মানবজাতির ভাগ্য নির্ভর করছে আমেরিকা এবং চীনের একসঙ্গে চলার ওপর। তবে এ বিষয়ে একটা উপায় খুঁজে পেতে তারা–কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যেভাবে এগোচ্ছে– বড়জোর পাঁচ থেকে দশ বছর সময় পাবে। যুদ্ধ এড়াতে হলে প্রথমে চীনের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার কারণগুলো বুঝতে হবে। বহু চীনা চিন্তাবিদ বিশ্বাস করেন যে, আমেরিকা একটি নিম্নগামী স্রোতে রয়েছে এবং এ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় তারা শেষ পর্যন্ত আমাদের স্থান দখল করবে। পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা যতই নিজেদের একটি বৈশ্বিক নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার প্রবক্তা মনে করুন, চীনারা মনে করেন নিয়মগুলো যেমন আমেরিকার তৈরি, তেমনি ব্যবস্থাটাও আমেরিকারই তৈরি। পশ্চিমারা যখন বলেন যে, চীন তাঁদের কথামতো চললে বিশেষ কিছু সুবিধা দেওয়া হবে, তখন চীনা শাসকরা এতে অপমানিত বোধ করেন; তাঁরা বরং মনে করেন, একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে এসব সুবিধা তাদের এমনিতেই প্রাপ্য। প্রকৃতপক্ষে, চীনের কেউ কেউ এও সন্দেহ করে যে, আমেরিকা কোনোদিন তাদের সমকক্ষের মর্যাদা দেবে না; এমন বিশ্বাসকে তারা বোকামি বলেও মনে করে। ওয়াশিংটন যখন বলে, চীন বিশ্ব আধিপত্য চায়..., আমি তখন বলি চীন আসলে শক্তিশালী হতে চায়। তারা হিটলারীয় অর্থে বিশ্ব আধিপত্যের দিকে যাচ্ছে না; এ ধরনের আধিপত্যের ভাবনা চীন কস্মিনকালেও ভাবে না।

নাৎসি জার্মানিতে যুদ্ধ অনিবার্য ছিল, কারণ এডলফ হিটলারের তা প্রয়োজন ছিল; কিন্তু চীন ভিন্ন। মাও সে তুং থেকে শুরু করে অনেক চীনা নেতার সঙ্গে আমার দেখা  হয়েছে; তাদের আদর্শনিষ্ঠা নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই; এবং এটি বরাবরই তাদের দেশের স্বার্থ এবং সক্ষমতা বিষয়ে গভীর অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত। চীনা ব্যবস্থা মার্কসবাদের চেয়েও অনেক বেশি কনফুসিয়ানিজম ঘেঁষা বলে আমার মনে হয়েছে। চীনা নেতারা চান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় তাঁদের স্বার্থের বিচারক তাঁরা নিজেরাই হবেন। প্রশ্ন হতে পারে, যদি চীনারা কোনো দিন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন, তা কি তাঁরা বিশ্বব্যবস্থার ওপর চীনা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করবেন? আমি জানি না; তবে আমার মন বলছে, না তাঁরা তা করবেন না। আর করলেও কূটনীতি ও শক্তি ব্যবহার করে আমরা তা মোকাবিলা করতে পারব।

চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে একটি স্বাভাবিক মার্কিন প্রতিক্রিয়া হতে পারে দুটি শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উপায় অনুসন্ধান করা। আরেকটি হলো চীন ও আমেরিকার মধ্যে স্থায়ী সংলাপ প্রতিষ্ঠা করা। উভয়পক্ষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ আছে এমন কিছু লোক নিয়ে একটা ছোট উপদেষ্টা দল গঠিত হোক, যাঁরা কাজ করবেন গোপনে। কোনো পক্ষই তাইওয়ানের ওপর তার অবস্থানকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করবে না; আমেরিকা সেখানে তার বাহিনী মোতায়েন করতে পারে, তবে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, এর লক্ষ্য কখনোই দ্বীপটির স্বাধীনতা নয়। আমি মনে করি, তাইওয়ান এমন কয়েকটি ক্ষেত্রের মধ্যে একটি যেখানে পরাশক্তিদের পক্ষে সাধারণ স্থল (কমন গ্রাউন্ড) খুঁজে পাওয়া সহজ এবং তাই তা বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে।

কিছু আমেরিকান বিশ্বাস করে যে, পরাজিত চীন গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে আমি তা মনে করি না। সম্ভবত, কমিউনিস্ট শাসনের পতন দেশটিকে একটি গৃহযুদ্ধে নিপতিত করবে, যা বিশ্বব্যাপী অস্থিরতাকে আরও বাড়াবে। চীনকে বিলুপ্তির দিকে চালিত করা আমাদের স্বার্থ নয়। মোট কথা, খোঁড়াখুঁড়ি না করে আমেরিকাকে স্বীকার করতে হবে, চীনের স্বার্থ আছে। এর একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে ইউক্রেন।

