- কালের খেয়া
- ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা
কালের খেয়া
তুমুল গাঢ় সমাচার
ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা
নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৬
[গত সংখ্যার পর]
৫.
তবে ষাটের দশকের কবিতার প্রগতিপন্থা অন্যভাবেও সংক্রমিত হয়েছিল। পঞ্চাশের যুগেই বাম-প্রগতিশীল ধারার সাথে জাতীয়তাবাদী ধারার অন্তর্লীন যোগাযোগ গড়ে উঠতে থাকে। সেটা বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে ষাটের দশকে। এই যোগাযোগ রাজনৈতিক আন্দোলনে যেমন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ক্রমশ এক নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে থাকে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠকদের পক্ষ থেকে সচেতনভাবে 'জাতীয়তাবাদী' ধারার প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী ধারার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য ছিলেন, তাদের মধ্যে শামসুর রাহমানের নাম প্রথমেই চলে আসবে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা শামসুর রাহমানের সাথে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, প্রেরণা জোগাতেন, কোনো বিশেষ দিবস বা উপলক্ষে বাংলার এই প্রতিভাবান কবি যাতে কবিতা লেখেন, সে সম্পর্কে সচেতন প্ররোচনা ছিল তাদের।
যে কোনো কারণেই হোক, 'ভালবাসার সাম্পান' বইতে শামসুর রাহমানের প্রসঙ্গ আসেনি। এর একটি কারণ হতে পারে, পঞ্চাশের দশকের কবি হিসেবে তার অভ্যুদয়। তবে ঘনিষ্ঠ বিচারে শামসুর রাহমানকে ছাড়া ষাটের কবিতায় আধুনিকতার নির্মাণ ও পুনর্জাগরণের বিষয়টি আলোচনা করা প্রায়-অসম্ভব। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে'। সে হিসেবে, বাংলা কবিতার ষাটের দশক তার হাত দিয়েই শুরু। বস্তুত, ষাটের দশকেই বের হতে থাকে সাড়া-জাগানো তার একের পর এক কাব্যগ্রন্থ :রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৬), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮) ও নিজ বাসভূমে (১৯৭০)। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় লেখা 'বন্দীশিবির থেকে' (১৯৭২) থেকে পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে যে গোটা ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি-সংগ্রাম তার কবিতার মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে গ্রন্থিত হয়ে এসেছে। রৌদ্র করোটিতেই তিনি লিখেছেন 'লালনের গান'; রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন কবিতা যখন তার গানকে বেআইনি করা হয়েছে; ভাষা আন্দোলন ও বাংলা কবিতার অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে সমর্থন করে লিখেছেন বিধ্বস্ত নীলিমার 'বাংলা কবিতার প্রতি'; আয়ুব শাহীর স্বৈরাচার শাসনের ছায়ায় লিখেছেন নিরালোকে দিব্যরথের 'সকল প্রশংসা তার'; রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে মনে রেখে লিখেছেন 'টেলেমেকাস'; গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে লিখেছেন নিজ বাসভূমের এক ঝাঁক প্রতিবাদী কবিতা- 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা', 'ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯', 'পুলিশ রিপোর্ট', 'হরতাল', 'আসাদের শার্ট', 'ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা', 'কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি', 'কবিয়াল রমেশ শীল', 'কী যুগে আমরা করি বাস', 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়', 'এ যুদ্ধের শেষ নেই', অথবা 'আমি কথা বলাতে চাই'। ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম শামসুর রাহমানের অন্তরঙ্গে-বহিরঙ্গে যেমন অনুভবযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল, তেমনি এসব আন্দোলন-সংগ্রাম নিছক রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে আটকে না থেকে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আইডেনটিটি বা আত্মসত্তা খুঁজে পেয়েছিল তার ও তার সহযাত্রীদের কবিতা-গানের মাধ্যমে।
এইসবই পুরোনো, বহু-চর্চিত প্রসঙ্গ। রাজনীতি ও সংস্কৃতি এ দুইয়ের মধ্যে ইতিহাসের গভীর এরিয়েলে অলক্ষ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে যায়। শামসুর রাহমানের ষাটের দশকের লেখায় ক্রম-বাড়ন্ত রাজনৈতিক, এমনকি শ্রেণি-সচেতনতার যে লক্ষণ দেখতে পাই তার কারণ নিহিত ছিল সে সময়ের পরিবেশে, হাওয়ায়, এমনকি দেয়াল-লিখনে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝি স্পষ্ট হয়। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কবির সাথে দেখা হলে আমি বলি যে আমার বহুদিনের ইচ্ছা যে তিনি যেন সেজার ভায়েহোর একটি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ভায়েহোর কোন কবিতাটির কথা বলছেন? কবিতাটির নাম শুনে তিনি বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বললেন, আপনি হয়তো জানেন না, এই কবিতাটির আদলে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম ষাটের দশকেই, আমার নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থে সেটি আছে। অস্বীকার করব না যে আমি কিছুটা পরিমাণে চমকে উঠেছিলাম। ষাটের দশকের কবি-সাহিত্যিকেরা যারা এ দেশের নব-জাগরণের অধ্যায় নীরবে সৃষ্টি করেছিলেন তাদের পঠন-পাঠনে কোনো খামতি ছিল না। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টির সাথে তাদের যেমন পরিচিতি ছিল, প্রগতিবাদী সাহিত্যের সাথেও তাদের যোগসূত্র ছিল নিবিড়। পেরুর কবি সেজার ভায়েহো মার্কসবাদে অনুপ্রাণিত কবি ছিলেন, ১৯২৮ ও ১৯২৯ সালে পরপর দু'বার তিনি রাশিয়ার নতুন নির্মাণ দেখতে যান, ১৯৩১ সালে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, ১৯৩৬-৩৯ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে তিনি দু'বছর সক্রিয় অংশ নেন জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বাহিনীর বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের অংশ হয়ে। ১৯৩৮ সালে প্যারিসে ৪৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আমি ভেবেছিলাম যে শামসুর রাহমানকে আমি তার সম্ভাব্য অজানা কোনো এক কবির সম্পর্কে আগ্রহোদ্দীপক তথ্য দিচ্ছি। অথচ প্রায় তিন দশক আগেই কবি সেজার ভায়েহো সম্পর্কে জেনেছেন; শুধু জেনেছেন নয়, তার কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের এক শ্রেষ্ঠ কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলাদেশের ষাটের দশকের নব-জাগরণের এমনি ছিল গভীর মানবিক নির্মাণ, যা দেশ-মাটির জলে শেকড় ছাড়লেও অতিক্রম করে গিয়েছিল দেশ-কালের গণ্ডী।
সেজার ভায়েহোর কবিতাটি ছিল এ রকম :
I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in ParisÑ and I don’t step asideÑ
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.
