রাজশাহীতে নারী মুক্তিযোদ্ধা একেবারেই হাতেগোনা। তাঁদেরই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জিনাতুন নেসা তালুকদার। তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের গোবরা ক্যাম্পে। অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিলেও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-যত্ন ও নার্সিং করে কাটিয়েছেন যুদ্ধের সময়। গুলিবিদ্ধ হয়েও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাঁর সেবায় যেমন জীবন পেয়েছেন, তেমনি অনেককেই দেখেছেন মৃত্যুর কাছে হার মানতে। সেই স্মৃতিচারণ করেছেন সমকালের সঙ্গে।

জিনাতুন নেসা তালুকদার বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রেরণা আমার পরিবার। আমি যে পরিবার থেকে এসেছি, সেটি খুবই উদার ও অসাম্প্রদায়িক। এসএসসি পাস করার পর আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী আব্দুল্লাহ হিল বাকী ছিলেন ভাষাসংগ্রামী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা আইন ভঙ্গ করার কারণে তাঁর নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছিল। তিন মাস আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। শ্বশুরবাড়িও ছিল আওয়ামী ধারার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিল আব্দুল্নাহ হিল বাকী।'

পরিবারের পৃথক দুটি ভাবধারার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমার শ্বশুর ছিলেন আওয়ামী লীগে বিশ্বাসী। তাঁর ছেলেরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ওই পরিবারে আমার স্বামীসহ তাঁরা তিন ভাই ও আমি- চারজন মুক্তিযোদ্ধা। আর চাচাশ্বশুর নূর মোহাম্মদ ৫০ বছর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর পরিবারের সবাই রাজাকার। নূর মোহাম্মদ ও তাঁর ছেলে মোসলেম ছিল খুনি আয়েন উদ্দিনের ডান ও বাম হাত। যেদিন মুজিবনগর সরকার শপথ নেয় সেদিন মাইকিং হচ্ছিল যে, আব্দুল্নাহ হিল বাকীকে যে ধরিয়ে দিবে তাকে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আর যে আশ্রয় দিবে তাকে মেরে ফেলা হবে এবং তার বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ফেলা হবে। তখন থেকেই আমার স্বামীর আর ঘরে থাকা চলেনি। সে তখন মুক্তিযুদ্ধের সকল কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। ক্যাপ্টেন ইলিয়াসকে ইংরেজিতে লেখা আছে মনসুরের সঙ্গে আমার স্বামী ও দেবরের নাম। সেদিনই আমার স্বামী দুইজনকে সঙ্গে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশ পার হয়ে ভারতে যেতে বাধ্য হয়। এরপরই মুক্তিযুদ্ধে আমার আগমন। আমার বিরুদ্ধেও ওয়ারেন্ট বের হয়েছিল। তখন আমি এখানে ওখানে আত্মগোপন করে বেরিয়েছি। গোদাগাড়িতে আমার মামার বাড়িতে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। সেখানে মোসলেম আমাকে খুঁজতে গিয়েছিল। এরপর আর আমার থাকা সম্ভব হয় না।'

আব্দুল্লাহ হিল বাকী যাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে (ইসলাম) পাঠিয়েছিলের জিনাতুন নেসাকে নেওয়ার জন্য। কিন্তু জিনাতুন নেসার বড় মামা সেই ইসলামের সঙ্গে একা না দিয়ে মামার ছোট ছেলে মোজাম্মেল হককেও জিনাতের সঙ্গে দেন। গোদাগাড়ি দিয়ে বর্ডার ক্রস করে ভারতের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর গোরাবাজার যান তাঁরা। এখানে আমাদের গণসংযোগ অফিস ছিল। যেসব মুক্তিযোদ্ধা শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায় সেখান থেকে তাদের সনদ দেওয়া হয়।

জিনাতুন নেসা বলেন, 'এখানে খলিলুর রহমান নামে একজনের বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠি। তিনি রাজশাহী নওহাটার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বড় ছেলেকে মেরে ফেলার পর তিনি এখানে চলে আসেন। পরবর্তীকালে সেখানে রাজশাহী থেকে যত লোক আসত তাদের সবাইকে আমিই রান্না করে খাওয়াতাম। খাওয়া শেষে তাদের আমার স্বামী নাটোর, নওগাঁ ও চাপাইনবাবগঞ্জের ৭ নং সেক্টরে দিয়ে আসত।'

