আতঙ্ক কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। পথ চেনা নেই তবুও দ্রুত পা চালাতে হচ্ছে নিরাপদ গন্তব্যের দিকে। গন্তব্যের ঠিকানাও জানা ছিল না। অন্যরা যেদিকে যাচ্ছে সেদিক লক্ষ করেই পা চালিয়ে যাচ্ছে ১০ জনের একটি দল। সবাই একই পরিবারের। মা, ভাইবোন, কাকিমা, কাকাতো ও জ্যাঠাতো ভাইবোন, বাবার পিসিমা ও ঠাকুরমা। এর মধ্যে রয়েছেন সদ্য বিধবা এক অন্তঃসত্ত্বা। কোলে শিশুসন্তানও ছিল। বিধবার বড় মেয়েটি তখনও বেশ ছোট। স্বামীকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।
কথা বলছিলেন রণেন রায়। তিনি দিঘাপতিয়া রাজবংশের শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায়ের বংশধর ও নাটোর প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি। শুরুতে বর্ণিত বিধবা মেয়েটি তাঁর বোন। শহীদ ভগ্নিপতির নাম জীবন কৃষ্ণ মানি।

রণেন রায় বলেন, 'বাবা, কাকা, ভগ্নিপতিসহ পরিবারের তিনজনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে ওরা। বাবা, কাকাসহ পরিবারের তিন সদস্যকে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। বাবা বরদা চরণ রায়কে রাজাকাররা প্রকাশ্যে দিনের বেলায় বাড়িতে ঢুকে কুপিয়ে হত্যার পর টুকরো করে কেটে বাড়ির বাইরে পুঁতে রাখে। এরপর আমরা বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটছিলাম।'

মুক্তিযুদ্ধের সময় রণেন রায় ছিলেন নাটোরের নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বলেন, 'যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের নজর এড়াতে বাবা-মা, ভাইবোন, কাকা-কাকিমা, ঠাকুরমাসহ আমাদের পরিবারের সদস্যরা গ্রামের বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার রায় হালসা গ্রামে গিয়ে বসবাস করছিলেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় গ্রামে গিয়ে থাকাটাই বেশি নিরাপদ ভেবে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন।'

ভগ্নিপতির মৃত্যু ছিল রণেন রায়ের পরিবারে প্রথম আঘাত। সেদিন ৩ বৈশাখ, ১৭ এপ্রিল। এর আগে ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা নাটোর শহরে প্রবেশ করে।
ভগ্নিপতি জীবন কৃষ্ণ মানি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শহরের চৌধুরী বাড়ির শাহ আলমের বাড়িতে ভাড়া ছিলেন। তিনি তখন লোকো লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জোনাল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত। চাকরির সুবাদে যুদ্ধের সময়ও তিনি পাবনা এবং রাজশাহী গিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কোনো সমস্যা হয়নি। এরপর অবস্থা খারাপের দিকে গেলে তিনি বাড়ি থেকে বের হতেন না। ১৭ এপ্রিল সকালবেলা সংসারের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই অবাঙালি বিহারিরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর শহরের শুকলপট্টি এলাকায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে গুলি করে।

রণেন রায় বলেন, 'স্থানীয়রা জীবনকে উদ্ধার করে নাটোর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে কর্তব্যরত ছিলেন চিকিৎসক হেমচন্দ্র বসাক। তিনি বলাই ডাক্তার নামে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় জীবন কৃষ্ণ বেঁচে যান। কিন্তু তাঁর বেঁচে যাওয়ার খবর প্রকাশ হয়ে পড়লে বিহারিরা হাসপাতালে তাঁকে আবারও গুলি করে এবং এবার মৃত্যু নিশ্চিত করে।'

বাড়িওয়ালার মাধ্যমে খবর পেয়ে রণেন রায়ের বোন তাঁর দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়ে স্বামীর দেখা পাননি। এরপর বিহারিরা পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় পরে ডাক্তার বলাইকেও হত্যা করে।


