তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা, রাজনীতিক, সাবেক সচিব। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পাকিস্তান প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। সমকালের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি তুলে ধরেছেন গত পাঁচ দশকে এ রাষ্ট্রের অর্জনগুলো, যা বাংলাদেশকে সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যেই একে উন্নত একটি দেশে রূপান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সবুজ ইউনুস
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা। ৫০ বছরের অর্জন ও অসম্পূর্ণতা কোথায় কোথায়?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
আমাদের অর্জন অনেক। তবে এখনও অনেক কিছু রয়েছে, যা অর্জন করতে হবে। আমি চিরকাল আশাবাদী মানুষ। অনেকেই আছেন, যারা বিষয়গুলো অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন; বলেন, এটা হলে সেটা হতে পারত। এগুলোকে বলে 'কাউন্টার ফ্যাকচুয়াল আর্গুমেন্ট'। কিন্তু আমরা সবাই জানি, সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে গেছে। বিদ্যুৎ এখন উদ্বৃত্ত। বিশ্ব সংস্থাগুলো দেশের এ উন্নয়নে বিস্ময় প্রকাশ করছে। ফলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি গর্বিত। কারণ, অনেক মুক্তিযোদ্ধা এই অর্জন দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু আমি দেখে যেতে পারছি।
কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন-সংগ্রাম এতটাই গভীর ছিল যে এটা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রথমে আটচল্লিশ থেকে বাহান্নতে ভাষা আন্দোলন। এরপর ষাটের দশকে শিক্ষা আন্দোলন ও ছয় দফা আন্দোলন হলো। এ সময়ে আমি কিন্তু সংযুক্ত ছিলাম না। আমি লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর শিক্ষকতা করেছি। এরপর সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দিলাম। একাত্তরে আমি এসডিও অর্থাৎ মহকুমা কর্মকর্তা ছিলাম মেহেরপুরে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এসেছিলাম। টিএসসির এক কোণায় দাঁড়িয়ে সেই ভাষণ শুনেছিলাম। রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়, এমন এক সম্মোহনী ভাষণ। এরপর আবার কর্মস্থলে ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে থাকি। দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাও অসহযোগ আন্দোলন করেছেন; কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলন করে সফল হয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে মূলত ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান হলো। প্রথম থেকেই আমরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকলাম। ভাষাটা হলো সংস্কৃতির পরিচায়ক। সেই ভাষার ওপর আক্রমণ হলো প্রথমে। বঙ্গবন্ধু হয়তো তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এদের (পশ্চিম পাকিস্তান) সঙ্গে এক হয়ে থাকা সম্ভব হবে না। তখন থেকেই তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি সামনের দিকে এগোতে থাকেন। আমরা বাঙালিরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হতে থাকি। তৎকালীন পূর্ব বাংলার পাট রপ্তানি থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো সবই তারা নিয়ে নিত। ইসলামাবাদকে রাজধানী করা হলো। সেখানে অর্ধেক টাকা আমরা দিয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তানে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। অথচ একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৫০০ মেগাওয়াট। সেই বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। আমাদের এই অর্জনকে কাজে লাগিয়ে আরও এগিয়ে যেতে হবে।
আমরা কখনও পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র হতে চাইনি। কথায় বলে মাছে ভাতে বাঙালি। সবাই মিলে মাছে ভাতে বাঙালি হতে চেয়েছি। আমরা কখনও যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো হতে চাইনি। চেয়েছি হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য লালন-পালন ও সেই মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে। আমরা এতটুকু অন্তত অর্জন করতে পেরেছি। এটা কোনো অংশেই কম নয়।
উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হবে কি?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করে। এখানে গ্রামের সাধারণ মানুষ এসে সেবা পেত। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেটা বাতিল করে দিল। অনেকটা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে এটা বাতিল করা হলো। অথচ এর ফলে গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা উপেক্ষিত হলো। আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এসে সেটা চালু করল। এখন গ্রামের মানুষ হাতের কাছে অন্তত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। এমন হিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। মানুষের কল্যাণে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের চার মূলনীতির একটি। ৫০ বছরে আমরা কোথায় অবস্থান করছি?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
