
মুফতী সালাহউদ্দিন
৪ মে, ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ ততদিনে গণমানুষের যুদ্ধে পরিণত। গ্রামে গ্রামে তাণ্ডব চলছে। আতঙ্কিত মানুষ। পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে অন্তত ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া এলাকা। ১৯৭১ সালের ৩ মে সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার দিকে ৩৫-৪০ জনের একদল পাকিস্তানি মিলিটারি গানবোটযোগে কচা নদী দিয়ে পায়রা নদী অভিমুখে যাচ্ছিল। স্থানীয় রাজাকার-আলবদরের ইঙ্গিতে পাকিস্তানি হানাদারদের গানবোটটি নদী-সংলগ্ন ইটবাড়িয়া বোর্ড স্কুলের কাছে ভিড়ে। ইটবাড়িয়ায় সেদিন নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানিরা। সঙ্গে ছিল এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর। পুরুষদের হত্যার পর ১৪ জন নারীকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় সার্কিট হাউসে। রিজিয়া বেগম, হাজেরা বেগম, ছৈয়তুন নেছা, জামিলা বেগম, মনোয়ারা বেগম, ফুল বানু, সালেহা বেগম, মনোয়ারা বেগম, জোবেদা বেগম, হাচেন ভানু, জয়ফুল বেগম, হাচন ভানু, ছকিনা খাতুন ও ফুল ভানু। যুদ্ধের শেষদিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আনোয়ারা বেগমকে। এ ১৫ জন বীরাঙ্গনার মধ্যে বর্তমানে মাত্র সাতজন বেঁচে আছেন। তাঁরা হলেন-রিজিয়া বেগম, হাজেরা বেগম, ছৈয়তুন নেছা, মনোয়ারা বেগম, জামিলা বেগম, মনোয়ারা বেগম ও আনোয়ারা বেগম।
রিজিয়া বেগম
রিজিয়া বেগমের বয়স তখন ২৮ কিংবা ২৯ হবে। চার বছর আগে জয়েনদ্দিনের সহধর্মিণী হয়ে সদর উপজেলার ইটবাড়িয়ায় শ্বশুরবাড়ি আসেন রিজিয়া বেগম। স্বামী ও একমাত্র পুত্রসন্তানকে নিয়ে সুখেই কাটছিল সংসার। ৪ মে ১৯৭১। সকাল তখন সাড়ে ১০টা কি ১১টা। নিত্যদিনের মতো সকালের নাশতা খেয়ে দুপুরের রান্নাবান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবাই। এমন সময় হঠাৎ চারদিকে হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসে। গ্রামে আসে পাকিস্তানি মিলিটারি।
'দিনটা ছিল সোমবার। নদীর ধার থেইক্যা মানুষের হইচই আসে কানে। মিলিটারিরা আইতে আছে। কইতে না কইতেই পাকিস্তানি মিলিটারিরা ইটবাড়িয়া গ্রামে ঢুইক্যা পড়ে। চৌকিদারবাড়ি, মোল্লাবাড়ি, প্যাদাবাড়িতে ঢুকে আগুন দেয়। প্যাদাবাড়িতে তিনজনকে ধইর্যা নিয়া যায় এবং দুইজনকে গুলি কইর্যা মাইর্যা ফালায়। একজন পালাইয়া যায়।' মিলিটারি দেখে রিজিয়ার স্বামী জয়েনদ্দিন পালিয়ে যান। তখন মিলিটারিরা রিজিয়াকে ধরে নিয়ে যায় পাশের বাড়িতে। সেখানে চারজন মরে পড়ে আছে। গুলিবিদ্ধ। সেখান থেকে রিজিয়াসহ ১৫ জনকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। চার দিন সেখানে আটকে রেখে চালায় পৈশাচিক নির্যাতন। রিজিয়ার সঙ্গে নির্যাতনের শিকার হন আরও ১৪ নারী।
আজকের অশীতিপর বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, 'আল্লায় যতদিন বাঁচাইয়া রাখব, ততদিনই আমাদের মনের মধ্যে ঝাঁকুনি দিব। অ্যাহোনো স্বপ্ন দেইখ্যা কাইন্দা উডি।' রাজাকার-আলবদরের সহযোগিতায় ইটবাড়িয়া এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর সার্কিট হাউসে নারীদের ওপর নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি সেনারা। অসুস্থ হয়ে পড়লে এ নারীদের কচুবুনিয়া নদীর তীরে ফেলে রেখে যায়। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
হাজেরা বেগম
বীরাঙ্গনা হাজেরা বেগম, বয়স তখন ২৫ ছুঁইছুঁই; চার মাসের অন্তঃসত্ত্বাও। কোলেও সন্তান ছিল। আরও অনেকের সঙ্গে বাড়ির পাশের জঙ্গলে লুকিয়েছিলেন। রক্ষা পাননি। জঙ্গল লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাত পাকিস্তানিরা। ইটবাড়িয়ায়ও তাই চলে। গুলিবিদ্ধ হয় হাজেরার কোলের শিশুর। হাজেরাসহ অনেকের ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুরুষদের হত্যা করা হয়। এরপর নারীদের বাধ্য করা হয় মিলিটারির সঙ্গে যেতে।
হাজেরা বেগম বলেন, 'তখন আমি জিগাই- আমনেরা কি আমাগোরে মাইর্যা হালাইবেন? হেরা কয়, না তোদেরকে মাইর্যা হালামু না, আমরা মাইয়া মানুষ মাইর্যা হালাই না। আমাগো লগে তোগো সবাইকে সার্কিট হাউসে যাইতে অইবো। তহোন আমি হেগোরে কই আমাগো কেউ হামনেগো লগে যাইতে পারবো না। মাইর্যা হালাইলে এইহানে আমাগোরে মাইর্যা হালান।'
তখন থেকেই শুরু রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত। সার্কিট হাউসে আনাহারে আটকে রেখে চার দিন নির্যাতন চালানো হয়। চোখের সামনে অনেক হত্যাকাণ্ড দেখেছেন তাঁরা।
ফুল বানু
বীরাঙ্গনা ফুল বানু (৮২) বলেন, 'বেলা তহোন ১০টা-১১টা হইবো, মোর স্বামীর লাইগ্যা চুলায় গরম ভাত করতেছিলাম। হের কলেরা রোগ হইছিল। হেইকালে হুনি উত্তর দিকে কোলাহল। ওনারে ভাত খাওয়াইয়া বাড়ির দরজার দিকে আগাইয়া দেহি পাকিস্তানি মিলিটারিরা নদীর কিনারে গানবোট লাগাইয়া মোগো গ্রামের দিকে আইতাছে।'
অনেক নারী-পুরুষ পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে পালান। ফুল বানুও ছোট বোনের হাত ধরে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে যান। ফুলবানু বলেন, 'মনে হইছিল পাকিস্তানিরা মোরে মাইর্যা হালাইবো, বাঁইচা থাহনের আশা ছাইড়্যা দিছিলাম। আল্লায় মোরে বাঁচাইয়া আনছে।'
মনোয়ারা বেগম
বীরাঙ্গনা মনোয়ারা বেগম (৭২) বলেন, 'এইদিন পাকিস্তানি মিলিটারিরা আইয়া এই গ্রামের বাড়িঘরে আগুন জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দেয় এবং ঘরের মালপত্র লুটপাট কইর্যা লইয়া যায়। সিকদার বাড়ি যাইয়া মোর শ্বশুর, চাচা শ্বশুরসহ চারজনকে গুলি কইর্যা মাইরা হালায়। এইয়া দেইখ্যা রুহু লগে আছিল না। তহোন মোর কোলে ছয় মাসের একটা বাচ্চা আছিল। খবর হুইন্যা মোরা গিয়া বাড়ির ধারের জঙ্গলে পলাই।' মনোয়ারা আরও বলেন, 'চার দিন পর মিলিটারি গো হাত থেইক্যা ছাড়া পাইয়া গ্রামে ফিইর্যা আসি। আইয়া হুনি পাকিস্তানিরা এই গ্রামে ২৪ জনকে গুলি কইর্যা মাইর্যা হালাইছে। একটা রাইতও শান্তিতে ঘুমাইতে পারি নাই, এই বুঝি মিলিটারিরা আবার আইয়া ধইর্যা লইয়া যায়। আবার পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়া নির্যাতন চালায়। চাপা কান্না লইয়া এহোনও বাঁইচ্যা আছি।'
আনোয়ারা বেগম
আনোয়ারা বেগম ইটবাড়িয়ার স্থানীয় নন। তিনি ঘটনাক্রমে পটুয়াখালীতে নির্যাতিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ কিংবা ১৬ বছর। গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটায়। বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে যশোরে থাকতেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকের কথা। নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে যশোর থেকে তাঁরা বিভিন্ন এলাকার সাত নারী, দুই পুরুষসহ মোট ৯ জন পালিয়ে বরিশাল আসেন। সেখান থেকে নৌকাযোগে পাথরঘাটা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন তাঁরা। পথিমধ্যে পটুয়াখালীর সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া সংলগ্ন কচা নদী অতিক্রম করে মির্জাগঞ্জের পায়রা নদীতে ঢুকলে পাকিস্তানি মিলিটারিদের গানবোটের সামনে পড়ে যায় নৌকাটি। তখন মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়েন তাঁরা। বীরাঙ্গনা আনোয়ারা বেগম (৬৮) বলেন, 'সেই দিনগুলার কথা মনে হইলে দম বন্ধ লাগে।'
লেখক, পটুয়াখালী প্রতিনিধি
বিষয় : বিজয় দিবস ২০২২
মন্তব্য করুন