স্ত্রী ও ছয় সন্তান নিয়ে কোনো রকমে সংসার চলছিল সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের ছোটবর্ণি গ্রামের ফরিদ মিয়ার। দুই দফা বন্যায় তিনি এখন প্রায় নিঃস্ব। বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়ে শেষ সম্বল ছোট-বড় তিনটি গরু নিয়ে পার্শ্ববর্তী খাগাইল বাজারে গিয়েছিলেন। সেখানে মাত্র ১৮ হাজার টাকায় মাঝারি সাইজের বলদ বিক্রি করতে পারলেও বাছুরসহ গাভীর ক্রেতা পাননি।

একই উপজেলার মিত্রিমহল গ্রামের আলিম উদ্দিনও অর্থাভাবে চাষের চারটি বলদ বিক্রির জন্য খাগাইল বাজারে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, 'বন্যায় ঘরবাড়ি তলিয়েছে। গরুকে খাবার দিতে পারছি না। ঘাস নেই, খড়ও নষ্ট হয়ে গেছে। টাকা-পয়সারও দরকার। তাই বাধ্য হয়ে শেষ সম্বল গরুগুলো বিক্রি করে দিচ্ছি।'
সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক ধরে এভাবে অনেকে গরু-ছাগল নিয়ে আশপাশের বাজারে যাচ্ছেন বিক্রি করার জন্য। আসন্ন কোরবানির হাটকে টার্গেট করে ব্যাপারীরা অল্প দামে সেসব গবাদি পশু কিনছেন।

নদনদীর পানি কমলেও সিলেট-সুনামগঞ্জে বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এই দুই জেলায় ঘরবাড়ি প্লাবিত থাকায় লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। দীর্ঘায়িত বন্যায় গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন মানুষ। কোম্পানীগঞ্জ বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের ভেতরেও অনেক গবাদি পশু রয়েছে। বন্যায় প্রয়োজনীয় খাদ্য সংকটে গবাদি পশুগুলো দুর্বল হচ্ছে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাবও দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরিভাবে প্রতিষেধক টিকার জন্য চাহিদাপত্র দিয়েছে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। কোরবানির ঈদকে টার্গেট করে পালন করা গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা।
বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে না যাওয়ায় আসন্ন কোরবানির হাট নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। সুনামগঞ্জে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত থাকায় অস্থায়ী হাটের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি জেলা প্রশাসন। সিলেটে কোরবানিকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসন ৫১টি অস্থায়ী পশুর হাটের অনুমোদন দিলেও অনেক জায়গা এখনও প্লাবিত। নগরীর ভেতরে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) এবারে ৬টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর অনুমোদন পেয়েছে। এ হাটগুলোর মধ্যে অন্তত তিনটির জায়গায় কাঁদা-পানি রয়েছে। গতকাল দুপুরে কাজিরবাজার পশুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবেশপথের দুইপাশে শত শত ছাগল বিক্রির জন্য লাইন ধরে রাখা হয়েছে।

পবিত্র ঈদুল আজহার আগে স্থানীয়ভাবে কমবেশি বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি উজানে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা রয়েছে।

এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনোয়ার সাদাত বলেন, জেলা প্রশাসন হাটের অনুমোদন দেয়। উপজেলা প্রশাসন বা সিটি করপোরেশন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে। তিনি বলেন, অস্থায়ী হাটের অনুমোদনের আগে সংশ্নিষ্টদের নিয়ে সভা হয়েছে। সেখানে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এখন বন্যার পানি কমছে, আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এখনও জেলার অনেক উপজেলা প্লাবিত। অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। আবার গবাদি পশু নিয়ে কেউ কেউ রাস্তার ওপরে রয়েছেন। বিগত দিনে যেসব এলাকায় অস্থায়ীভাবে কোরবানির পশুর হাট বসানো হয়েছে, সেখানেও পানি। তারপরও আমরা আশাবাদী, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আর কোনোভাবে তা সম্ভব না হলে হয়তো রাস্তা বা তুলনামূলক উঁচু জায়গায় হাট বসানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

এদিকে পারিবারিকভাবে গবাদি পশুর পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবে হাজারো খামারি কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে গরু-ছাগল-ভেড়া পালন-পালন করেন। চলতি বন্যায় গোখাদ্যের অভাব ও গবাদি পশুর স্বাস্থ্য নিয়ে খামারিরাও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। সিলেট জেলায় খামারিদের কাছে কোরবানির উপযোগী ৭৭ হাজার গবাদি পশু রয়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন। পরিবারিকভাবে আরও ৫০-৬০ হাজার গরু-ছাগল রয়েছে।

সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রুস্তম আলী বলেন, দুই দফা বন্যায় গোখাদ্যের চরম সংকট রয়েছে। পারিবারিকভাবে পালিত গরুর স্বাস্থ্যগত সমস্যাও থাকতে পারে। গতকাল দুপুরের পর রোদ উঠেছে। এভাবে রোদ থাকলে আশা করি বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এতে ঈদের আগে শেষের তিন-চারদিন পশুর হাট চাঙা হবে। এছাড়া খামার থেকে সরাসরি অনেক পশু বিক্রি হয়ে যায়। গত বছর স্থানীয় খামারিদের কাছে কোনো গরু অবিক্রীত ছিল না। অনেকে খামারে গরু কিনে রাখেন। সময়মতো কোরবানির জন্য নিয়ে আসেন। এভাবে পশু কেনাবেচা করলে হাটের খরচ দিতে হয় না বলে ইদানীং অনেকে এই পথে হাঁটেন। তবে সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমরা কোরবানি নিয়ে কোনো কাজ করছি না। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা ব্যস্ত।

সিলেট বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, সুনামগঞ্জের অনেক এলাকায় পানি রয়েছে। মানুষ গবাদি পশুকে রাস্তায় রেখেছেন। বন্যায় ঘাস নেই, খড়ও ভিজে নষ্ট হয়েছে। এতে গোখাদ্যের সংকট রয়েছে। এখন প্রচুর গোখাদ্যের প্রয়োজন। তিনি বলেন, সরকারিভাবে সাইলেজ ও দানাদার খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যা-পরবর্তী রোগবালাই থেকে গবাদি পশু রক্ষায় ভ্যাকসিন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।