ছেলেবেলা বা মেয়েবেলায় রেলগাড়ির মতো মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ আর কিছু ছিল না। জানালার পাশে বসে চারপাশ দেখতে দেখতে তারপর ঈশ্বরদী ও সান্তাহারে মিষ্টি বা লুচি-তরকারি খাওয়ার স্ট্মৃতি এখনও আমার মনে স্পষ্ট। - যাব কতদূর/ পার্বতীপুর। যে কোনো একটা কিছু ভেবে নিলেই হয়; ট্রেন তা-ই বলতে থাকে। এর পর আছে ডাব, নকুলদানা, ছানার জিলাপি। কাচ দেওয়া বাক্সের ভেতর যে কত রহস্য, তা বলে শেষ করা যায়! স্টিম ট্রেন ছুটছে সশব্দে। যখন সাঁড়ার ব্রিজ বা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ট্রেন চলত, তখন আমার আপা ফিসফিস করে বলতেন- জানিস, এখানে মানে এই ব্রিজের নিচে একশ' ছোট বাচ্চার মৃতদেহ আছে। কেন? আমার প্রশ্ন। ব্রিজ করতে গেলে এমন শিশুবলি দিতেই হয়। সত্য, না মিথ্যা জানি না, বাকি পথ সেসব অচেনা-অদেখা শিশুর জন্য মন গভীরভাবে দুঃখ-ভারাক্রান্ত থাকত। আমার আব্বার নানা এই ব্রিজ দেখে তার নাতি রবি বা আমার বাবাকে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। কারণ তার নাতি কলকাতা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এসব মহৎ কাজ করবে, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে শত শত ব্রিজ বানাবে। সেটা হয়নি।
এই ট্রেন আমরা পেয়েছি ব্রিটেন থেকে। ১৮০৪ সালে ব্রিটেনে প্রথম ট্রেন চালু হয়। কর্নওয়ালের এক ইঞ্জিনিয়ার রিচার্ড ট্রেভিথিক প্রথম ট্রেন চালু করেন। ফ্রান্সে ট্রেন চালু হয় ১৮২৩ সালে। চায়নাতে উনিশ শতকের কোনো এক সময়ে। আর ভারতে প্রথম ট্রেন চালু হয় মাদ্রাজে; ১৮৩৭ সালে। জেমস ওয়াট নামে একজন স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্টিম ট্রেন তৈরি করেন। আমেরিকায় ১৮৩০ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে সব স্টেটে ট্রেন চালু হয়।
ব্রিটেনে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হয় ১৯৬৮ সালে। তবে ন্যাশনাল হেরিটেজ হিসেবে এখনও কোনো কোনো জায়গায় স্টিম ট্রেন চলে।
ব্রিটেনে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন চালু হয় ১৮৬৩ সালে; ১০ জানুয়ারি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অনেকে এই আন্ডারগ্রাউন্ডে স্টেশনে থাকত জার্মানদের বোমা থেকে রক্ষা পেতে।
বর্তমানে সবচেয়ে ব্যস্ত টিউব স্টেশন অক্সফোর্ড সার্কাস। ৯৮ মিলিয়ন যাত্রী সেখানে প্রতিদিন যাতায়াত করে।
টিউব ট্রেনের জন্মের পর তিনটি শিশু আজ পর্যন্ত এই ট্রেনে জন্মগ্রহণ করেছে; ১৯২৪, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে।
আনুমানিক ১৯ হাজার কর্মী টিউব ট্রেনের জন্য কাজ করে। টিউব ট্রেনের কারণে লন্ডনের রাস্তা জনবহুল নয়। প্রায় মানুষই মাটির তলা দিয়ে যাতায়াত করে।
ট্রেনে ধূমপান বন্ধ হয়েছে ১৯৮৭ সালে।
সবচেয়ে ভৌতিক কারবার হয় লন্ডনের ফারিংডন টিউব স্টেশনে। সবাই বলে, এই স্টেশন 'হন্টেড'। কোনো এক নারী নাকি এখানে খুন হয়েছিলেন। তার পর থেকেই ভূতের রাজত্ব।
মস্কো ও প্যারিসের পর লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড সবচেয়ে ব্যস্ত।
মেট্রোপলিটন লাইন রানী ভিক্টোরিয়া ওপেন করেন ১৮৬৩ সালে।
জুলিয়ান লয়েড ওয়েবার ট্রেনে চেলো বাজিয়ে ভিক্ষা করতেন। তিনি হলেন বিলিয়নেয়ার আন্ড্রু লয়েড ওয়েবারের ভাই। কত রকম পাগল যে থাকে!
