
১৯৯৫ সালে জাতীয় ইতিহাস রক্ষায় এক যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেন আট বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট। এর পরের বছর ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ এ ট্রাস্টের অধীনে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ জাদুঘরে রয়েছে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদান। যে কারণে এটি হয়ে উঠেছে নাগরিক জাদুঘর। আর এখানে সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধের কথ্য ইতিহাসের এক বিশাল ভান্ডার। প্রায় ৫৬ হাজার মানুষের স্মৃতিকথা রয়েছে তাদের সংগ্রহে। লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত
স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিষয় ছিল না। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ঘটনাপ্রবাহেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালে। সে যুদ্ধে ছিল গণমানুষের অংশগ্রহণ। তার ইতিহাসের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে আহ্বান জানায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। জনগণের ব্যাপক সাড়া এ উদ্যোগকে এক নতুন মাত্রা দেয়। এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৬ হাজার মানুষের কথ্য ইতিহাস সংগ্রহে রয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক।
তিনি বলেন, 'আমরা চাই, একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেই সময়টা আরও ভালোভাবে বুঝতে শিখবে। এতে ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্তির একটা ভিন্নমাত্রা থাকে। শুধু সংখ্যা দিয়ে একে বিচার করা উচিত নয়। এ প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের মানুষদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তা লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। আমাদের সংগ্রহে ৫৬ হাজার মানুষের কথ্য ইতিহাস আছে। তবে এটা অপ্রাতিষ্ঠানিক। ইতিহাসটা সে সময়ের মানুষ কীভাবে দেখেছেন, তা এখানে উঠে এসেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে এ উদ্যোগ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।'
এই কথ্য ইতিহাস সংগ্রহ শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। প্রতিটি লেখাই যেন এক ভিন্ন ইতিহাস। মফিদুল হক বলেন, 'আমি নিজেই এ প্রকল্পের পরিচালক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষ থেকে যখন ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া শুরু করল, তখন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা সাধারণ মানুষের দেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাদের শুরুটা হয়েছিল দেশের উত্তর প্রান্ত তেঁতুলিয়ায়। আমরা ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর নিয়ে সেখানকার সিপাহীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যাই। সেখানেই প্রথম আমরা এ আবেদন রাখি- শিক্ষার্থীরা যেন মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের মানুষদের স্মৃতিকথা নিয়ে আমাদের কাছে পাঠায়। এর পর আমরা ঢাকায় ফিরে আসি। কয়েক দিন হয়ে গেল। আমরা ভাবছিলাম, ছেলেমেয়েরা শুনে শুনে লিখতে পারবে কিনা। এর পর আমাদের কাছে এলো এক গুচ্ছ লেখা। এতে অনেক ঘটনা, অনেক আবেগ, স্মৃতি উঠে এসেছে। এ থেকে অনেক কিছুই আমরা জানতে পারলাম। তখন মনে হলো, এ উদ্যোগ কাজে লাগবে। আমরা প্রতিটি স্কুলে একজন শিক্ষককে সমন্বয়কারী হিসেবে দিয়ে দিই। তাঁর তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা লেখাটি তৈরি করে পাঠায়। এটি এক ভিন্ন ধাঁচের কথ্য ইতিহাস। তা ছাড়া এগুলো ছিল অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার। ফলে যাঁরা বলেছেন তাঁরা স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবেই বলেছেন। হাতের লেখাতেও আছে স্বতঃস্ম্ফূর্ততা। এগুলো ইতিহাসের দলিল নয়; আমরা দেখছি ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে। একজন মানুষ ঘটনাগুলো কীভাবে দেখে, তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। খুঁটিনাটি তথ্যে হয়তো একটু এদিক-ওদিক হতে পারে। তবে সারবস্তু ঠিক আছে কিনা- সে বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হওয়া দরকার বলে মনে করি।'
মফিদুল হক বলেন, 'আমরা যে ৫৬ হাজার লেখা পেয়েছি, তার মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার লেখাতেই নারীদের ভাষ্য। এর কারণ হলো, এখন তো আমাদের ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান। ছাত্রীরা ঘরে গিয়ে দাদি বা নানির কাছ থেকে তাঁর স্মৃতিকথা জানতে চায়। আর তাই অর্ধেক কথাই নারীদের। এখানে যাঁদের কথা এসেছে, তাঁরা মূলত সেই কণ্ঠ, যা সেভাবে শোনা হয়নি। আবার নারীর দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা দেখারও আলাদা মূল্য রয়েছে। এখানে তাৎপর্যপূর্ণ অনেক গল্প উঠে আসে।'
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম বলেন, 'সারাদেশে নতুন প্রজন্মকে জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত করতে ব্যাপক কর্মসূচি চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য সংগ্রহ তার মধ্যে একটি। দুটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের প্রতিটি জেলায় গিয়ে এক মাস থাকে। এ সময়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলার স্কুলে যায়। শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনগুলো দেখে।'