পৃথিবীতে এরকম রাষ্ট্র আমি দেখিনি, যেখানে চারটি ধর্ম থেকে বাণী পাঠ করার পর কোনো অনুষ্ঠান শুরু হয়। আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো এভাবে চার ধর্মের বাণী পাঠ করেই শুরু হয়। এটা অনেক বড় একটি বিষয়। যে যার ধর্ম-কর্ম করবেন। সেটা করার সুযোগ থাকতে হবে। শিক্ষার মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার এই দীক্ষা থাকতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সময় ধর্মীয় বিষয়ে এমন উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয় যে গোলযোগ দেখা দেয়। এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশে কওমি মাদ্রাসায় সাধারণত গরিব মানুষের ছেলেরা পড়াশোনা করে। সরকার এই শিক্ষাকে মূলধারায় আনার চেষ্টা করছে। যে কোনো শিক্ষার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ থাকতে হবে। অন্যের মতের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। আমেরিকায়ও কিন্তু ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটি আছে। যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশ স্বাধীন করা হয়। এর কতটুকু অর্জিত হয়েছে বলে মনে করেন?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষার হার কমে গেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। মানুষ অর্থবিত্তের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। আমি আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে আসি ১৯৮৩ সালে। এই সময় আমেরিকান এক দম্পতি এলো বাংলাদেশে। তারা অনেক ধনি। আমেরিকাতে তাদের বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়িসহ সবই ছিল। কিন্তু তারা সব সুখ ত্যাগ করে আমাদের দেশে দশ বছর দুঃখী মানুষের সেবা করেছেন। গ্রামে তখন বর্তমানের মতো এত সুযোগসুবিধা ছিল না। তারা কষ্ট শিকার করে নিয়ে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। কারণ শিক্ষার সঙ্গে তাদের দীক্ষাও ছিল। তাদের অর্থবিত্তের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। এটাই হলো মূলত শিক্ষা ও দীক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ এখন অর্থবিত্তের প্রতি খুব বেশি ঝুঁকে পড়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গর্বিত। আনন্দিত। কারণ আমাদের অনেকেই দেশের এই উন্নতি দেখে যেতে পারেননি। আমাদের ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে আউটসোর্সিং করে বছরে বিলিয়ন ডলার ইনকাম করছে। পাকিস্তানের টাকার ভ্যালু আমাদের অর্ধেক। অর্থাৎ আমাদের একশ টাকা বর্তমানে পাকিস্তানে দুইশ রুপির সমান। রিজার্ভও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে পাকিস্তান, ভারত থেকে আমরা এগিয়ে আছি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে আমাদের অর্জন এখন বিশ্বস্বীকৃত। সামনে আরও এগিয়ে যাব, ইনশাল্লাহ।
এক সময় বিদ্যুতের জন্য সারাদেশে হাহাকার ছিল। এখন বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। প্রায় শতভাগ ঘরেই এখন বিদ্যুৎ যাচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে জীবনযাপনের মান পরিবর্তন করে দিয়েছে এই বিদ্যুৎ। আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতেও যাচ্ছি। কিন্তু সৌর বিদ্যুৎ করতে হলে অনেক জমি দরকার। আমাদের তা নেই। ফলে বহুমুখী জ্বালানির ওপরই গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। ৫০ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন হলো; আমরা রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছি। পরমাণু দেশের তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছি। এককভাবে এটা দেশের বড় প্রকল্প। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে এখানে। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের কারণেই সম্ভব হচ্ছে। কয়েক শত প্রকৌশলী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। অচিরেই এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।
নতুন প্রজন্মের প্রতি কী বার্তা দিতে চান?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
নতুন প্রজন্মের জন্য আমার বার্তা হলো, তারা তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে যাক। অর্থবহ সমাজ গঠনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করুক। যেখানে সবাই অংশ নেবে। শিক্ষা-দীক্ষা দুটোই অর্জন করতে হবে। অর্থের প্রতি মোহ কমাতে হবে। বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গের মতো অনেক মেধাবী আমাদের দেশেও আছে। এ দেশের সত্যেন বোসের কথা সবার মনে আছে। মেধার কারণেই তাকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ডেকে নেন। আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা আরও বেশি করে দিতে হবে। আমি আশাবাদী সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে তারা এগিয়ে যাবে; বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই উন্নত একটি দেশ হবে।
সমকাল :আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী :
আপনাকেও ধন্যবাদ।