It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.
Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also
with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads... I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in ParisÑ and I don’t step asideÑ
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.
It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.
Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also
with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads...
বিষণ্ণ, অতি-ব্যক্তিক, অমোঘ পরিণতির দিকে ধাবমান, কবি-জীবনের সায়াহ্নকালীন এই উচ্চারণ তরুণতর শামসুর রাহমানের হাতে পড়ে এক অন্য রূপ পেয়েছিল। 'নিজ বাসভূমে' কাব্যগ্রন্থের 'বিবেচনা' কবিতাটির অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি (পাঠক, পুরোটা পড়ে নেবেন, এই ভরসা রাখি) :
'সেদিনও কি এমনি অক্লান্ত ঝরঝর বৃষ্টি হবে এ শহরে?
ঘিনঘিনে কাদা
জমবে গলির মোড়ে সেদিনও কি এমনি,
যেদিন থাকব পড়ে খাটে নিশ্চেতন,
নির্বিকার, মৃত?
আলনায় খুব
সহজে থাকবে ঝুলে সাদা জামা। বোতামের ঘরগুলো যেন
করোটির চোখ, মানে কালো গহ্বর। জুতো জোড়া
রইবে পড়ে এক কোণে, যমজ কবর। কবিতার
খাতা নগ্ন নারীর মতোই চিৎ হয়ে
উদর দেখিয়ে
টেবিলে থাকবে শুয়ে আর দেয়ালের টিকটিকি
প্রকাশ্যেই করবে সঙ্গম।
যেদিন মরব আমি, সেদিন কি বার হবে, বলা মুশকিল।
শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?
যেবারই হোক,
সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা
না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে, পথঘাট,
পুণ্যবান শবানুগামীরা বড় বিরক্ত হবেন।'
এই সাক্ষাতের আরও কিছুকাল পরে- ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, এ দেশেও বাম-প্রগতিশীল মহলে নানা জিজ্ঞাসার টানাপড়েন দেখা দিয়েছে- কবির সাথে তার শ্যামলীর বাসায় দেখা হয়েছিল। এসব ভাঙন, বিলুপ্তিবাদ, অস্থিরতা কবির ভালো লাগেনি। বেশ জোরের সাথেই অনুযোগ করেছিলেন, 'এখন তো আর পার্টির থেকে কেউ আমার কাছে আসে না। আগে তারা কত আসতেন, আমাকে দিয়ে তারা কত কবিতা লিখিয়েছেন। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে।'
৬.
এবার বোধহয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। এই প্রবন্ধটিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের 'ভালবাসার সাম্পান' বইটিকে উপলক্ষ করে ষাটের দশকের কবিতা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছি। প্রথমত, বলার কথা ছিল এই যে, ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলন তথা আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রাম এমনিতেই সফলতা পায়নি। 'আন্দোলন' যে 'মুক্তি-সংগ্রামে' পরিণত হয়েছিল তার পেছনে যেমন অর্থনীতিবিদদের গড়া 'দুই-অর্থনীতি' শীর্ষক বৈষম্যের তত্ত্ব যুক্তি-ভিত্তি জুগিয়েছিল ষাটের দশকের শিল্প আন্দোলন, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার আন্দোলনও কাজ করে থাকবে। আধুনিক বাংলা কবিতার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন সাংস্কৃতিক নব-জাগরণের ধারার সাথে যুক্ত হয়েছিল। ষাটের দশকের 'রেনেসাঁ' ছাড়া আমরা বিশ্বতালে তাল রেখে চলা শিখতে পারতাম না, আমাদের সেই বিরল আত্মবিশ্বাসটুকু আত্মস্থ হতো না যেটি না আসলে একটি সংগ্রামরত জাতি জগৎ-সম্মুখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, যেমন পারে না একটি অর্বাচীন বালক ভাব প্রকাশের ভাষাহীন হয়ে সৃষ্টিশীল হতে, শত মেধা থাকা সত্ত্বেও। ষাটের দশকের কবিতার ভুবন, তার শিল্পলোক, সেই বালকটিকে এক মেধাসম্পন্ন জাগতিক সম্ভাবনার একটি আত্মনির্ভর পাটাতন দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে একটি জাতি-নির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায়।
[ক্রমশ]
মন্তব্য করুন