'একদিন আমাদের নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান হেনা ভাই এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি প্রবেশিকা উচ্চ মাধ্যমিকের সনদ এনেছি কিনা,' বলেন জিনাতুন নেসা। কামারুজ্জামান হেনা চাইছিলেন জিনাত সীমান্তের এ পারে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানোর দায়িত্ব নিক। 'আমি তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি,' জিনাতুন নেসা বলছেন, 'আমার স্বামী বলে উঠলেন, কী করবে সার্টিফিকেট দিয়ে?' হেনা ভাই বললেন, 'তুই তো কাজ করছিস, ও মেয়েমানুষ কী করবে? স্বামী তখন বললেন যে, ইলা মিত্র, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার উনারা কি মেয়ে ছিলেন না?' স্বামী আব্দুল্লাহ হিল বাকী চাইছিলেন তাঁর সহধর্মিনী তাঁর সহযোদ্ধা হিসেবে থাকুক। 'তিনি হেনা ভাই বলেন, 'তাহলে একটা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করেন। আমি তাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দেব।'

এখানে জিনাতুন নেসা সবাইকে রান্না করে খাওয়ানোর পর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঈপ্সিতা গুপ্তের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপকভাবে সাহায্য করতেন ঈপ্সিতা গুপ্ত। এ পর্যায় থেকে সংক্ষুব্ধ দিনগুলোর স্মৃতি জিনাতুন নেসা তালুকদানের নিজ ভাষ্যে শোনা যাক- 'যে ক'টা দিন এখানে আমি ছিলাম তখন ঈপ্সিতা দিদির সঙ্গে ক্যাম্পে ক্যাম্পে যারা ইম্প্রুভ ডায়েটে ছিলেন তাঁদের খাবার কিনে দিয়ে আসতাম। আবার মুর্শিদাবাদ হাসপাতালে যেসব আহত মুক্তিযোদ্ধা আসতেন তাঁদের নার্সিং করতাম। সেখানে নান্নুকে আহতাবস্থায় আনতে গুলিবিদ্ধ হয় পুরাণ মাঝি। পরে তার হাতে পচন ধরলে হাতটা কেটে ফেলতে হয়। বর্তমানে আড়ানিতে তার বাড়ি। ৬টা গুলি লাগার পরেও নান্নু বেঁচে গেল। তখন আমি ওখানেই ছিলাম। পুরাণ মাঝির হাত কাটার পর জ্ঞান ফিরলে সে আমাকে দেখতে পায়। এই কাজগুলোই আমি করতাম।'

হেনা ভাই আসার পর বলল যে ক্যাম্প করতে। এর সাত দিন পর আমার স্বামীকে নিয়ে আসতে বলল। তিনি অনেক আগে থেকেই হেনা ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের মতো কাজ করতেন। তাঁর যত গোপন কাজ আছে তিনি এগুলো করে দিতেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে গোপনে নিজের বাবা হামিদ মিয়ার বিরুদ্ধে তাঁকে কাজ করিয়েছেন হেনা ভাই। তবে সরাসরি বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। কারণ, হামিদ মিয়া ছিলেন মুসলিম লীগের আর হেনা ভাই আওয়ামী লীগের।

আমার স্বামীর কাছে শুনেছি, ক্যাপ্টেন শামসুল হক যুক্তফ্রন্টের হয়ে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর মওলানা ভাসানী জোটবদ্ধ হয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচন করেন এবং সরকার গঠন করেছেন। সেখানে মন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এক বছর পর সেই সরকার ভেঙে দিয়ে ইস্কান্দার মির্জা এসেছেন। তার আরও এক বছর পর আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন। এই লৌহমানব আবার ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন।

যাই হোক, তখন হেনা ভাই ডেকে পাঠালে আমি চলে যাই। সেটা হলো আট নম্বর মহেন্দ্রলাল রায় গোবরা নামের জায়গায় ক্যাম্প করা হয়। হেনা ভাই নকশালদের কাছ থেকে তিন তলা একটি বাড়ি ভাড়া নেন। সেখানে আমরা ৩০০ জন মহিলা প্রথম ব্যাচে ভর্তি হলাম। হেনা ভাই তখন একজনকে দিয়ে আমাকে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে আমরা প্রশিক্ষণ নিই। ওখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ম্যাডাম ছিলেন। শিপ্রা সরকার, মঞ্জু সরকার ও মীরা দে। কবি বিষ্ণু দের ছেলে কৃষ্ণ দে'র স্ত্রী হচ্ছেন মীরা দে। তাঁরা তিনজনই আমাদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের ক্লাস নিতেন। আর অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার শান্তি কান্ত ব্রহ্মচারী আমাদের আর্মস প্রশিক্ষণ দিতেন। এটা ছিল আমাদের তিন মাসের কোর্স। প্রশিক্ষণের শেষের দিকে এসে আমরা কলকাতা রেলওয়ে হাসপাতালে নার্সিং প্রশিক্ষণ নিই। সেখানে প্রথম ব্যাচে আমরা ২০ জন ছিলাম। সাজেদা চৌধুরী আমাদের রেসিডেন্সিয়াল ডিরেক্টর ছিলেন। তাঁকে আমাদের সার্বিক প্রশিক্ষণ ও অন্য সব দায়িত্ব দিয়েছেন হেনা ভাই।

