বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্যামল সিংহ রায় ১৯৭১ সালে বৃহত্তর খুলনা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তার নামে হুলিয়া জারি করেছিল। শ্যামল সিংহ রায়ের নিজ ভাষ্যে শোনা যাক যুদ্ধদিনের কথা।

'২৫ মার্চ রাতে ছিলাম বিএল কলেজের তৎকালীন গভর্নমেন্ট হোস্টেলে। ২৬ মার্চ ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি অধ্যক্ষের ভবনের সামনে ইপিআর ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য অবস্থান নিয়ে আছে। আমি হোস্টেল থেকে বি করিম স্যারের কোয়ার্টারের ভেতর দিয়ে পালিয়ে দৌলতপুর নতুন রাস্তার মোড়ে চলে আসি। পথে আসতে আসতে রেডিওতে শুনলাম সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। আমি কিছু সময় মীনাক্ষী সিনেমা হলের পেছনে সিপিবির সাবেক সভাপতি মনিরুজ্জামানের বাড়িতে আশ্রয় নিই। পরে দৌলতপুর দেয়ানার বাবর আলীর বাড়িতে চলে আসি।

২৭ মার্চ জানতে পারি, পাকিস্তানি হানাদারদের কনভয় খুলনায় প্রবেশ করছে। ইশতিয়াজ উদ্দিন হিলি, আমিসহ গ্রামের কয়েকজন সাহসী যুবক অস্ত্র নিয়ে দৌলতপুর ট্রাফিক মোড়ে গিয়ে দেখি তিন পাকিস্তানি সেনা দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধের কৌশল জানতাম না। হিলি হঠাৎ করে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে বসে। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়, হানাদাররা আমাদের লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা ১০ ইঞ্চি এক দেয়ালের পেছনে আশ্রয় নিই। পালিয়ে দেয়ানা বিলের ভেতরে চলে যাই। পরে জানতে পারি হানাদার বাহিনী রাগে ক্ষোভে মুসলিম লীগ নেতা এমএলএ রশিদের বাড়িতে হামলা করেছে।

ভারী অস্ত্র দিয়ে তাঁর বাড়ি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। কিছুদিন পর আমরা ভোমরা দিয়ে ভারতে চলে যাই। ভারতে কর্নেল শেরজন ও মেজর গোলের নেতৃত্বে ট্রেনিং নিই। ট্রেনিং শেষ করে আমরা কয়েকজন ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের নিয়ন্ত্রণাধীন জোড়া শিবমন্দির ক্যাম্পে যোগ দিই। আমিসহ কয়েকজনকে নেভাল ক্যাপ্টেন বেগের আন্ডারে দেওয়া হয়।

দেবহাটার আশপাশে অপারেশনে অংশ নিই। ক্যাপ্টেন বেগ ছিলেন খুবই সাহসী এবং সহযোদ্ধাদের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক। আমাদের অপারেশনে নিয়ে গেলে নিরাপদে না ফেরা পর্যন্ত তিনি ফিরতেন না। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তেরখাদায় ক্যাপ্টেন ফাহামের ক্যাম্পে যোগ দিই। ডিসেম্বর মাসে বিজয়ের আগে দৌলতপুরের মীনাক্ষী হল এলাকায় ১৭ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হলে বিকেলে আমরা খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে যাই। সেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অংশ নিই। অর্ধশত বছরের পুরনো স্মৃতিময় সেইসব দিন আজও জীবন্ত এ বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে।

লেখক, স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা