বিশ্ব যখন নতুন প্রযুক্তি আবিস্কারে মুখিয়ে এবং নতুন সব প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নয়নের অভিযাত্রায় অদম্য, তখন বাংলাদেশের মতো ছোট্ট দেশটাও প্রযুক্তির দারুণ সম্ভাবনায় এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারে। তাই আমাদের দেশের তরুণ ছেলেমেয়েরাও এই স্বপ্নকে সত্যি করতে প্রযুক্তির উৎকর্ষে নিজেদের শক্তি সামর্থ্য জানান দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী। প্রযুক্তির প্রতিযোগিতামূলক এই জগতে বাংলার তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ঝালিয়ে নিচ্ছেন নানা সব আবিস্কারের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ডিজিটাল ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশের সব ক্ষেত্রেই চাই উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া। আর দেশের সব ক্ষেত্রে না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ছোঁয়া দিচ্ছেন তরুণ বিজ্ঞানীরা, যা ক্ষেত্রবিশেষ কাজগুলোকে সহজ থেকে সহজতর করছে। সে রকম একজন তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তিগত নানা ধরনের অ্যাপ নির্মাতা জুবায়ের হোসেন।

জুবায়ের হোসেন বাংলাদেশকে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা উদ্যোক্তা হওয়ার সম্মান। ইতোমধ্যে বানিয়ে ফেলেছেন বেশ কয়েকটি অ্যাপ, যা কিনা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে। দেশকে ডিজিটালাইজেশন করতে এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভ্যাট চেকার, টপ টিউব, সিএনজি মিটার, ডিএসসি অ্যালার্ম ইত্যাদি অ্যাপস তৈরি করে মানুষের সমস্যার সমাধান দিচ্ছেন ডিজিটাল উপায়ে। জনপ্রিয় দুটি অ্যাপ ভ্যাট চেকার ও টপ টিউবের কার্যক্রম পৃথিবীব্যাপী প্রসারিত হয়েছে। জুবায়ের নতুন অ্যাপ 'মাই কোর্ট'-সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া।

একাধিক অ্যাপ তৈরি করে জনসাধারণের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রতিভাবান তরুণ উদ্যোক্তা জুবায়ের হোসেন। কলেজ পালিয়ে সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেটে প্রোগ্রামিং শিখতেন তিনি। কলেজ পার হতে না হতেই সি প্রোগ্রামিং রপ্ত করেছিলেন জোবায়ের। মাত্র ১৬ বছর বয়সে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা এই তরুণ প্রযুক্তিবিদ বেশ অল্প বয়সেই সফলভাবে বাংলাদেশের আইটি সেক্টরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে ভর্তি হয়েই সাধারণ মানুষকে আইনি সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করেন 'ল সাপোর্ট' নামক একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন। টিউশনির টাকা দিয়ে জুবায়ের এ অ্যাপটি তৈরি করেছিলেন। তার উদ্ভাবিত 'ভ্যাট চেকার' অ্যাপ দেড় বছরে বাংলাদেশ সরকারকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তার একটি মোবাইল অ্যাপ 'টপ টিউব' মাত্র দুই বছরে বিশ্বব্যাপী ২৫ লাখ ব্যবহারকারী ছাড়িয়ে যায়। এ ছাড়া আরও অনেক উদ্ভাবনী কাজের মাধ্যমে দেশব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছেন এ তরুণ অ্যাপ নির্মাতা।

তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জুবায়েরের নতুন অ্যাপ 'মাই কোর্ট' সফটওয়্যারটির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে লেগেছে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া।

সম্প্রতি গুগল প্লে স্টোরে মুক্তি পেয়েছে তার 'মাই কোর্ট' নামে একটি অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে বংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রায় ১৭ হাজার আইনজীবী খুদেবার্তা এবং নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তাদের মামলার আপডেট পাবেন। এ ছাড়া কজ লিস্টের চলমান আইটেম, প্রতিদিনের মামলার ফলাফল দেওয়াসহ নানা সুবিধা রয়েছে অ্যাপটিতে, যেগুলো আরও বেশি গতিশীল করবে আইনজীবীর কাজ। এই উদ্যোগে জুবায়েরকে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বারের শিক্ষানবিশ আইনজীবী মাহমুদ লস্কর।

'মাই কোর্ট' অ্যাপটিতে ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজন আইনজীবীর একাধিক মামলা পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। ঘরে বসে যত খুশি মামলা নম্বর সংযুক্ত করা যাবে মোবাইল অ্যাপেই। মামলার যে কোনো আপডেট আইনজীবীদের মুঠোফোনে খুদেবার্তা এবং নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় অ্যাপটি। এই অ্যাপ সম্পূর্ণ ফ্রি ডাউনলোড করা যাবে িি.িসুপড়ঁৎঃ.ধঢ়ঢ় এই ঠিকানা থেকে।

অ্যাপটির বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসান কবীর শাহীন জানিয়েছেন, অ্যাপটি তিনি ব্যবহার শুরু করেছেন এবং এই অ্যাপ আইনজীবীদের জন্য চমৎকার একটি উদ্ভাবন। অ্যাপটির নির্মাতা জুবায়ের হোসেন বাংলাদেশের নানা সেক্টরের সমস্যা নিয়ে উদ্ভাবনীমূলক কাজ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

জুবায়ের হোসেন এরই মধ্যে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন জাতীয় মোবাইল অ্যাপস অ্যাওয়ার্ড, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা উদ্যোক্তা সম্মাননা, ব্র্যাক আয়োজিত মন্থন ডিজিটাল ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি এপিকটা অ্যাওয়ার্ড, ভিয়েনাতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড সামিট অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। প্রতিষ্ঠা করেছেন 'জুবায়ের অ্যাপ একাডেমি', যার মাধ্যমে তরুণদের আইটিতে ক্যারিয়ার গড়তে দিকনির্দেশনা এবং অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন গত চার বছর ধরে। এতে অনেক তরুণ আইটি সেক্টরে দক্ষ হয়ে অনায়াসেই করে নিচ্ছেন কর্মসংস্থান। আর এ প্রসঙ্গে জুবায়ের বলেন, 'আমার প্রশিক্ষণে কারোর কর্মসংস্থান হওয়াটা আমার জন্য একটা প্রাপ্তি। আমি এভাবেই দেশের পক্ষে, দেশের জনগণের পক্ষে, মানব কল্যাণে দক্ষ জনশক্তিকে নিয়ে প্রযুক্তি খাতে কাজ করে যেতে চাই।'

জুবায়ের হোসেনের জন্ম ১৯৯৪ সালের ২২ জুন, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার সালিনাবগ্ধা গ্রামে। স্কুল শেষ করেন খুলনা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর পড়াশোনা করেছেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। জুবায়ের বিশ্বাস করেন, তরুণদের কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তাই তিনি একাই নন বরং সব তরুণকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন এ উদ্যোক্তা।

উন্নত দেশ বিনির্মাণে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় তরুণদেরকেই দায়িত্ব নিয়ে দেশের সার্বিক কল্যাণে কাজ করতে হবে। তবেই আমাদের এই সোনার বাংলায় উন্নয়নের ফসল ফলবে। তবে সে ক্ষেত্রে দেশকেও প্রযুক্তি খাতে বাংলার তরুণ সমাজকে সুযোগ দিতে হবে এবং তরুণদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। তবেই দেশটা এ দেশের একাত্তরের বীরের স্বপ্নগুলোকে সত্যি করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অদম্য বাংলাদেশ হবে। সে ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে দায়িত্বটা সমৃদ্ধময় অপার সম্ভাবনাময় তরুণ ক্ষুদে বাঙালিদেরই নিতে হবে।

মন্তব্য করুন