তারপর সেখানে নার্সিং প্রশিক্ষণে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যান্ডেজ, স্যালাইন ও তিন প্রকারের ইনজেকশন দেওয়া আমাদের শেখানো হয়েছিল। এগুলো আমি এখনও দিতে পারি। আমার সঙ্গে জুটিতে ছিল যশোরের এক ডাক্তারের মেয়ে আম্বিয়া। তারপর আমরা দুই দিন, দুই দিন করে মেডিসিন ও সার্জারিতে ২০ দিন প্রশিক্ষণ নিই। সেখান থেকে ফিরে আমরা যার যার জায়গায় চলে এলাম। আমি রাজশাহীর ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টরে যুক্ত হই। যেখানে ক্যাপ্টেন গিয়াসের আন্ডারে ছিল ক্যাপ্টেন রশীদ। তাঁকে এরশাদের আমলে জিয়াকে হত্যার দায়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে মেরেছিল। ক্যাপ্টেন রশীদের স্ত্রী গর্ভাবস্থায় আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।


প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা ৪ নম্বর সাব-সেক্টরে যত আহত মুক্তিযোদ্ধা আসতেন তাঁদের সেবা করা এবং যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাঁদের নার্সিং করেছি। ইনজেকশন, স্যালাইন, ব্যান্ডেজসহ যত রকমের সেবা ছিল সবই করেছি। আমি আর্মস প্রশিক্ষণও নিয়েছিলাম। সত্য বলতে আমি বাংলাদেশে কোনো অপারেশনে আসতে পারিনি। তাছাড়া আমি সব কাজ করেছি। মুর্শিদাবাদে দুই মাস, এখান থেকে গিয়ে ক্যাম্পে তিন মাস আবার মুর্শিদাবাদে দুই মাস কাজ করি। পাকিস্তানি আর্মিদের গুলিতে পুরাণ মাঝি বেঁচে গেলেও আমার সামনে শিবলি মারা যায়। তার বাড়ি ছিল সারদায়। তার বাবা-চাচাসহ পরিবারের সব পুরুষকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে ও গুলি করে মেরে ফেলেছিল। তাদের সারদায় স্তূপ করে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়েছিল। সেই স্তূপের মধ্যে কিছু লোক বেঁচে গিয়ে নৌকায় করে নদী পার হয়ে মুর্শিদাবাদে আসে।

অনেকের শরীরে পোকা ধরে যায়। তারা বেশিরভাগই ছিল মহিলা। তখন তাদের হাসপাতালে আমি নার্সিং করেছি। তাঁদের মধ্যে শিবলি, শিবলির মা, ভাবি ও চাচি ছিলেন। শিবলি ক্যাপ্টেন গিয়াসের আন্ডারে একটা অপারেশনে গিয়েছিল। পরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ক্যাম্পে ফিরে এলে ঈপ্সিতা দিদি তাকে বলেন যে, তুই তো এখনও সুস্থ হসনি। এখন আবার অপারেশনে যাবি কীভাবে? তখন শিবলি বলে ওঠল যে, তার মনের ভেতরে বাবা-চাচার মৃত্যুর প্রতিশোধের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। পরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টরে ভর্তি হলো এবং অপারেশনে যায়। গিয়ে আর ফিরে আসেনি। শিবলিসহ চারজন যে বাড়িতে আশ্রয় নেয় সেখানে শত্রুতা করে তাদের ধরিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানিদের হাতে। পরে তাদের চোখ তুলে নিয়েছে, আঙুল কেটেছে, হাত-পা কেটে ধীরে ধীরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এসব তথ্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী জানিয়েছেন। ঈপ্সিতা দিদি সব তথ্য সংগ্রহ করতেন। এ ঘটনা পত্রিকাতেও এসেছে। শিবলিকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়ে মেরেছিল। এটা আমার একটি স্মরণীয় ঘটনা।

পুরাণ মাঝির তো হাত কাটা যাওয়ার পর ৬ দিন ওর সঙ্গে ছিলাম। পরে আমি মন্ত্রী হওয়ার পর সে ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তখনই তার পরিচয় জেনেছি। সে এসেই বলে যে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর চোখ খুলেই সে আমাকে দেখেছে। তখন খুব খুশি হয়েছি। শিবলির বিষয়ে আমার স্বামী জানিয়েছেন। তিনি তো তখন সবসময় তথ্য সংগ্রহে ছিলেন। আর পুরাণকে চিনেছি, ও যখন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নান্নুকে নিয়ে এসেছে তখন। আসার সময় সেও গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি খেয়েও সে থেমে থাকেনি। এ অবস্থাতেই নান্নুকে নিয়ে আসে। পরে নান্নুও বেঁচে যায়। নান্নুর পরিচয় জানি না। যেহেতু ৭ নম্বর সেক্টরে ছিল, সেহেতু রাজশাহীর নাটোর, নওগাঁ বা চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই হবে। আমি কাজ করার সময় কারও পরিচয় নেইনি। শুধু কাজ করে গিয়েছি। বশির নামে এক নৌ-কমান্ডারকে আমি চিনি। বেশ পাতলা-সাতলা। ও আমার কাছে এসেছিল। আমি মুক্তিযুদ্ধে সব করেছি কিন্তু অপারেশনের যাইনি। একদিনও কাজ ছাড়া ছিলাম না। ভাত, খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো থেকে শুরু করে সার্বিক সকল কাজই আমি করি। আলাউদ্দিন চাচা, মহসিন ভাইকে খাইয়েছি। আমরা পুঁইশাকের ঘাটি খেয়ে তাঁদের জন্য মাংস রেখেছি। তাঁদের খুব যত্ন করেছি। পরে তাঁরা এগুলো মনে রেখেছেন কিনা জানি না।

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন আমি রাজশাহী কলেজের ইতিহাস বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। ড. জোহা যখন গুলিবিদ্ধ হন তখন রাজাকার আয়েন উদ্দিন তাঁকে এনে বন্দি করে রাখে। রক্তক্ষরণে তিনি মারা যান। সময়মতো অপারেশন করা হলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতেন। সেদিনই আমাদের মাথায় আগুন ঝরা শুরু করল। আমরা মাথায় ব্যাজ ও সাদা শাড়ি পরে খালি পায়ে সারা দিন মিছিল করেছি। পরে সবাই মিলে আয়েন উদ্দিনের বাড়িতে আক্রমণ করলে আয়েন উদ্দিন বিপরীত দিক থেকে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।'

জিনাতুন নেসার আক্ষেপ, আয়েন উদ্দিনের মতো আরো অনেক স্বাধীনতাবিরোধী মানুষ আজও গোপনে ও প্রকাশ্যে তাদের কর্মজাল বিস্তার করে চলেছে। পরে সবাই মিলে আয়েন উদ্দিনের বাড়িতে আক্রমণ করলে আয়েন উদ্দিন বিপরীত দিক থেকে টিয়ার গ্যাস ছোড়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে আমি বালক স্কুলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে বাড়িতে আসি।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশে এলেন ১০ জানুয়ারি এবং স্বাধীনতা পুরোপুরি পূর্ণতা পেল। বিজয়ের মাস। এ মাসেই কথাগুলো বলছি। আমার খুব কষ্ট হয়, এতো উন্নয়নের পরেও মৌলবাদীরা এখনও কেন এতো শক্তিশালী! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার উত্তরসূরি। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ছিলাম দুই বছর। তখন সমাজকল্যাণ থেকে বের করে নিয়ে এসে ফুল কেবিনেট দিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী করেছেন। এর আগে এই মন্ত্রী ছিলেন ড. মোজাম্মেল হক। তার জায়গায় আমাকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। আজকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে চারদিকে ছড়ানো ছিটানো যত সমিতি, রেজিস্ট্রার সমিতিতে যারা নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে, সেগুলো আমার কাছেই ছিল। আমি এটা জোর করেই বলতে পারি, যেদিন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী সেদিন থেকেই তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করেছি। নির্লোভ রাজনীতি যেটাকে বলে। আমি আদর্শের রাজনীতি করি, কোনো লোভ-লালসার সঙ্গে কখনও আপস করিনি। যখন কেউ অর্থের প্রতি আসক্ত হবে তখনই সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে। যখন অর্থের বিনিময়ে কিছু করতে যাবো তখনই অনুপ্রবেশকারীদের অনুপ্রবেশ ঘটবে। আজকে তারা এত শক্তিশালী কেন হলো, কেমন করে হলো, সেটা আমারও প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করে গিয়েছেন। আর ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত্ম তার কন্যা শেখ হাসিনা এসে বাকি ২৭ হাজার স্কুল জাতীয়করণ করেছেন।

জিনাতুন নেসা তালুকদার আপেক্ষ করে বলেন, রাজাকার খুনী আয়েন উদ্দিনের কন্যা হাবিবা আজ এমপি হতে চায়। সে তো এখন বিএনপিকে লিড দিচ্ছে। শ্যামপুর তার বাড়ি। অনেক ভালো করে চিনি তাকে। মুক্তিযুদ্ধের পর একবার আমার বাসায় এসেছিল। তখন আমার স্বামী হাসছে আর বলছে, 'এই আয়েন উদ্দিনই একদিন আমাকে ধরে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা ঘোষণা করেছিল।'

লেখক, ব্যুরো প্রধান, রাজশাহী