এ সময় মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয় তাদের; জানান রফিকুল ইসলাম- 'জাদুঘরের পক্ষ থেকে যিনি উপস্থিত থাকেন, তিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এখন পর্যন্ত ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেছে মুক্তিযুদ্ধের এ ইতিহাস। পরিবার, প্রতিবেশী বা পাড়া-মহল্লার পরিচিতজন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা দেখেছেন; নারী-পুরুষ যে কারও অভিজ্ঞতা শুনতে বলা হয় ওই শিক্ষার্থীদের। সেসব অভিজ্ঞতার লেখ্য রূপ স্কুল থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পাঠানো হয়। জাদুঘর এসব ভাষ্য কম্পোজ করে বইয়ের আকারে বাঁধাই করে সংশ্নিষ্ট স্কুলগুলোতে পাঠায় এবং মূল কপি আর্কাইভে সংরক্ষণ করে। তিন মাস অন্তর একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাতে যেসব শিক্ষার্থী লিখিত ভাষ্য পাঠিয়েছে, তাদের ও যাঁদের ভাষ্য নেওয়া হয়েছে তাঁদের নাম-ঠিকানা ও প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ থাকে। বাছাই করা কিছু ভাষ্যও প্রকাশিত হয়।'
ভাষ্য পাঠানো শিক্ষার্থীদের জাদুঘরের পক্ষ থেকে একটি স্বীকৃতিপত্রও দেওয়া হয় বলে জানান রফিকুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম ও নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন যোগসূত্র গড়ে উঠছে। তিনি আরও জানান, এসব ভাষ্য অঞ্চলভিত্তিক বাছাই করে বই আকারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য নামে ২০২১ সালে দশম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ। তবে এ উদ্যোগ শুরু হয় আরও আগে। আট বিশিষ্ট নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা- স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন; লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী মফিদুল হক; নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের; সংসদ সদস্য, নাট্যব্যক্তিত্ব ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আসাদুজ্জামান নূর; নাট্যব্যক্তিত্ব ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সারা যাকের; প্রকৌশলী ও সমাজকর্মী জিয়াউদ্দীন তারিক আলী; চিত্রকলা বিশ্নেষক, সংগ্রাহক ও করপোরেট ব্যবস্থাপক আক্কু চৌধুরী এবং সাবেক বিএমএ মহাসচিব ও করপোরেট ব্যবস্থাপক ডা. সারওয়ার আলী এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে তিনজন প্রয়াত, একজন নেপালে অবস্থান করছেন। বাকি চারজন ট্রাস্টি এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি দেখাশোনা করছেন।
এ প্রসঙ্গে মফিদুল হক বলেন, 'তখন স্বাধীনতার ২৫ বছর হয়ে গেছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের এগোতে হয়েছে। আমরা আটজন তখন ভাবছিলাম, কিছু একটা করা দরকার। সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষায় থাকলে আরও ১৫-২০ বছর লাগবে। আবার এতে ইতিহাস বিলুপ্তি ও বিকৃতির আশঙ্কা থেকে যাবে। তাই আমরা বেসরকারি উদ্যোগে একটি নাগরিক উদ্যোগ নিতে চাইছিলাম। সিদ্ধান্ত হয় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার। এ লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। এ ট্রাস্ট মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু কাজ করবে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপন অন্যতম।'
৫ নম্বর সেগুনবাগিচার ছোট্ট দোতলা বাড়িটিতে যাত্রা শুরু করা জাদুঘরটিতে দিন দিন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা, প্রকাশনা, ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো, মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহসহ বহুমুখী কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এর একটি সুপরিসর নিজস্ব ভবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্যতিক্রমী স্থাপত্যশৈলীর জাদুঘর ভবনটি আগারগাঁওয়ে অবস্থিত। ছাদের ওপর আর সামনের দেয়াল থেকে কামান-বন্দুকের নলের মতো নানা আকারের কংক্রিটের নল বেরিয়ে এসেছে। কাছে গেলে দেয়ালেও কিছু ক্ষতচিহ্ন দেখা যাবে। প্রায় দুই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত এই ভবনের ব্যবহারযোগ্য আয়তন ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট।
প্রাগৈতিহাসিক কালের ফসিল, প্রাচীন টেরাকোটা, মৃৎপাত্র, শিলাখণ্ড থেকে মুঘল আমল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্য, নিদর্শন ও আলোকচিত্র সংগৃহীত আছে ১ নম্বর গ্যালারিতে। এর নাম 'আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম'। এ ভূখণ্ডের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্বাধিকার অর্জনের পটভূমি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ২ নম্বর গ্যালারির নাম 'আমাদের অধিকার, আমাদের ত্যাগ'। এ গ্যালারিটি মুক্তিযুদ্ধের পর্ব শুরুর ইতিহাস জানান দেয়। এর একটি অংশে চমৎকার স্থাপনাকর্মের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার ঘটনা। 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ট্যাঙ্ক, কামান ও সাঁজোয়া যান নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়।
৩ নম্বর গ্যালারির শিরোনাম 'আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র'। এখানে আছে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবনযাত্রা, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বড় আকারের ডিজিটাল প্রিন্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ হওয়া ও রাজাকারদের তৎপরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয়স্থল। এর পাশাপাশি আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশি-বিদেশি যাঁরা বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন; জনমত সৃষ্টি করেছেন সে দিকগুলো। রয়েছে পণ্ডিত রবিশঙ্করের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' গানের জর্জ হ্যারিসনের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, সুরের স্টাফ নোটেশন।
৪ নম্বর গ্যালারির নাম রাখা হয়েছে 'আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ'। এতে আছে নৌ যুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন, বিলোনিয়ার যুদ্ধের রেলস্টেশনের রেলিং, ট্রলি, মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনাদের আক্রমণ, দগ্ধ বাড়িঘর প্রভৃতি। শেষ হয়েছে ১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের অনুলিপি দিয়ে।
বিষয় : বিজয় দিবস ২০২২
মন্তব্য করুন