
মোস্তাফিজুর রহমান
একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের গুলিতে স্বামী হারান সুরবালা। অতঃপর নির্যাতিত হন। দেশ ছেড়ে ভারতের আশ্রয়শিবিরে যান। সেখানে দুই ছেলেকে হারান। সব হারানোর দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।
মাত্র ৯ বছর বয়সে ময়মনার বিয়ে হয়েছিল। দেশে যখন যুদ্ধ চলে তখন তাঁর বয়স ১২ বছর হবে। তাঁর স্বামীকে ধরে নিতে এসেছিল পাকিস্তানিরা। না পেয়ে ময়মনার ওপর চলে নির্যাতন। ময়মনা বাংলাদেশে ২০১৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত গেজেটের প্রথম বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা।
সুরবালার কথা
সুরবালা রানীর বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ফুলপুর ইউনিয়নের বাখাই পশ্চিমপাড়া গ্রামে। তাঁর স্বামী নিগেন্দ্র বিশ্বাস ক্ষত্রিয় মানুষের ক্ষেতে কামলা দিতেন। ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট গ্রামের ১৩ জন হিন্দুকে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায় সরচাপুর গুদারাঘাটে। কংস নদের পাড়ে নিয়ে নির্যাতন শেষে নদের পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে পানিতে ফেলা হয়। সেদিন ১৩ জনের মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়। নিগেন্দ্র বিশ্বাস তাঁদের একজন।
অবশিষ্ট চারজন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। ভেসে যাওয়া মরদেহগুলো পায়নি কেউ। তাঁদের হত্যার অন্তত ১৫ দিন আগের কথা। সুরবালা তখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করে চার পাকিস্তানি সৈন্য। সুরবালা সেখানে নির্যাতিত হন। এরপর স্বামীকেও যখন হত্যা করা হয়, এলাকার অনেকের সঙ্গে গ্রাম ছাড়েন সুরবালা। আশ্রয় নেন ভারতের মেঘালয়ের শিববাড়ি শিবিরে।
সুরবালা তখন চার সন্তানের জননী। মেয়ে সুনীতি রানী বিশ্বাস, শিউলি রানী বিশ্বাস, পুষ্প রানী বিশ্বাস ও ছেলে পাঁচ বছরের মলিন বিশ্বাস। ভারতের শিবিরে আরেক ছেলের জন্ম দেন সুরবালা। নাম রাখা হয় মুক্তি বিশ্বাস। ছেলেটি ঠান্ডা আর ডায়রিয়ায় ভারতের শিবিরেই মারা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশ ফেরেন সুরবালা। তিন মেয়েকে নিয়ে সুরবালা ঘানি ভাঙার কাজ শুরু করেন। নিজে ঘানি টেনে সরিষার তেল বিক্রি করে রোজগার করেছেন, সঞ্চয় করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী সুরবালার বয়স এখন ৯০ বছর ৯ মাস। এই বৃদ্ধ নারী বসবাস করেন সরকারের দেওয়া একটি টিনের ঘরে। যদিও রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতিপত্র নেই তাঁর।
সুরবালা বলেন, 'বিধবা মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে বাড়িতে থাকি। স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে মানুষের কটুকথা শুনে এ জীবন পাড়ি দিয়েছি। নিজের কথা আগে কাউকে বলতে চাইনি। এতে মানুষ আরও মন্দ বলত। তাই মুক্তিযোদ্ধার সনদও নিইনি।' তবে নারীপক্ষ নামে একটি সংগঠন মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাতা দেয় এখন। পান সরকারের বয়স্ক ভাতাও। এ দিয়েই তাঁর জীবন চলছে।
ভারতের শরণার্থী শিবিরে সুরবালার সঙ্গে ছিলেন ছায়া রানী বিশ্বাস। তিনি এখন সুরবালার চাচাত ভাইয়ের স্ত্রী। ছায়া রানী বিশ্বাস বলেন, 'দেশে ফিরে আসব আমরা- সে আশা ছিল না সে সময়। শিবিরে একসঙ্গে ছিলাম সবাই। সন্তান জন্ম দেওয়া, একসঙ্গে দুই সন্তানের মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছি।'
সুরবালার নাতনি অনিতা সরকার ও তাঁর বর উপার্জন করে মা ও নানি সুরবালার খরচ বহন করেন। সুরবালার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি রাষ্ট্রের কাছে এ পরিবারের দাবি।