রণেন রায় বলেন, 'এই হত্যাকাণ্ডের সময় আমরা সবাই গ্রামে অবস্থান করছিলাম। খবর পেয়ে শিশুসন্তানসহ অন্তঃসত্ত্বা বোনকে আমাদের কাছে নিয়ে আসি। এ সময় প্রতিবেশীরা আমাদের খোঁজখবর রাখতেন। তবে ভিনপাড়ার রাজাকারদের উপদ্রব বেড়ে গেলে আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। প্রায় প্রতিদিনই পাকিস্তানি সেনাদের আসার কথা শুনে বাড়ির পাশের জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। দিনরাত প্রায় সব সময়ই পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার আতঙ্কে দিন কাটত।'

৮ বৈশাখ, ২২ এপ্রিল সকালে হঠাৎ করে একদল রাজাকার তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়ে মালপত্র লুট করে নিয়ে যায়। প্রভাবশালী প্রতিবেশীদের জানালে তাদের তৎপরতায় রাজাকাররা লুণ্ঠিত মালপত্র ফিরিয়ে দিয়ে যায়। রণেন রায় বলেন, 'পরদিন রাজাকাররা আবার হামলা চালাতে পারে- এমন খবর পেয়ে আমরা কয়েকজন প্রতিবেশীদের কাছে যাই। এ সময় রাজাকারদের একটি দল বাড়িতে ঢুকে বাড়ির মহিলাদের একটি ঘরে আটকে রাখে। বাবা বড়দা চরণ রায় বারান্দায় প্রতিদিনের মতো ইজি চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি বাধা দিতে গেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর ঘাড়ে কোপ দেয় রাজাকাররা। বাবা চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যান।'

এরপর রণেন রায়ের বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করে খণ্ড খণ্ড মরদেহ বাড়ির পাশে জঙ্গলে পুঁতে রাখে রাজাকাররা।

রণেন রায় বলেন, 'প্রতিবেশীদের সহায়তায় মা-বোনদের উদ্ধার করে পাশের গ্রাম সিংড়া উপজেলার হাতিয়নদহে জ্যাঠাতো ভাইয়ের বাড়িতে যাই। ২৪ বৈশাখ সকালে ওই গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের আসার কথা শুনে আবারও জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিই। পাকিস্তানি সেনারা জঙ্গল লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় আমার কাকা হরিদাস রায় তিন বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে পালাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। কাকা ছাড়াও স্থানীয় পুরোহিতের ভাই চন্দ্র শেখর চক্রবর্তী ও তার কর্মচারী শশাধর প্রাং ও কাকাতো ভাই বিনয় কুণ্ডুসহ অন্তত ২২ জনকে ধরে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।' ওই গুলিবর্ষণের সময় আগেই পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ভান করে থাকায় বেঁচে যান বিনয় কুণ্ডু। সেদিনের শহীদদের খোঁজ নেয়নি কেউ।

এই ঘটনার পর দেশে থাকার সাহস হয়নি আর। প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতের উদ্দেশে রওনা হয় রণেন রায়ের পরিবার। ভারতের বালুরঘাটের উদ্দেশে রওনা হলেও পথ ছিল অজানা। রণেন রায় বলেন, 'ভয় পাচ্ছিলাম কখন পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়তে হয়। হাঁটতে হাঁটতে সবাই কাহিল হয়ে পড়ছিলাম। একটু জিরিয়ে নেওয়ার সাহস হচ্ছিল না। ওদিকে সন্ধ্যা নামায় আশ্রয় নিতে হয় এক নদীর কিনারায়। মাঝেমধ্যে গুলির শব্দ আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল। কাকডাকা ভোরেই আবারও হাঁটতে শুরু করি। পিপাসায় ছটফট করেছেন কেউ কেউ। নলকূপ দেখে ছুটে গেছেন সেদিকে। নলকূপ নষ্ট ছিল। পরে কোনোক্রমে পানের জল মেলে।'

দুই রাত-দুই দিন চলার পর মঙ্গলবাড়ী সীমান্তপথ পেরিয়ে অবশেষে ভারতের মাটিতে পা রাখেন তাঁরা। মালদার মালতিপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন। সেখানে কদিন থাকার পর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। একটা নিরাপদ স্বদেশের স্বপ্ন ছিল তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

লেখক, নাটোর প্রতিনিধি