এখন টিউব স্টেশনের সংখ্যা ২৮৭।
জুবিলি লাইনের এমন নাম হওয়ার কারণ, বর্তমান রানীর সিংহাসনে বসার ৫০ বছর স্ট্মরণ করে।
লন্ডনে এক ধরনের খেলনা ট্রেন চালু হয়েছে। সেগুলো লন্ডনের ডকল্যান্ড এরিয়া নিয়ে। প্রতিদিন সেই ট্রেনে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। একবার এক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, আমি আপনার জন্য 'হিরণ কোয়া'তে অপেক্ষা করব। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন- হিরণ কী। তাদের লেখার জন্য অনেক সময় ভুল উচ্চারণ করা হয়। যেমন হলবর্ন নয়; হবর্ন। যদিও বানান যড়ষনড়ৎহ। এই এলের উচ্চারণ নেই। আমার বাড়ি গ্রিনিচের উলিচে। অনেকে বানানের কারণে বলেন- গ্রিন উইচ আর উল উইচ। কিংবা লেসেস্টার স্কয়ার নয়; লেসস্টার স্কয়ার। এমনি অসংখ্য টিউব স্টেশনের নাম। আস্তে আস্তে সবাই উচ্চারণ শিখে ফেলে।
আরেকটা বড় ট্রেন নেটওয়ার্ক আসছে, যার নাম 'ক্রশ রেল'। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি চালু হবে। বড় বড় অক্ষরে লেখা সেখানে লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশনে যাবেন ৮ মিনিটে এবং এয়ারপোর্টে যাবেন অনেক কম সময়ে। আমরা অপেক্ষা করে আছি।
শুনতে পাচ্ছি, জাপান থেকে বুলেট ট্রেন ব্রিটেনে আসছে। ভারত তো বুলেট ট্রেন চালু করতে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সে কারণে ১২ বিলিয়ন পাউন্ড লোন নিতে হয়েছে জাপানের কাছ থেকে। বুলেট ট্রেনে গুজরাট থেকে মুম্বাই যেতে লাগবে ৩ ঘণ্টা। আগে লাগত ৮ ঘণ্টা।
সবচেয়ে স্বপ্নের ট্রেন হলো 'ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস'। লন্ডন থেকে ভেনিস যায় ও আসে। তিন হাজার পাউন্ড 'পার হেড'। খুব ইচ্ছা আছে, লটারি জিতলে এই ভ্রমণটা করতেই হবে। না হলে যদি কোনো ধনী বন্ধু 'হেল্প' করেন। ট্রেন নয়, যেন স্বপ্নপুরী। পৃথিবীর অনেক রোমান্টিক ঘটনার জন্ম হয়েছে এই ট্রেনের ভেতরে। অনেক সিনেমা, ছোট গল্প, নাটক ট্রেনকে কেন্দ্র করে। 'ডেথ ইন ওরিয়েন্ট' এক্সপ্রেস অবশ্য রহস্য গল্প; রোমান্টিক নয়। তবে সেই নাটক দেখতে দেখতে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের ভেতরটা দেখা যায়। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের রুটটা বেশ বড় ছিল। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে এই ট্রেন কেবল লন্ডন-ভেনিস চলাচল করে। নাম ওরিয়েন্ট সিম্পলটন ট্রেন। আগে ইউরোপের আরও জায়গায় এই ট্রেন যেত; যেমন ইস্তাম্বুল। এখন যায় না। এইটুকু পথ যেতে-আসতে তিন হাজার পাউন্ড! কারও কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বার্মার জঙ্গলে রেললাইন পাততে গিয়ে কী ঘটনা ঘটেছিল, তা জানি। জাপানের মহারাজার আদেশে এই রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছিল। থাইল্যান্ডের বাংগং থেকে বার্মার থানরাজবিরাটে এই লাইন পাতার কাজে কিছু সৈন্য বা শ্রমিকের অমানুষিক ও অক্লান্ত পরিশ্রম চলছিল। মনে আছে, ডেভিড লিনের ছবি 'ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই'? দুই হাজার কিলোমিটার রেললাইন পাতার কাজ। আর এ কাজ করতে গিয়ে কী হয়েছে, সে গল্প আর নতুন করে বলার দরকার নেই। হাজার হাজার সৈন্য আমাশয়, আলসার, অনাহার, অত্যাচারে মারা যায়। সেখানে ভালো ডাক্তার ছিল না। তারা মারা যাওয়ার পর উদোম শরীরে তাদের পুঁতে রাখা হতো। এমন একজন শ্রমিক ছিলেন জ্যাক কিং। তিনি ছিলেন জাপানিদের 'প্রিজনার অব ওয়ার'। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলে বেঁচে ফিরে এসেছিলেন বটে; তবে জীবন তখন তার কাছে কেবল বিবমিষা। ফিরে আসার পর তার শরীরের ওজন হয়েছিল মাত্র ৫০ কিলো। লম্বায় ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। তবে একদিন এই ট্রেন ভ্রমণ এনে দিয়েছিল এক আশ্চর্য উপহার। তিনি জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। একজন নারী। তিনি যে জীবনে আর কখনও কাউকে ভালোবাসবেন বা কোনো নারীর দিকে মুখ তুলে তাকাবেন, ভাবেননি। মেয়েটির কালো চোখ আর এক মাথা চুল দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কথা শুরু হলো। জ্যাক আর অড্রি। কী সুখময় অনুভূতি! দু'জনের ট্রেন প্রায় এসে গেছে। দু'জনেই তখন যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। নারী মুখ ফিরিয়ে হেসে বলেছিলেন- যদি তুমি বল, আমি তোমার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাব।
৫০ বছর সুখে জীবন কাটানোর পর স্ত্রী অড্রি মারা গেলে তিনি নিজেও মারা যেতে চান। তার পরও কোনোমতে বেঁচে ছিলেন। ছবি আঁকাই এখন তার সবচেয়ে বড় শখ। এই তো কিছুদিন আগে ৯৫ বছরের এই বুড়োকে চমৎকার একটি বাগান করে দিয়েছেন অ্যালান টিসমার্স। 'লাভ ইওর গার্ডেন' প্রোগ্রামে। তার কাজই এই। অনেককে তিনি এসব বাগান করে দিয়েছেন। জ্যাক বলেছিলেন- তুমি কী করে জানলে অ্যালান, এমন একখানা বাগানই আমি সেই ভয়ানক রেললাইন পাততে পাততে ভাবতাম! অন্ধকার রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম। সেই ছিল আমার মনের পলায়ন। বড় বড় হিবিসকাস গাছ ঘেরা বড় একখানা অপূর্ব বাগান। যেখানে তিরতির ঝর্ণার জলে আমি আমার মুখের ছবি দেখতে পাব। গাছের ফিসফাস আর শুদ্ধ সৌন্দর্য। অড্রি নেই। রেল স্টেশনে খুঁজে পাওয়া সেই মেয়ে, আমার নতুন জীবন। থাকলে- বাকিটা ৯৫-এর বুড়ো বললেন চোখের জলে।
অনেক রেলস্টেশনের গল্পের ভেতর এটি একটি অসাধারণ গল্প। গল্প নয়, সত্যি।
অসংখ্য ভূতের গল্প আছে রেলগাড়ি নিয়ে। আমারও আছে। একটা ট্রেন চলে গেল, কোনো ড্রাইভার নেই; একটা ট্রেন চলে গেল, কোনো যাত্রী নেই।
একটি 'আলটিমেট' ট্রেন তৈরি করেছিলেন অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবার। নাম 'স্টারলাইট এক্সপ্রেস'। একটা সুপার ট্রেন। তারার রাজ্যে তার অভিসার। স্টেজে এমন জিনিসকে তুলে আনা কঠিন। কিন্তু অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবারের কাছে কঠিন বলে কিছু নেই। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম।
এসব ছাপিয়ে জেগে আছে সান্তাহার স্টেশনে লুচি-তরকারি আর কাচের বাক্সের মিষ্টি। আমার রেলগাড়ি আর সেই উৎসব। আমার মনে হয় না, ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের খাবার সে রকম হবে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে রুপোর প্লেটে খেতে দেবে হয়তো, কিন্তু কলাপাতার প্লেটের সে খাবারের কথা কী করে ভুলে যাই! আব্বা সদয় হয়ে পার্স খুলছেন, আর আমরা ভাবছি ছানার জিলাপি যেন থাকে।
ষব্রিটেন প্রবাসী কথাসাহিত্যিক

মন্তব্য করুন