক্ষণ দিতেন। একটানা ২০ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
নজরুল ইসলাম বলেন, 'এর আগে স্বরূপকাঠির সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তরুণ-যুবক সংগঠিত হন। বরিশাল থেকে ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ স্বরূপকাঠির কুঁড়িয়ানায় এসে ঘাঁটি স্থাপন করেন। তখন ছাত্রলীগ নেতা নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের নেতৃত্বে আমাদের ২০ জনের দলটি ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের ঘাঁটিতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ক্যাপ্টেন বেগ আমাদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন।'
এরপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গেলেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'প্রশিক্ষণ যখন হলো না, আবার দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে জানতে পারি, ছাত্রলীগ নেতা নূর মোহাম্মদ হাওলাদার সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম তীরে ইন্দুরহাটসংলগ্ন বিন্নাগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করেছেন। আমি বিন্না গিয়ে নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দিই। সেখানেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরের অধীনে প্রশিক্ষণ নিই। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর নূর মোহাম্মদ হাওলাদার আমাকে গোয়েন্দা সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন।'
নজরুল ইসলাম বলেন, 'বিন্না ক্যাম্প ছিল সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম তীরে। অপরদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল সন্ধ্যা নদীর পূর্ব তীরের ছারছিনা গ্রামে। আমার কাজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ও রাজাকারদের ক্যাম্পের কার্যক্রম ও তাদের গতিবিধি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিন্না ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়া।'
১০ নভেম্বর নৌ ও স্থলপথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে ইন্দুরহাট বন্দর আক্রমণ করে। ওই দিন ইন্দুরহাট বন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই হয়। ইন্দুরহাট বন্দরে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন জলাবাড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা নির্মল হালদার ও সুটিয়াকাঠির বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন।
সন্ধ্যা নদীর পূর্ব তীরে ছারছিনার পীর সাহেবের বাড়িতে ঘাঁটি পেতেছিল পাকিস্তানি পুলিশ, সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী- জানান নজরুল ইসলাম। ছারছিনার ওই ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হতো। সিদ্ধান্ত হয় ছারছিনা পীরের বাড়ি আক্রমণের। নজরুল ইসলাম বলেন, 'পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ নভেম্বর ভোর রাতে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি গ্রুপ ছারছিনা পীরের বাড়ি আক্রমণ করি। ছারছিনা পীরের বাড়ি আক্রমণে অংশ নেয় নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের গ্রুপ, কাউখালীর হাবিব ও পনার গ্রুপ এবং বানারীপাড়ার বেণীলাল দাসগুপ্ত ও হায়দার কাজীর গ্রুপ। ভোর রাতে পীরের বাড়ি আক্রমণ হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হয়।'
সকাল পর্যন্ত বিরতিহীন সংঘর্ষ চলার এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর- জানান নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'রাজাকার বাহিনীর হাতে প্রথমে বন্দি এবং পরে শহীদ হন কাজী মতিউর রহমান ও আনসার আলী। তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা পীরের বাড়ি আক্রমণ থেকে পিছু হটে যান। এরপর নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটি ক্যাম্প স্থাপন করে সন্ধ্যা নদীর পূর্ব তীরের জিয়ানীবাড়ি গ্রামে।'
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্বরূপকাঠিতে জগন্নাথকাঠির আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ জিয়ানীবাড়ি গ্রামে নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের ক্যাম্পে এসে অবস্থান নেয়। পরে নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের গ্রুপ ও আব্দুল মালেকের গ্রুপের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা চারদিক থেকে ফের ছারছিনা পীরের বাড়ি আক্রমণ করলে একটানা সাত দিন যুদ্ধ চলে। নজরুল ইসলাম বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ছারছিনা পীরের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করা পাকিস্তানি পুলিশ, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর প্রায় ৩০০ সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তখন তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আত্মসমর্পণের পর ছারছিনার তৎকালীন পীর আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহকে বরিশাল থেকে এসে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম মঞ্জুর। ১৮ ডিসেম্বর (১৯৭১) হানাদারমুক্ত হয় স্বরূপকাঠি।'
যুদ্ধদিনের স্মৃতি হাতড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, 'একাত্তরের ১০ নভেম্বর নৌ ও স্থলপথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে ইন্দুরহাট বন্দর আক্রমণ করে। ওই দিন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন জলাবাড়ীর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নির্মল হালদার। পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে সহযোদ্ধারা পিছু হটলেও নির্মল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীন হন।
সেদিন নির্মলের রক্তে লাল হয়েছিল সন্ধ্যা নদীর জল। স্রোতে ভেসে যায় নির্মলের মরদেহ। সে দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া একই দিন সুটিয়াকাঠির বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেনও যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।
নজরুল ইসলাম বলেন, 'চোখের সামনে দুই সহযোদ্ধার মৃত্যু দেখেছি। এখনও সেই স্মৃতি মনে পড়লে চোখে জল আসে।'
লেখক, ব্যুরোপ্রধান, বরিশাল
মন্তব্য করুন