কথা হয় স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও সমাজকর্মী এ টি এম রবিউল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'যখন এই সংগ্রামী নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করি- তখন লজ্জায় অপমানে কেউ কথা বলতে চাইতেন না। অনেক বোঝানোর পর অবশেষে নিজেদের কথা জানাতে শুরু করেন। সরকারিভাবে তাঁদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে ইতোমধ্যে আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার ২৮-৩০ জন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আরও কয়েকজনের যাচাই-বাছাই চলছে।' রবিউল করিম বলেন, 'তাঁদের দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা শুনলে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। নারী হিসেবে তাঁরা চিরকাল নিজ সমাজে চাপের মধ্যে থাকেন। আমি আশা করি, যাঁরা বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবেদন করেছেন, তাঁদের গেজেট প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে গেজেট প্রকাশ করা হবে।'
ময়মনার কথা
সংগ্রামী ময়মনা খাতুন। তাঁর বাড়ি ফুলপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে। স্বামীর ভিটেতে ভাঙা একটি টিনের ঘরে থাকেন। স্বামী আবদুল হামিদ মারা গেছেন ৩৩ বছর আগে।
মাত্র ৯ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন ময়মনা। বিয়েতে তাঁর মত ছিল না। তবু পরিবারের চাপে মেনে নিয়েছিলেন।
ময়মনা বলেন, 'তখন আমার খেলার বয়স। স্বামী কী জিনিস তখনও বুঝি না। বিয়ের তিন বছরের মাথায় দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। চারদিকে আতঙ্ক, গুলির শব্দ, পাকিস্তানিরা গাড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। যুদ্ধ শুরুর অন্তত দুই মাস চলার সময় একদিন আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। কিছু জিনিস এগিয়ে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়ার পথে এলাকার আসকর নামে এক রাজাকার আমার স্বামীকে ছাড়িয়ে নেন। আসকর সম্পর্কে আমার স্বামীর প্রতিবেশী মামা হতেন।'
স্বামীকে ছাড়িয়ে আনার দু'দিন পর আবার বাড়ির সামনের সড়কে পাকিস্তানিদের গাড়ি থামে। গাড়ির শব্দ পেয়েই স্বামী আবদুল হামিদ বাড়ি থেকে দৌড়ে পালান। ভরদুপুরে তাঁদের বাড়ির দরজায় গিয়ে দুই পাকিস্তানি দাঁড়ায়। স্বামীকে না পেয়ে চলে ময়মনার ওপর নির্যাতন। ময়মনা জানান, সেদিনের দু'দিন পর পাকিস্তানি সেনারা আবারও আসে। এবার সঙ্গে আরও কয়েকজন। কিন্তু সেবার ময়মনা পালিয়ে যান।
ময়মনা খাতুন বলেন, 'আমার ওপর অত্যাচার হওয়ার পর স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়িতে ফিরি। কিন্তু পাকিস্তানিদের অত্যাচারের শিকার হওয়ায় এলাকার মানুষ নানা কথা শোনাতে থাকে। এ কারণে স্বামীর সঙ্গে কয়েকবার বিচ্ছেদের উপক্রম হয়।'
স্বামী আবদুল হামিদকে অনেক বুঝিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখেন ময়মনা। যুদ্ধের অন্তত ১০ বছর পর ফাতেমা ও রোকেয়া নামে দুই মেয়ের জন্ম হয় তাঁর। এলাকার এক শ্রেণির মানুষ কোনো দিন কথা শোনাতে ছাড়েনি। আবদুল হামিদের মৃত্যুর পর ময়মনা মেয়েদের নিয়ে চলে যান গাজীপুরে। সেখানে দীর্ঘদিন গার্মেন্টে কাজ করে জীবন চালিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাওয়ার পর বাড়িতে ফিরেছেন।
সম্প্রতি ময়মনা খাতুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনেই একটি মুদি দোকান করে তাঁর জীবন চলছে। ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই তাঁর মুদি দোকান। সেখানে চা-ও বিক্রি করেন। দোকানটি ময়মনার মেয়ে রোকেয়া দেখাশোনা করেন। তাঁর জীর্ণ টিনের ঘরের সামনে বসে নিজের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখান ময়মনা।
জানা যায়, মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পান তিনি। ভিটে ঠিক করার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ায় ১৪ হাজার টাকা কেটে রাখা হয়। বাকি টাকায় জীবন চলছে। ময়মনার নিজের ভিটেয় টিউবওয়েল নেই। খাওয়া ও নিত্য ব্যবহারের পানি পাশের বাড়ি থেকে আনেন।
লেখক, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
বিষয় : বিজয় দিবস ২০২২
মন্তব্য করুন