- বিজয় দিবস
- পরিবেশ রক্ষা গণতন্ত্র রক্ষার মতোই
পরিবেশ রক্ষা গণতন্ত্র রক্ষার মতোই

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী। তিনি বলেছেন, পরিবেশ রক্ষায় মানুষ যদিও সোচ্চার হচ্ছে, সংঘবদ্ধ হতে পারছে না। এখন পরিবেশ সচেতনতা যেমন বেড়েছে, তেমনই পরিবেশ ধ্বংসের হারও বেড়েছে। তবে ভরসা জোগাচ্ছেন উচ্চ আদালত। তার মতে, পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন করতে পারলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে। তিনি বলেন- পরিবেশ, প্রকৃতির শত্রুদের বিরুদ্ধেও বিজয় ছিনিয়ে আনতে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ পরিবেশ রক্ষা গণতন্ত্র রক্ষার মতোই সামষ্টিক দায়িত্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রোকন
পাঁচ দশক বয়সী এই রাষ্ট্রে আপনি নিজে আড়াই দশক ধরে পরিবেশ আন্দোলনে সক্রিয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান প্রাপ্তি কী?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান :সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে, পরিবেশ সুরক্ষার অনেক ইস্যুতে মানুষ সোচ্চার হয়েছে। আপনিও জানেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন সাধারণ মানুষ নদী, পাহাড়, জলাভূমি, বন রক্ষায় সোচ্চার হচ্ছে। পরিবেশ আন্দোলন এই দেশে 'এলিট' হয়ে থাকেনি। ইউরোপেরও অনেক দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠী পরিবেশ আন্দোলন করে। বাংলাদেশে ক্রমেই পরিবেশ আন্দোলন সাধারণ মানুষের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ইস্যু হয়ে উঠছে। কিন্তু তারা এখনও আন্দোলনে সংঘবদ্ধ ও সফল হতে পারছে না।
পরিবেশ ইস্যুতে সাধারণ মানুষকে ভরসা জোগাতে উচ্চ আদালত সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রিজওয়ানা হাসান :একদম ঠিক বলেছেন। পরিবেশের প্রশ্নে আমাদের উচ্চ আদালত সবসময়ই সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করেছেন। আমি তো বলব, প্রথমদিকে উচ্চ আদালত পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃত্বই দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থেকে পরিবেশবিষয়ক আইনি কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আদালতের রায় ও নির্দেশনার কারণে পরিবেশ ধ্বংসকারীরা খানিকটা ভয় পায়। মানুষ সাহস পায়। আপনি জানেন, আমি নিজেও পরিবেশ আন্দোলন শুরু করেছিলাম আসলে আদালতের কাছে পরিবেশ রক্ষার আবেদন করার মধ্য দিয়ে।
শুরুর দিকে পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রিজওয়ানা হাসান :তখনও পরিবেশ ধ্বংসকারীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি। তথাকথিত উন্নয়ন বা শিল্পায়ন এতটা আগ্রাসী হয়ে ওঠেনি। তখনও আবাসনের নামে নির্বিচারে জলাভূমি দখল ও ভরাট করা শুরু হয়নি। তখনও পাহাড় বা বন কাটা হতো। কিন্তু এখনকার মতো কথায় কথায় পাহাড় কাটা যেত না। ঢাকার কাছেই শালবন তখনও অবশিষ্ট ছিল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এখনকার মতো সবাই দলবেঁধে গিয়ে যেভাবে খুশি পরিবেশ ধ্বংস করতে পারত না। তখনও নদীতে গায়ের জোর খাটিয়ে বালু তুলত না কেউ।
আর এখন?
রিজওয়ানা হাসান :এখন পরিবেশ সচেতনতা যেমন বেড়েছে, তেমনই পরিবেশ ধ্বংসের হারও বেড়েছে। মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে আগের তুলনায় বেশি আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে পরিবেশেরও ক্ষতি করছে। যেমন রাতারগুলের পরিবেশ কিছুদিন আগেও ভালো ছিল। পর্যটন করতে গিয়ে সেই পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। এই যে একদল মানুষ পরিবেশ রক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হচ্ছে এবং আরেক দল সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছে, তাদের মধ্যে ঐক্য দরকার। কারণ উভয় পক্ষ পরিবেশ ভালোবাসে। তাহলে পরিবেশ আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে।
পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
রিজওয়ানা হাসান :আমি নদী, বন, পাহাড়, জলাভূমি নিয়ে একশটা চ্যালেঞ্জের কথা বলতে পারি। কিন্তু সবকিছুর মূলে রয়েছে দুটো প্রধান চ্যালেঞ্জ। একটা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে গা বাঁচিয়ে চলতে চায়। মনে করে, এটা শুধু পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দায়িত্ব। ফলে অনেক সময় পরিবেশ আন্দোলন প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিবেশের প্রশ্নে সংবেদনশীল নয়। যে কোনো ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা বন, নদী, পাহাড় ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না। সামান্য লাভের জন্য পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করতে হাত কাঁপে না। ফলে পরিবেশ ধ্বংসকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
কিন্তু সরকার তো পরিবেশ রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংবিধানে পরিবেশ রক্ষার ধারা সংযোজন করা হয়েছে। অনেক আইন হয়েছে। আমার জানা মতে, নদী সংশ্নিষ্টই ৩১টি আইন ও বিধিবিধান রয়েছে।
রিজওয়ানা হাসান :দেখুন, আইন আছে প্রয়োগ নেই। পরিবেশ রক্ষায় অনেক আইন আছে, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করবে কে? যাদের প্রয়োগ করার কথা, তারা পরিবেশের শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজশ করে দেখেও না দেখার ভান করে। কখনও কখনও নিজেরাই পরিবেশের ক্ষতি করে। আর আইনগুলোও কীভাবে হয়, আমরা জানি। যেমন উচ্চ আদালত নদী কমিশন গঠন করার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু সেই কমিশন আইন এমনভাবে করা হলো, কমিশনের হাতে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা আর থাকল না। আইন ঠিকমতো প্রয়োগ হলে পরিবেশ রক্ষার জন্য আমদের বারবার আদালতের কাছে যেতে হতো না। একদিকে আইন করে, অন্যদিকে সেই আইন না মেনে নিজেই যত্রতত্র ড্রেজিং করে, কৃষি জমি নষ্ট করে, বন ধ্বংস করে। বাংলাদেশে যে কয়টা ইকো-সিস্টেম আছে, সবগুলো ভেঙে পড়েছে। তাহলে আইন করে লাভ কী?
রাষ্ট্রযন্ত্র তো সবকালে সব দেশই মনে করেছে যে, উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশের প্রশ্নে খানিকটা ছাড় দিতে হয়।
রিজওয়ানা হাসান :এই ধরনের চিন্তা সবকালে সব দেশেই আত্মঘাতী প্রমাণিত হয়েছে। আপনি তো কয়েকদিন আগে ধলেশ্বরী নদীতে ঘুরে এলেন। সেখানে ট্যানারি বসিয়ে ধলেশ্বরী নদী ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু তারা ভেবে দেখছে না যে, চাইলে আরও একশটা ট্যানারি বানানো সম্ভব। কিন্তু ধলেশ্বরী একবার নষ্ট হয়ে গেলে আরেকটি ধলেশ্বরী বানানোর ক্ষমতা কারও নেই। আপনি পরিবেশ ধ্বংস করে সন্তানের জন্য কোটি কোটি টাকা, বাড়ি-গাড়ি রেখে গেলেন। কিন্তু বাতাস দূষিত হয়, সেই সন্তান নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। পানি দূষিত হলে পিপাসা মেটাতে পারবে না। তখন টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি কোনো কাজে আসবে না।
কী করতে হবে?
রিজওয়ানা হাসান :পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন করতে হবে। তাহলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে। পরিবেশ ধ্বংস করে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হয়, তাতে কোনো লাভ হয় না। না পরিবেশের, না উন্নয়নের।
আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। কীভাবে আরও ভালোভাবে পরিবেশ রক্ষার কাজ করা যেতে পারে?
রিজওয়ানা হাসান :পরিবেশ রক্ষা গণতন্ত্র রক্ষার মতো সামষ্টিক দায়িত্ব। প্রত্যেক নাগরিকের এ ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কিছু লোক সক্রিয় থাকলেই হবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই পরিবেশ রক্ষায়ও মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের নামে পরিবেশবিরোধী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ৫০ বছর আগে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু প্রাকৃতিক স্বাধীনতা এখনও আসেনি। আমাদের বন, পাহাড়, নদী, উর্বর সমতল ভূমি দখল ও দূষণের কাছে বন্দি হয়ে আছে। প্রকৃতির স্বাধীনতাও মানুষের সংগ্রাম ছাড়া সম্ভব হবে না।
এই লেখা বিজয় দিবসে প্রকাশ হবে। পরিবেশ প্রশ্নে বিজয় দিবসের তাৎপর্য কী?
