'মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য হাসিমুখে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন অগণিত বীর বাঙালি। যাদের সবার নাম আমাদের জানা নেই। তাই বলে আমরা তাদের বিজয়গাথা রচনা করব না, এটা হতে পারে না। এজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একাত্তরের প্রতিটি বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজীবন গাইব।' দেশ সিরিজের গান নিয়ে ঠিক এ কথাই বলেছিলেন অবসকিওরের কণ্ঠশিল্পী সাঈদ হাসান টিপু। প্রশ্ন ছিল অবসকিওরের বদলে যাওয়া নিয়ে। কারণ এর আগে যারা এই ব্যান্ডের 'অবসকিওর', 'অবসকিওর-২', 'স্বপ্নচারিণী', 'ফেরাতে তোমায়', 'ইচ্ছের ডাকাডাকি', 'অপেক্ষায় থেকো' ও 'ফেরা' অ্যালবামের গানগুলো শুনেছেন, কয়েক দশকের পথ পরিক্রমার পর তাদের কাছে অবসকিওর হয়ে উঠেছে অন্য এক ব্যান্ড। 'অবসকিওর ও বাংলাদেশ', 'মাঝরাতে চাঁদ' ও 'ক্র্যাক প্লাটুন', 'স্টপ জেনোসাইড' অ্যালবাম গানগুলো শ্রোতাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ভিন্ন এক অবসকিওরকে। এতে অবশ্য ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা ভাটা পড়েনি। বরং আগের চেয়ে তাদের এসব আয়োজন প্রশংসিত হয়েছে। সেই সুবাদে পেয়েছেন একাধিক স্বীকৃতি। কিন্তু জনপ্রিয়তা বাড়াতে বা স্বীকৃতির জন্য অবসকিওর সদস্যরা ব্যান্ডের গানের ধারা বদলে দিয়েছে, ঠিক তা নয়। টিপুর কথায় সেটাই স্পষ্ট। দেশমাতৃকার জন্য শিল্পী ও সঙ্গীতযোদ্ধাদেরও কিছু করার আছে- সেই ভাবনা থেকেই মূলত অবসকিওরের এই বদলে যাওয়া- এমন কথাই বলেন ব্যান্ডের প্রতিটি সদস্য। যেজন্য প্রেম, বিরহ, যাপিত জীবনের গল্পের পাশাপাশি দেশের সূর্যসন্তানদের নিয়ে গান করে যাচ্ছেন। সে গানগুলোকে বলা হচ্ছে অবসকিওরের দেশ সিরিজের গান। সেই তালিকায় থাকা 'দেশ ছাড় রাজাকার', 'স্বাধীনতার বীজমন্ত্র', 'পরোয়ানা', 'পিতা', 'স্টপ জেনোসাইড', 'ক্র্যাক প্লাটুন', 'তিস্তা' গানগুলোয় উঠে এসেছে যুক্তিযুদ্ধের চেতনা, একাত্তরের দালালদের বিরুদ্ধে হুমকি, মানবতার কথা, জাতির পিতা এবং দেশের সূর্যসন্তানদের দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের ইতিবৃত্ত। সদ্য প্রকাশিত 'টিটোর স্বাধীনতা' অ্যালবামও কি একই চিন্তাধারা থেকে তৈরি করা? এর উত্তরে সাঈদ হাসান টিপু বলেন, 'হ্যাঁ, একাত্তরের ইতিহাস খুঁড়ে আমরা এবার পেয়েছি এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের কথা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল সে। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুই দিন পর সাভারে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ হরিয়েছিল। তার কমান্ডার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর শহীদ টিটোকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। নাম ছিল 'টিটোর স্বাধীনতা'।

মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছেই তার বীরত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত শুনেছি। শোনার পর মনে হয়েছে, দেশের এই সূর্যসন্তানকে নিয়ে আমাদেরও কিছু করার আছে। সে ভাবনা থেকে 'টিটোর স্বাধীনতা' নামের একটি গান তৈরি করা। সেই সঙ্গে এই গানের শিরোনাম দিয়েই অবসকিওরের ১৩তম অ্যালবামের নামকরণ। এর পাশাপাশি অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদকে নিয়েও 'সুরের বরপুত্র' নামের একটি গান করেছি আমরা। জি-সিরিজ ও অবসকিওরের নিজস্ব চ্যানেলে প্রকাশিত এই অ্যালবামে আরও আছে 'নিরুদ্দেশ', 'যাও নিয়ে যাও', 'রঙিন শাড়ি', 'দুঃখ তোমার যত', 'নস্টালজিয়া' ও 'আমার কিসের ভয়' শিরোনামের ছয়টি গান। কবি মহাদেব সাহা, লুৎফর রহমান রিটন, মিলটন হাসনাত, অমিত গোস্বামী, সোনিয়া স্নিগ্ধা ও মাহমুদ আকাশের লেখা গানগুলোর সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন ব্যান্ডের সদস্যরা। গান শুধু বিনোদনের জন্য- এই কথা আমরা বিশ্বাস করি না। অবশ্যই বিনোদনের জন্য মানুষ গান শুনবে। কিন্তু সেই গান যতটা শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করবে- ততটাই যেন বাস্তবতার উপলব্ধি করার সুযোগ এনে দেয়। কারণ গান হতে পারে সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার, গানের মাধ্যমেই তুলে ধরা যেতে পারে ইতিহাসের কঠিন বাস্তবতা, অধিকার আদায়ে গণজাগরণ তুলে ধরতে পারে গান, আর পারে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা সূর্যসন্তানদের অবদানের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে। সে ভাবনা থেকেই আমরা গান করে যাচ্ছি এবং যতদিন অবসকিওর থাকবে ততদিন এ ভাবনা থেকেই গান করে যাবে।'

মন্তব্য করুন