ইউক্রেনে হামলা অবশ্যই পুতিনের একটি ভয়াবহ ভুল। তবে পশ্চিমারাও ধোয়া তুলসী পাতা নয়। আমি মনে করি ন্যাটোর দরজা ইউক্রেনের জন্য খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি বড় একটা ভুল; এটি স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া ইউক্রেনকে দেওয়া ন্যাটো সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি বাজে অবস্থায় ফেলে দেয়; অন্যদিকে এটি কেবল পুতিনকেই নয়, অনেক দেশবাসীকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এখন কাজ হলো, আর কোনো সংঘাতের মঞ্চ তৈরি না করে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানো। কিন্তু ইউরোপীয়রা এখন যা বলছে তা এক ধরনের পাগলামি। তারা বলছে : ‘আমরা ইউক্রেনকে ন্যাটোতে চাই না, কারণ তারা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাই, আমরা তাদের যতদূর সম্ভব সশস্ত্র করব এবং তাদের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র দেব।’ এর অর্থ হলো: ‘আমরা ইউক্রেনকে এমন মাত্রায় সশস্ত্র করেছি, যেখানে এটি হবে সর্বাধিক সশস্ত্র দেশ যেখানে আছে কৌশলগতভাবে ইউরোপের সবচেয়ে অনভিজ্ঞ নেতৃত্ব।’

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শির কথোপকথনের পরে, আমার মনে হয়, চীন রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য নিজেকে তৈরি করছে। চীনারা তাদের জাতীয় স্বার্থে ইউক্রেনবিষয়ক কূটনীতিতে প্রবেশ করেছে। যদিও তারা রাশিয়া ধ্বংস হোক তা চায় না; তারা ইউক্রেনের  স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাস করে; তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এমনকি তারা ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছাকেও মেনে নিতে পারে। চীনের এমন অবস্থানের আংশিক কারণ হলো, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায় না; তারা যতটা সম্ভব তাদের নিজস্ব বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে চায়। এটা সত্য, চীন ও রাশিয়া উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে, তাই তারা এখন একসঙ্গে আছে। তবে আমি এমন একজন রাশিয়ান নেতার সাক্ষাৎ পাইনি, যিনি চীন সম্পর্কে ভালো কিছু বলেছেন। অন্যদিকে, আমি কখনোই এমন কোনো চীনা নেতাকে রাশিয়া সম্পর্কে ভালো কিছু বলতে শুনিনি। তারা স্বাভাবিক মিত্র নয়।

আমার মতে, দ্বিতীয় ক্ষেত্র যেখানে চীন ও আমেরিকার কথা বলা দরকার তা হলো এআই। আমরা এমন একটি সক্ষমতার একেবারে শুরুতে রয়েছি, যেখানে মেশিনগুলো বিশ্বব্যাপী প্লেগ বা অন্যান্য মহামারির মতো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে; শুধু পারমাণবিক নয়, মানবসভ্যতা ধ্বংসের যে কোনো ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।

এআই বিশেষজ্ঞরাও জানেন না এর ক্ষমতা কোথায় গিয়ে ঠেকবে। আমার মনে হয়, এআই পাঁচ বছরের মধ্যে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি হয়ে উঠবে। আপনি যদি সামরিক ইতিহাসের দিকে তাকান, দেখবেন, ভূগোলের সীমাবদ্ধতা এবং নির্ভুলতামুক্ত না হওয়ার কারণে আপনার সমস্ত প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা কখনোই সম্ভব হয়নি। কিন্তু এআইর কারণে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকছে না। প্রতিটি প্রতিপক্ষই শতভাগ দুর্বল হতে পারে। তবে এআই বাতিল করা যাবে না। তাই চীন ও আমেরিকাকে তাদের সামরিক শক্তিকে একটা দূর পর্যন্ত একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে একযোগে কাজে লাগাতে হবে। তারা এআই যে ঝুঁকি তৈরি করছে তা সীমিত করতে পারে, যেভাবে অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ আলোচনা পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিকে সীমিত করেছিল।

আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে আমরা একটি নতুন পৃথিবীতে আছি; আমরা যাই করি না কেন ভুল হতে পারে। চলমান সংকট সমাধানের কোনো নিশ্চিত পন্থা নেই। তবুও আমাদের আশাবাদী হতে হবে। সত্য, ইতোপূর্বে যত অগ্রগতি ঘটেছে তার প্রায় সবই ভয়ানক সংঘাতের পরে ঘটেছে– ত্রিশ বছরের যুদ্ধ, নেপোলিয়নিক যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি; ফলে ইতিহাস বলে যে, যখন চীন ও আমেরিকার মতো দুটি শক্তি একে অপরের মুখোমুখি হয়, তখন স্বাভাবিক পরিণতি হয় সামরিক সংঘর্ষ। কিন্তু এটি একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়; এখানে উভয়েই নিশ্চিত ধ্বংস হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে।

আমি মনে করি এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব যেখানে ইউরোপ, চীন এবং ভারত সহজেই যোগ দিতে পারে এবং এরা কিন্তু ইতোমধ্যেই মানবতার একটি ইতিবাচক অংশ হিসেবে চিহ্নিত। সুতরাং, আপনি যদি প্রক্রিয়াটা শুরু করেন এটি ভালোভাবে শেষ হতে পারে– বা অন্তত কোনো বিপর্যয় ছাড়াই শেষ হতে পারে এবং আমরা উন্নতি করতে পারি। যদিও যেদিন তা সফল হবে সেদিন আমি থাকব না।

হেনরি কিসিঞ্জার: যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী; তাঁর সঙ্গে দ্য ইকনোমিস্টের দীর্ঘ আলাপচারিতার চুম্বক অংশবিশেষ ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন