
এস এম কাওসার
একাত্তরে দশম শ্রেণির কিশোর আমজাদ হোসেন টুকু। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বামুনিয়া গ্রামের মৃত দিয়ানত উল্লার আট ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যাবেন, কিন্তু পরিবহন ভাড়া নেই। বাবা-মা যেতেও দেবেন না। অগত্যা ঘর থেকে চুরি করেন চার মণ পাট! বিক্রি করেন ৭৮ টাকায়।
টাকা নিয়ে সহপাঠী বন্ধু আজাদের সঙ্গে ৬ মার্চ সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে পরদিন সকালে ঢাকায় পৌঁছান। ৭ মার্চ বিকেল ৪টায় উপস্থিত হন রেসকোর্সের মাঠে। বঙ্গবন্ধুর সেই আগুনঝরা ভাষণই সেদিন তাঁর নিয়তি ঠিক করে দেয়।
আমজাদ হোসেন টুকু বলেন, 'এরপর ফিরে এসে ৭ নম্বর সেক্টরের ডেপুটি সেক্টর কমান্ডার আব্দুল করিমের পরামর্শে ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে তটস্থ ছিলেন সবাই। পরিবারের সবার সার্বক্ষণিক নজর এড়িয়ে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমার মা বাইরে থেকে আমার ঘরে তালা মেরে রাখতেন। তবু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। এক রাতে ঘরের আরও ১৫ কেজি চাল সরিয়ে, জমানো ৪৫ টাকা নিয়ে, ঘরের বেড়া কেটে যুদ্ধের জন্য বের হয়ে পড়ি।'
৭ নং সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার মিজবাহুল মিল্লাত নান্নার অধীনে যুদ্ধে অংশ নেওয়া এ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা তাঁর অসংখ্য স্মৃতির ভেতর থেকে একটির কথা জানালেন। একবার পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল ঠেকাতে নিজবাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে নাড়ূয়ামালা এলাকায় রেললাইন উপড়ে ফেলার অপারেশনে অংশ নেন আমজাদ হোসেন টুকু। একাত্তরের জুলাই মাসের শেষের দিকের কথা। রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার লাইন উপড়ে ফেলার পর পাকিস্তানি বাহিনী খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। গ্রামবাসী রেললাইন উপড়ে ফেলেছে মনে করে এক গ্রামে আগুন দেয়। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে ফেরেন টুকুসহ কয়েকজন। সেদিন থেকে গ্রামটির নাম হয় পোড়াপাড়া। এ ঘটনার আরও একজন সাক্ষী গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুস সামাদ।
আমজাদ হোসেন টুকু বলেন, 'এ ঘটনার পর বাড়িতে খবর যায়, পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। কেউ বেঁচে নেই।'
এ খবর যখন গ্রামে আসে, আমজাদ হোসেন টুকুর মা আছরাভান নেছা পাগলপ্রায় হয়ে যান। পরে ফিরে আসেন টুকু। নাটকীয় মিলনাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের অনেক স্মৃতির ভেতর এ স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে।
আরও একবার মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেবার গাবতলী উপজেলার কালাইহাটা এলাকায় শান্তিবাহিনীর এক সদস্যকে হত্যায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন। সেবারও কৌশলে প্রাণে বেঁচে যান।
কথা হয় ৭ নং সেক্টরের ডেপুটি সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমজাদ হোসেন টুকু ছিল সাহসী তরুণ। তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তাব দিলে সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। পরে তাকে ভারতে প্রশিক্ষণে পাঠাই। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে রণাঙ্গনে ছিল।'
আমজাদ হোসেন টুকু বলেন, 'যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে ১১ নভেম্বর চারজন পাকিস্তানি আর্মিকে আটক করে ধরে নিয়ে যৌথ বাহিনীর কাছে সোপর্দ করি আমরা কয়েকজন। দলছুট হয়ে আর্মির চারজন ফাঁকা গুলি করতে করতে মহাস্থানের দিক থেকে গাবতলী প্রবেশ করে। এ সময় রামেশ্বরপুর এলাকায় তাদের আটক করা হয়। আটক করার পর মনে হয়েছিল আমরা হয়তো আর অল্পদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হতে পারব।'
লেখক, স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া
বিষয় : বিজয় দিবস ২০২২
মন্তব্য করুন