'সত্তরের গোর্কির তুলনায় একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি একটু বেশিই ছিল'- এ তথ্য জানানোর পর সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আনম সেলিম বলেন, 'অথচ ১৯৭০ সালের তুলনায় ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক কম।' তার মতে, আগাম সতর্কতা এবং উপকূলের মানুষকে নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নিয়ে যেতে পারায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ কম হওয়ার আরও একটি প্রধান কারণ ছিল উপকূলীয় বনভূমি। সত্তরের পর দুই দশক ধরে উপকূলজুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল যে বন, সেই বন বুক পেতে রক্ষা করেছিল নোয়াখালীর উপকূলীয় জনপদকে।

সত্তরে খায়রুল আনম সেলিম ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। একানব্বইয়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ এবং সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেল, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সরকারি হিসাবে এতে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যান। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি।

একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার। ওই ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৩৮ হাজারের মতো। খায়রুল আনম সেলিমের সঙ্গে যখন  কথা হয়, তখন উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে উপস্থিত সুবর্ণচরের লোকজন বনের জন্যই একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ে তারা অনেক নিরাপদ ছিলেন বলে জানালেন। সত্তরের গোর্কির পর বাড়ি পৌঁছাতে দু-একদিন সময় লেগেছিল সেলিমের। কোমরসমান পানি মাড়িয়ে গ্রামে এসে দেখেন, বিরানভূমিতে গাদাগাদি করে পড়ে আছে মানুষ আর গবাদি পশুর মৃতদেহ। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই উপকূলজুড়ে শুরু হয় বৃক্ষরোপণ। অবশ্য ম্যানগ্রোভ (শ্বাসমূলীয়) বনের অনেকটা ছিল প্রাকৃতিকও; পাখির ঠোঁটে এবং নদীর পানিতে ভেসে আসা বীজ থেকে চরে জন্মানো গাছও দুর্যোগে ঢাল হয়ে রক্ষা করেছে তাদের। তার দাবি, উপকূলের এই বিশাল বন উজাড় করা শুরু হয়েছে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর। মাত্র কয়েক বছরে পুরো উপকূলীয় বন নেই হয়ে গেছে।

অবশ্য এ ব্যাপারে নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সে সময়কার সংসদ সদস্য ও বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি বনদস্যুদের উত্থান নয়, বরং ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর চরাঞ্চলকে দস্যুমুক্ত করেছে। নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে সুবর্ণচর ও সংলগ্ন হাতিয়ার চরগুলোতে বন কাটা শুরু হয় মূলত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। সেলিম রাজনৈতিক কারণে সত্যকে মিথ্যা বলে প্রচার করছেন। বনদস্যু বাশার মাঝি, নইব্যা চোরা, শফি বাতাইন্যাদের উত্থান আওয়ামী লীগের মদদে। যে সেলিম এখন বন উজাড়ের জন্য বিএনপিকে দায়ী করছেন, সেই সেলিমও বন উজাড়ের দায় এড়াতে পারেন না। তিনি তখন সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। বনদস্যুদের অধিকাংশই তার দলের সদস্য এবং ব্যক্তিগতভাবে তার অনুসারী। বোরহান শিকদার তার পাশের বাড়ির ছেলে। দস্যুরা সেলিম সাহেবের নামে চরের হাটবাজারের নামকরণও করেছে।

পরে ফোনে এ অভিযোগ নিয়ে খায়রুল আনম সেলিমের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও শাহজাহানই ছিলেন নোয়াখালী সদর ও সুবর্ণচরের এমপি। সুবর্ণচরের সবারই জানা আছে, দস্যুদের মদদদাতা কারা? দস্যুরা তার নামে চরের হাটবাজারের নামকরণ করেছে- এমন অভিযোগের উত্তরে আনম সেলিম বলেন, 'দস্যুরা নয়, এলাকাবাসী ভালোবেসে আমার নামে একটি বাজারের নামকরণ করেছে। শুধু আমার নামেই নয়, আমার নানার নামে আনসার মিয়ার হাট ও ছেলের নামে জুবায়ের মিয়ার হাট নাম রাখা হয়েছে। বাবার নামে আছে একটি স্কুল। এ সবই করা হয়েছে চরে দস্যুতা শুরুর আগে।' তার দাবি, তিনি সহযোগিতা না করলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর মোহাম্মদ শাহজাহান বনদস্যুবিরোধী যে অভিযান পরিচালনা করেছেন, তা সফল হতো না।

মোহাম্মদ শাহজাহানও বনদস্যুবিরোধী অভিযানে আনম সেলিমের সহযোগিতা পাওয়ার কথা অস্বীকার করেননি। তবে তিনি এ-ও বলেন, '২০০৩ সালের শেষের দিকে সবাইকে নিয়ে দস্যু নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিলে সেলিম তাতে রাজি ছিলেন না। পরে দস্যুদের নির্যাতনের শিকার মানুষের চাপে সেলিম বাধ্য হয়ে অভিযানে যুক্ত হন।' শাহজাহানের দাবি, দস্যু নির্মূল অভিযানের কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন তিনি। নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের তিনবারের এই সাবেক সাংসদ বলেন, নির্মূল অভিযানের সময় বাশার মাঝিসহ কিছু দস্যু পালিয়ে গিয়েছিল। পরে এ দস্যুরাই ফিরে এসে তাদের পুরনো দল আওয়ামী লীগের পক্ষে কেন্দ্র দখল করে সিল মেরেছে। অবশ্য এরপরও বনদস্যুদের শেষ রক্ষা হয়নি, বাশার মাঝিসহ কয়েকজন দস্যু 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা গেছে। তবে এখন সরকারি দলের ভদ্রবেশী রাজনীতিবিদরা বন উজাড় হয়ে যাওয়া চরের জমি দখল করছেন এবং তাই নতুন করে বনায়নও হচ্ছে না বললেই চলে।

বনায়ন হচ্ছে না এমন অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবি করেন চর উন্নয়ন ও বসতি নির্মাণ প্রকল্পের (সিডিএসপি) সামাজিক বনায়ন উপদেষ্টা মো. রবিউল ইসলাম। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল ইফাদ এবং নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত সিডিএসপি ভূমি বন্দোবস্ত, পানি ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ, কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে বনায়ন নিয়েও কাজ করছে। রবিউল ইসলাম জানান, বন উজাড় হওয়ার পর এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। তবে প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে এসে শুধু চরের পথের ধারেই দুই হাজার ২৬৮ কিলোমিটার বনায়ন করা হয়েছে। খালপাড়ের বন আছে ৮০ কিলোমিটারের মতো। জেগে ওঠা নতুন চরে করা ম্যানগ্রোভ বনের পরিমাণ সাত হাজার ৪০০ হেক্টর। বেড়িবাঁধের ভেতরে ও বাইরে করা বনায়নের পরিমাণ ২৮৭ হেক্টর।

সরকারের যে ছয়টি বিভাগ সিডিএসপি বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত, বন বিভাগ তার একটি। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নোয়াখালী উপকূলের নদীর মোহনায় এক লাখ ৫০ হাজার একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হয়, যা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬৭-৬৮ অর্থবছর থেকে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় বনের কারণে জানমালের ক্ষতি কম হলেও বন কমে যাওয়ায় এখন আবার আশঙ্কা বেড়েছে।

সুবর্ণচরের সন্তান ও কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনির বলেন, বৈশ্বিক উষষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণে নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চল এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। চর দখল ও চরের দস্যুতা নিয়ে দুটি বইয়ের লেখক নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, উপকূলীয় এলাকার বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় এই ঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণে। বিরান হয়ে যাওয়া চরাঞ্চলে সামাজিক বনায়ন করা না হলে গোটা নোয়াখালী উপকূলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'বন বিভাগের এক লাখ ৫০ হাজার একর ভূমির মধ্যে ৭২ হাজার একর ভূমি আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিয়েছি। বাকি ৭৮ হাজার ভূমি বন বিভাগের অধীনে আছে।' নোয়াখালী উপকূলে বনায়নের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে বন বিভাগের একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এটি বাস্তবায়ন হলে ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস পাবে। তবে উজাড় হয়ে যাওয়া যেসব বনভূমিতে জনবসতি গড়ে উঠেছে, সেগুলোতে বন বিভাগের এখন আর কিছুই করার নেই।'

উজাড় হয়ে যাওয়া চরে বনাঞ্চলে এখন ৫০ হাজারের বেশি ভূমিহীন পরিবার বসবাস করছে- স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। এসব পরিবারের লোকসংখ্যা তিন লাখের বেশি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চরের বন দখলদারদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা যেমন আছেন, তেমনি আছেন ব্যবসায়ী, শিক্ষক এবং সরকারি চাকরিজীবীও। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দখলদারদের মধ্যে রয়েছেন- বাহার মিয়া, ইকবাল মাহমুদ, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, আবদুল মঈদ, শাহজাহান, মফিজুর রহমান, শহীদউল্লাহ, কামরুজ্জামান, নিজাম উদ্দিন, আবুল বাশার, মোহাম্মদ নাছের, জিল্লুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম, রাফাতুন নূর, আশিবা নগর ফিশারিজ, সিমপ্রাক ওয়ান মৎস্য খামার, নাজমুল হাসান, মোজাম্মেল হোসেন, আবুল কালাম আজাদ, দক্ষিণবঙ্গ এগ্রো ফিশারিজ, ছালামাবাদ এগ্রো ফিশারিজ, আবু তাহের, মমিন উল্যা, সালাম এগ্রো ফিশারিজ, মাহমুদা বেগম, নেছার আহম্মাদ, মোসাম্মৎ সেলিনা, জসিম উদ্দীন, দেলোয়ার হোসেন, আবু বকর সিদ্দিক, আবদুল কাইউম, নুরুল আমিন, বেলায়েত হোসেন, কামাল উদ্দিন, খায়রুল হাসান শাহীন, মিজানুর রহমান, মেসার্স নাসির ফিশারিজ ও শাহ আলম। খালে বাঁধ দিয়ে সাড়ে ১৯ একর জমির ওপর চরমজিদে মো. আলাউদ্দিনের আলাউদ্দিন মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী সুবর্ণচর খায়রুল আনম সেলিমের নামে-বেনামে দখলে নেওয়া চরমজিদের ২৬ একর জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ৩০৩ নম্বর মৌজার এই জমিতে গড়ে উঠেছে তানিশা এগ্রো ফিশারিজ। সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা ফজলে এলাহীর ফজিলত এগ্রো ফিশারিজ গড়ে উঠেছে ৩০০ নম্বর মধ্য চরবাগ্গা মৌজায়। ২০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এ প্রকল্পের গোটা জমিই সরকারি। অন্যদিকে ৩০২ নম্বর চরবাজ্ঞগ্গা মৌজায় ফজলে এলাহীর আত্মীয় ও আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হোসেনের মৈত্রী এগ্রো ফিশারিজের দখলে আছে ২৬৯ একর জমি। একই মৌজায় বিএনপির নেতা নুরু নবীর মৎস্য প্রকল্প গড়ে উঠেছে ৪৫ একর জায়গা দখল করে। এভাবে আরও ছোট-বড় অনেক মৎস্য প্রকল্প আছে, যার পুরোটাই সরকারি খাসজমি।

আগামীকাল : ডাঙায় ক্ষুধা জলে দস্যু

মন্তব্য করুন