টানা দু'দিন গভীর আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাতে হয়েছিল আবদুল আলিমের পরিবারের সদস্যদের। সুবর্ণচরের চর মজিদ এলাকার আলিম মাছ ধরতে ধরতে চলে গিয়েছিলেন হাতিয়া পর্যন্ত। সেখান থেকেই জলদস্যু সাইফুল বাহিনী তুলে নিয়ে যায় তাকে। পরে পরিবারের সদস্যরা চড়া সুদে ধার-দেনা করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।

দস্যুবাহিনীর কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর আলিমের সঙ্গে যখন আলাপ হয়, তখনও তার চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক। ফিরে আসার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছেন বলে জানান। জল আর জালের সঙ্গে যার আশৈশব সখ্য, সেই আলিম আবারও মাছ ধরতে যাবেন কি-না জিজ্ঞেস করায় শিউরে উঠলেন। তবে এও জানালেন, মাছ ধরতে না গিয়ে কোনো উপায় নেই তার। নিদারুণ দারিদ্র্যের চিত্র তুলে ধরে আলিম বললেন, 'ডাঙ্গায় বই (বসে) থাইকলে না খাই মইত্তো (মরতে) অইব (হবে)। বউ, হোলা-হাইন্যা (ছেলে-মেয়ে) হাঁচগারে (পাঁচজনকে) লই (নিয়ে) বাঁচুম (বাঁচব) কেন্নে (কেমন করে)?'

আলিমের সঙ্গে কথা বলে আসার দু'দিন পর গত ২১ নভেম্বর জানা গেল, হাতিয়ার বয়ারচরের চতলার ঘাটে র‌্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে'  জলদস্যু বাহিনীপ্রধান সাইফুল ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সফিক নিহত হয়েছে। ফোনে সাইফুল নিহত হওয়ার খবর জানানো হলেও আলিমের প্রতিক্রিয়ায় স্বস্তির কোনো আভাস পাওয়া গেল না। বরং আক্ষেপই ধ্বনিত হলো- দস্যু দলের কমান্ডার মারা যায়; কিন্তু দস্যুতা থামে না। নতুন কমান্ডার আরও উৎসাহের সঙ্গে শুরু করে তাণ্ডব। একপর্যায়ে স্পষ্ট কান্না শোনা গেল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, 'কিস্তি টাইনতে টাইনতে আঁই (আমি) আর হারিয়ের (পারি) না। ঘরে খানা (খাবার) নাই, ওষুধ কিনার টেয়া (টাকা) নাই। মনটা দরিয়াত (সাগরে) হড়ি (পড়ে) রইছে (রয়েছে), কিন্তু ডাকাইতেরগো (ডাকাতদের) কতা (কথা) মনে ওইলে (হলে) যাইতো (যেতে) মন চায় না।'

আলিমকে যেদিন সাইফুল বাহিনী ধরে নিয়ে যায়, সেদিন তার সঙ্গে আরও দুই জেলে ছিলেন নৌকায়। দস্যুকবলিত হওয়ামাত্রই নদী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের রক্ষা করেন ওই দু'জন। মেঘনা উপকূলের সুবর্ণচর-হাতিয়ায় নদীতে এবং সমুদ্রেও দাবড়ে বেড়াচ্ছে জলদস্যুদের অনেক দল। যাদের কাছে হার মানে প্রকৃতির বৈরিতা, নদীর উত্তাল ঢেউ- সেই জেলেদের জিম্মি করে রেখেছে ওই জলদস্যুরা। কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনির বলেন, জলদস্যুতার এই ইতিহাস সুপ্রাচীন। দস্যুতার সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে সুবর্ণচরের সন্তান এই লেখকের রয়েছে 'রক্তেভেজা অববাহিকা' নামে একটি উপন্যাসও। তিনি বলেন, ষাটের দশকে শৈশবের দিনগুলোতে যেমনটা শুনতাম, এখনও তেমনটাই শুনে থাকি, দস্যুরা জেলেদের জিম্মি করে, আদায় করে মুক্তিপণ। জলদস্যুদের অনেকেই এক সময় জেলে ছিল। দস্যুতা ছেড়ে কেউ কেউ আবার মাছ ধরার জীবনে ফিরে আসে। উপকূলের এই জেলেদের জন্য নেই তেমন কোনো সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতাও।

সুবর্ণচরের সবচেয়ে বড় এনজিও সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম সুমনও বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, জেলেদের নিয়ে তাদের স্বতন্ত্র কোনো কর্মসূচি নেই। সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্পে (সিডিএসপি) যুক্ত চারটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার একটি। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল ইফাদ এবং নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত ওই প্রকল্পের ডেপুটি টিম লিডার বজলুল করিম বলেন, 'আমরা চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করছি। দরিদ্র মানুষের আর্থ-সমাজিক উন্নয়নের জন্য ব্র্যাকসহ আমাদের সহযোগীরা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে। ওই ক্ষুদ্র ঋণ হয়তো জেলেদেরও কাজে লাগছে।'

চর নাঙ্গলিয়ার কামাল মাঝি এবারই ইলিশের মৌসুমে সাগরিকা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা কিনেছেন। নদী ও সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে বেশ। তাই নিয়মিত কিস্তি শোধও করতে পারছেন তিনি। কিন্তু আর সবার মতো তারও রয়েছে দস্যুভীতি। পূর্ব চরবাটা গ্রামের হাবিবীয়া এলাকার বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন মিয়া দস্যুদের একটি বাহিনীর সদস্য ছিলেন, কিন্তু মাছ ধরায় ফিরে নিজেই এখন দস্যুদের ভয়ে দিন কাটান। দস্যু নির্মূল অভিযানের পর নিজাম আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সাজা ভোগের পর মুক্তি পেয়ে এখন সব ছেড়ে সৎ জীবন যাপনের চেষ্টা করছেন। জীবিকার তাগিদে তিনি ১০-১২ জেলেকে নিয়ে নদীতে মাছের ট্রলার নামান। ভালো চলছিল সব, কিন্তু গত ১৪ আগস্ট স্বর্ণদ্বীপ নামে পরিচিত হাতিয়ার জাহাইজ্যার চরের দক্ষিণে কেলার খাল সংলগ্ন মেঘনা নদীতে তার ট্রলারে জলদস্যুরা হামলা চালায়। এ সময় তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরে জেলেদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে মালসহ নৌকাটি নিয়ে যায় দস্যুরা। এখনও ওই নৌকাটি ফেরত পাননি তিনি। তবে অন্য একটি নৌকা কিনে নতুন করে মাছ ধরতে নেমেছেন পুরনো জেলেদের নিয়ে।

নদী বা সাগরে মাছ ধরতে প্রতিটি জেলে নৌকাকেই টাকার বিনিময়ে নিতে হয় জলদস্যুদের কার্ড। প্রতি মৌসুমে তিন-চার মাসের জন্য মাছ ধরতে জেলেদের ট্রলারপ্রতি বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। ট্রলারবিশেষে চাঁদার পরিমাণ ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। শীত ও বর্ষা দুই মৌসুমেই চাঁদা দিতে হয়। বর্তমানে মেঘনা নদীতে হাতিয়ার সৌরভ ওরফে কাল্লু বাহিনী ও সন্দ্বীপের সেলিম বাহিনী দস্যুতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বলে জেলেদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল। হাতিয়ার অন্য দুটি দস্যু দলের একটি হলো রামচরণ এলাকার আলাউদ্দিন বাহিনী। ঘাসিয়ার চরের খোকন বাহিনীর খোকন মাস দেড়েক আগে গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকলেও দস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে তার দলের লোকজন। নিঝুমদ্বীপের রাশেদ নামে একজন মাঝে মধ্যেই দলবল নিয়ে জেলে নৌকায় হামলা চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কোস্টগার্ডের হাতিয়া স্টেশন কমান্ডার সাব-লে. অনিক বলেন, জলদস্যু দমনে আমরা প্রতিদিনই সাগরে টহল দিচ্ছি। যখনই কোথাও দস্যুতার কোনো খবর পাই, সঙ্গে সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করি। ইদানীং দস্যুতার ঘটনা কমেছে বলেও দাবি করেন তিনি। র‌্যাব-১১-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলেপ উদ্দিন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় জলদস্যুদের উপদ্রব কম বলে দাবি করেন। তবে তিনি বলেন, 'এখনও দু-একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের দমনে আমরাও অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এরই মধ্যে কালাম চৌধুরী ও গুটি বাবলু র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে। চলতি নভেম্বরে মাসের একদিন আমরা খবর পাই সাইফুল বাহিনী পাঁচ জেলেকে অপহরণ করেছে। পরে এক অভিযানের সময় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল বাহিনীর সাইফুলসহ আরও একজন নিহত হয়।' তার দাবি, এখনও যারা দস্যুতা ছাড়েনি, তারাও রেহাই পাবে না।

মন্তব্য করুন