রিজওয়ানা হাসান :পরিবেশ, প্রকৃতির শত্রুদের বিরুদ্ধেও বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। সংবিধানে বলা হয়েছে, এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। বাংলাদেশের নদী, বন, পাহাড়, জলাভূমি, কৃষিভূমিকে সেগুলোর মালিকের কাছ থেকে মুষ্টিমেয় লোক কেড়ে নিতে চাইছে। তাদের পরাজিত করতে হবে। এটাই হোক বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার।
সমকাল :ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
রিজওয়ানা হাসান :সমকালকেও ধন্যবাদ।
পাঁচ দশক বয়সী এই রাষ্ট্রে আপনি নিজে আড়াই দশক ধরে পরিবেশ আন্দোলনে সক্রিয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান প্রাপ্তি কী?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান :সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে, পরিবেশ সুরক্ষার অনেক ইস্যুতে মানুষ সোচ্চার হয়েছে। আপনিও জানেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন সাধারণ মানুষ নদী, পাহাড়, জলাভূমি, বন রক্ষায় সোচ্চার হচ্ছে। পরিবেশ আন্দোলন এই দেশে 'এলিট' হয়ে থাকেনি। ইউরোপেরও অনেক দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠী পরিবেশ আন্দোলন করে। বাংলাদেশে ক্রমেই পরিবেশ আন্দোলন সাধারণ মানুষের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ইস্যু হয়ে উঠছে। কিন্তু তারা এখনও আন্দোলনে সংঘবদ্ধ ও সফল হতে পারছে না।
পরিবেশ ইস্যুতে সাধারণ মানুষকে ভরসা জোগাতে উচ্চ আদালত সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রিজওয়ানা হাসান :একদম ঠিক বলেছেন। পরিবেশের প্রশ্নে আমাদের উচ্চ আদালত সবসময়ই সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করেছেন। আমি তো বলব, প্রথমদিকে উচ্চ আদালত পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃত্বই দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থেকে পরিবেশবিষয়ক আইনি কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আদালতের রায় ও নির্দেশনার কারণে পরিবেশ ধ্বংসকারীরা খানিকটা ভয় পায়। মানুষ সাহস পায়। আপনি জানেন, আমি নিজেও পরিবেশ আন্দোলন শুরু করেছিলাম আসলে আদালতের কাছে পরিবেশ রক্ষার আবেদন করার মধ্য দিয়ে।
শুরুর দিকে পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রিজওয়ানা হাসান :তখনও পরিবেশ ধ্বংসকারীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি। তথাকথিত উন্নয়ন বা শিল্পায়ন এতটা আগ্রাসী হয়ে ওঠেনি। তখনও আবাসনের নামে নির্বিচারে জলাভূমি দখল ও ভরাট করা শুরু হয়নি। তখনও পাহাড় বা বন কাটা হতো। কিন্তু এখনকার মতো কথায় কথায় পাহাড় কাটা যেত না। ঢাকার কাছেই শালবন তখনও অবশিষ্ট ছিল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এখনকার মতো সবাই দলবেঁধে গিয়ে যেভাবে খুশি পরিবেশ ধ্বংস করতে পারত না। তখনও নদীতে গায়ের জোর খাটিয়ে বালু তুলত না কেউ।
আর এখন?
রিজওয়ানা হাসান :এখন পরিবেশ সচেতনতা যেমন বেড়েছে, তেমনই পরিবেশ ধ্বংসের হারও বেড়েছে। মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে আগের তুলনায় বেশি আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে পরিবেশেরও ক্ষতি করছে। যেমন রাতারগুলের পরিবেশ কিছুদিন আগেও ভালো ছিল। পর্যটন করতে গিয়ে সেই পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। এই যে একদল মানুষ পরিবেশ রক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হচ্ছে এবং আরেক দল সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছে, তাদের মধ্যে ঐক্য দরকার। কারণ উভয় পক্ষ পরিবেশ ভালোবাসে। তাহলে পরিবেশ আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে।
পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
রিজওয়ানা হাসান :আমি নদী, বন, পাহাড়, জলাভূমি নিয়ে একশটা চ্যালেঞ্জের কথা বলতে পারি। কিন্তু সবকিছুর মূলে রয়েছে দুটো প্রধান চ্যালেঞ্জ। একটা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে গা বাঁচিয়ে চলতে চায়। মনে করে, এটা শুধু পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দায়িত্ব। ফলে অনেক সময় পরিবেশ আন্দোলন প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিবেশের প্রশ্নে সংবেদনশীল নয়। যে কোনো ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা বন, নদী, পাহাড় ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না। সামান্য লাভের জন্য পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করতে হাত কাঁপে না। ফলে পরিবেশ ধ্বংসকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
কিন্তু সরকার তো পরিবেশ রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংবিধানে পরিবেশ রক্ষার ধারা সংযোজন করা হয়েছে। অনেক আইন হয়েছে। আমার জানা মতে, নদী সংশ্নিষ্টই ৩১টি আইন ও বিধিবিধান রয়েছে।
রিজওয়ানা হাসান :দেখুন, আইন আছে প্রয়োগ নেই। পরিবেশ রক্ষায় অনেক আইন আছে, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করবে কে? যাদের প্রয়োগ করার কথা, তারা পরিবেশের শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজশ করে দেখেও না দেখার ভান করে। কখনও কখনও নিজেরাই পরিবেশের ক্ষতি করে। আর আইনগুলোও কীভাবে হয়, আমরা জানি। যেমন উচ্চ আদালত নদী কমিশন গঠন করার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু সেই কমিশন আইন এমনভাবে করা হলো, কমিশনের হাতে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা আর থাকল না। আইন ঠিকমতো প্রয়োগ হলে পরিবেশ রক্ষার জন্য আমদের বারবার আদালতের কাছে যেতে হতো না। একদিকে আইন করে, অন্যদিকে সেই আইন না মেনে নিজেই যত্রতত্র ড্রেজিং করে, কৃষি জমি নষ্ট করে, বন ধ্বংস করে। বাংলাদেশে যে কয়টা ইকো-সিস্টেম আছে, সবগুলো ভেঙে পড়েছে। তাহলে আইন করে লাভ কী?
রাষ্ট্রযন্ত্র তো সবকালে সব দেশই মনে করেছে যে, উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশের প্রশ্নে খানিকটা ছাড় দিতে হয়।
রিজওয়ানা হাসান :এই ধরনের চিন্তা সবকালে সব দেশেই আত্মঘাতী প্রমাণিত হয়েছে। আপনি তো কয়েকদিন আগে ধলেশ্বরী নদীতে ঘুরে এলেন। সেখানে ট্যানারি বসিয়ে ধলেশ্বরী নদী ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু তারা ভেবে দেখছে না যে, চাইলে আরও একশটা ট্যানারি বানানো সম্ভব। কিন্তু ধলেশ্বরী একবার নষ্ট হয়ে গেলে আরেকটি ধলেশ্বরী বানানোর ক্ষমতা কারও নেই। আপনি পরিবেশ ধ্বংস করে সন্তানের জন্য কোটি কোটি টাকা, বাড়ি-গাড়ি রেখে গেলেন। কিন্তু বাতাস দূষিত হয়, সেই সন্তান নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। পানি দূষিত হলে পিপাসা মেটাতে পারবে না। তখন টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি কোনো কাজে আসবে না।
কী করতে হবে?
রিজওয়ানা হাসান :পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন করতে হবে। তাহলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে। পরিবেশ ধ্বংস করে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হয়, তাতে কোনো লাভ হয় না। না পরিবেশের, না উন্নয়নের।
আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। কীভাবে আরও ভালোভাবে পরিবেশ রক্ষার কাজ করা যেতে পারে?
রিজওয়ানা হাসান :পরিবেশ রক্ষা গণতন্ত্র রক্ষার মতো সামষ্টিক দায়িত্ব। প্রত্যেক নাগরিকের এ ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কিছু লোক সক্রিয় থাকলেই হবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই পরিবেশ রক্ষায়ও মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের নামে পরিবেশবিরোধী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ৫০ বছর আগে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু প্রাকৃতিক স্বাধীনতা এখনও আসেনি। আমাদের বন, পাহাড়, নদী, উর্বর সমতল ভূমি দখল ও দূষণের কাছে বন্দি হয়ে আছে। প্রকৃতির স্বাধীনতাও মানুষের সংগ্রাম ছাড়া সম্ভব হবে না।
এই লেখা বিজয় দিবসে প্রকাশ হবে। পরিবেশ প্রশ্নে বিজয় দিবসের তাৎপর্য কী?
রিজওয়ানা হাসান :পরিবেশ, প্রকৃতির শত্রুদের বিরুদ্ধেও বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। সংবিধানে বলা হয়েছে, এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। বাংলাদেশের নদী, বন, পাহাড়, জলাভূমি, কৃষিভূমিকে সেগুলোর মালিকের কাছ থেকে মুষ্টিমেয় লোক কেড়ে নিতে চাইছে। তাদের পরাজিত করতে হবে। এটাই হোক বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার।
সমকাল :ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
রিজওয়ানা হাসান :সমকালকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন