- বিশেষ আয়োজন
- নারী গৃহকর্মীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে বেতন প্রদান জরুরি
নারী গৃহকর্মীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে বেতন প্রদান জরুরি

বাংলাদেশে নারী গৃহকর্মীরা শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত নন। তারা নিয়োগকারীর পক্ষ থেকে বেতন আনুষ্ঠানিক উপায়ে পান না। উপরন্তু তারা ন্যায্য অধিকার থেকেও অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন। তাই নারী গৃহকর্মীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বেতন ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে প্রদান নিশ্চিতকরণ জরুরি। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগের পাশাপাশি মন-মানসিকতার পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। গত ২৪ জুলাই রাজধানীর তেজগাঁওস্থ সমকাল সভাকক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ আহ্বান জানান। ‘বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ভূমিকা’ শীর্ষক এই বৈঠকের যৌথভাবে আয়োজন করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সমকাল
শাহিন আনাম
গৃহকর্মীদের ক্ষমতায়নে আমরা ‘সূচনা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছি। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হলাম সেটি হচ্ছে, যেসব গৃহকর্মী বাড়িতে থেকে কাজ করে, তাদের কাছে এখনও আমরা ঠিকমতো পৌঁছাতে পারিনি। তাই আবাসিক গৃহকর্মীদের বাধ্য হয়ে বাদ রেখেছি। আবাসিক, অনাবাসিক যেই হোক, সবাই তো শ্রমিক। সবাই কিন্তু কাজ করছে। এখানে নিয়োগকারী, গৃহকর্মীসহ সামাজিকভাবেও ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যতক্ষণ মানুষের মন- মানসিকতার মধ্যে পরিবর্তন না আসবে ততক্ষণ সব গৃহকর্মীকে ডিজিটাল আর্থিক সেবার আওতায় আনা সম্ভব নয়। গৃহকর্মীদের কাছ থেকে আমরা সেবা নিচ্ছি, বিনিময়ে তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা যারা কর্মজীবী নারী, বাইরে কাজ করি, আমাদের কিন্তু এক দিনও চলবে না তাদের সহযোগিতা ছাড়া। এ বিষয়টা কেন মানুষের মাথায় আসে না! আবাসিক হোক বা অনাবাসিক, গৃহকর্মী সবার অধিকারই এক। তাহলে আমরা যারা নিয়োগ দিই, আমাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন এনে কেন তাদেরকে এই ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আওতায় আনি না? সম্পদে নারীর ক্ষমতায়ন হোক সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে ও অর্থনৈতিভাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও নারীর ক্ষমতায়ন হোক। এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। নারীর অধিকার বাস্তবায়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ‘সূচনা’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে আবাসিক, অনাবাসিক গৃহকর্মীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদের ডাকা হলেও আবাসিক গৃহকর্মীদের আমরা পাই না। তাই গৃহকর্মীর সুরক্ষায় নিয়োগকর্তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।
আবু সাঈদ খান
আজ গৃহকর্মীরাও পিছিয়ে নেই। তাদের হাতে হাতে মোবাইল। এ মোবাইল তাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। গতিশীলতাও দিয়েছে এবং খানিকটা নিরাপত্তাও দিয়েছে। এখন যে কোনো অভিযোগ তারা ৯৯৯ অথবা ১০৯-এ জানাতে পারে। এবং তারা তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে। ইতোমধ্যে তাদের বেতন তারা গ্রামে পাঠাচ্ছে। গ্রাম থেকে আসা অনেক গৃহকর্মীই একসময় তাদের আয়ের টাকা গ্রামে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যন্ত্রণা পোহাত। নিজেরা যেত কিংবা কারও মাধ্যমে পাঠাতে গেলে টাকা-পয়সা বেহাত হয়ে যেত। এখন তারা সহজেই টাকা পাঠাতে পারে। আগে নানা রকম জটিলতা থাকলেও এখন ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস তাদের টাকা-পয়সার ক্ষেত্রে অনেকটাই নিরাপত্তা দিয়েছে। সেই জায়গা থেকে কীভাবে এটাকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় করা যায়, সহজতর করা যায়, গতিশীল করা যায়– এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সমকাল অসংখ্যবার একসঙ্গে কাজ করেছে। আগামীতেও করবে। সমকাল দৈনিক পত্রিকা হলেও সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে তৃণমূলের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি। তাদের সামনে আনা, তাদের ক্ষমতায়নে সমকাল কাজ করছে। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণে ও তাদের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাও আমাদের দায়িত্ব। এ জন্য প্রথমে মানসিক পরিবর্তন দরকার।
মোরশেদা আক্তার
ভারতীয় উপমহাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশরা অনেক আইন করেছে। যেগুলোর কার্যকারিতা এখনও আছে। গৃহকর্মীদের জন্য আইন করতে পারলে ভালো, তবে আইন না থাকলে যে ক্ষতি হবে তা নয়। ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ করা হয়েছে, আইন করারও চিন্তা আছে। এ লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছি। এই নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য গৃহকর্মীদের বিদ্যমান শ্রম আইনের আওতায় আনা হবে। অথবা নীতির আলোকে আলাদা একটি আইন করা হবে।
ফেরদৌস আরা বেগম
আইএলওর হিসাবে বিশ্বে গৃহকর্মীর সংখ্যা এক বিলিয়নের মতো। তাদের ক্ষমতায়িত করতে পারলে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়বে। বাংলাদেশের ৩.২ মিলিয়ন হচ্ছে নন এগ্রিকালচারাল লেবার ফোর্স, আর ৭.৪ মিলিয়ন হচ্ছে এগ্রিকালাচারাল হোম বেজড ওয়ার্কারস। ডোমেস্টিক ওয়ার্কারস ও হোমবেজড ওয়ার্কাসের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা পার্থক্য আছে। দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আছে ১৬ লাখ মানুষ। সেখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, তা হলো– বেশির ভাগই হচ্ছে পুরুষ এজেন্ট। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিএফএস ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের গৃহকর্মীর মধ্যে অনেকেই ১৮ বছরের নিচে। সে ক্ষেত্রে ডিএফএস কী করতে পারে– এখানে পলিসির বিষয়, আমাদের সচেতনতার বিষয় আছে।
শাহিন আক্তার ডলি
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবার কারণে কিন্তু গৃহকর্মী ও নিয়োগকর্তা দু’জনেই উপকৃত হচ্ছেন। তারা সঞ্চয় করতে পারছেন। এমনকি সঞ্চয়ের টাকায় উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছেন কেউ কেউ। নারীর ক্ষমতায়নে এই সাফল্য কোনো অংশেই ছোট নয়। তবে প্রকল্পটি দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত। একই সঙ্গে গৃহকর্মীরা নিজেরাই একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের উপকারিতা বা অর্জনগুলো তুরে ধরতে পারেন।
রোকসানা সুলতানা
গৃহকর্মীদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত ও বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন সুষ্ঠু আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। এ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হলে গৃহকর্মীরা কর্মক্ষেত্রে নিরাপদে কাজ করতে পারবে। তারা মজুরি বৈষম্য, শোষণ-নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। এ নির্যাতন বন্ধে ইতোমধ্যে আইএলও আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব দিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
এ কে এম আহমেদুল ইসলাম বাবু
আমরা আসলে গৃহকর্মীদের অধিকার দিতে পেরেছি কিনা, এতদিনে এসেও এটা আলোচনার বিষয়। সে ক্ষেত্রে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে, অধিকার আদায়ে সচেতনতা তৈরি করা। সচেতনতা তৈরি করা এ প্রকল্পের প্রথম ধাপ। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস একটা স্মার্ট পদক্ষেপ। বিকাশ এবং নগদ কিন্তু যথেষ্ট ইনোভেশন নিয়ে আসছে। সরকারের যে উদ্যোগ ডিজিটাল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করার, সেটাও এগিয়ে যাচ্ছে।
মো. তহুরুল ইসলাম
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সুবিধাপ্রাপ্তির পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেক সফলতার গল্প শুনেছি। তবে অনেক গল্প আছে সর্বস্বান্ত হওয়ার। এই লিটারেসিটা আসলে আইসোলেটেডভাবে বিকাশ, নগদ বা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। সেখানে সেন্ট্রাল ব্যাংকসহ এবং সরকারের দিক থেকেও নির্দেশনা দরকার যে ডিএফএস ব্যবহারে কীভাবে মানুষকে সচেতন করতে পারি। তবে আশার খবর হচ্ছে, সরকার স্কুল পর্যায়েও বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করেছে। আরেকটা যেটা হচ্ছে, টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আমি যদি বলি পাঁচটা স্টেপ লাগে, লগইন থেকে শুরু করে ক্যাশ আউট পর্যন্ত। এই স্টেপগুলো ফেস টু ফেস ট্রেনিং ছাড়া সম্ভব না। এ ছাড়া অনেকেই পিন নাম্বার লিখে রাখেন। সরকারের যে বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ভাতা ডিজিটালি দিচ্ছি, ওখানেও প্রত্যেকের একটা ভাতা বই আছে এবং ওই ভাতা বইয়ের ওপরে মোবাইল নাম্বার ও পিন নাম্বার লেখা থাকে। সবাই যেন সহজে ব্যবহার করতে পারে এমন একটা মাল্টিপল টেকনোলজির দরকার।
রুখসানা মিলি
এখানে যে ফলাফল উপস্থাপন করা হয়েছে, এই গবেষণাটি করা হয়েছে কয়েকটি এলাকার চার হাজার গৃহকর্মীর ওপর। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, গৃহকর্মীর সংখ্যা ১৪ লাখ। ফলে গবেষণাটি আরও বড় পরিসরে করা গেলে যথার্থ এবং সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যেত। যাদের ব্যাংকিং চ্যানেলের সেবা নেওয়ার সুযোগ নেই, তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যেই এক যুগ আগে বিকাশ চালু হয় এবং তখন থেকেই প্রান্তিক মানুষ বিকাশ ব্যবহার করছেন। আমাদের চারপাশের জানাশোনার আলোকেই বলা যায়, গৃহকর্মীদের মধ্যে বিকাশের ব্যবহার প্রচলিত। বর্তমানে বিকাশের সাত কোটি গ্রাহক। এর মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশ গ্রাহকই হলেন নারী। তাই এখানে যে নারীদের অংশগ্রহণ খুব কম, সেরকম নয়। ব্যাংকে না গিয়ে কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াই ঘরে বসে মুহূর্তেই বিকাশ অ্যাপ থেকে ব্যাংকের মাসিক সঞ্চয়সেবা নেওয়ার সুযোগ থাকায় নারীদের মধ্যে বাড়ছে সঞ্চয়প্রবণতাও। সমন্বিতভাবে গৃহকর্মীদের ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানোর মাধ্যমে প্রত্যেককে তার নিজের অ্যাকাউন্ট নিজেকেই ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে।
মোহাম্মদ মাহবুব সোবহান
ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের মধ্যে যদি বলি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের যে ডেফিনেশন আছে ওখানে আসলে অনেক স্টেপ আছে। ফার্স্ট হচ্ছে একটা মানুষকে কীভাবে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের মধ্যে আনা যায়। ওখান থেকে যদি বলি, এই ক্লাসটার বেসিক্যালি মেজরিটি হচ্ছে ৭৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী, যারা ফোন ব্যবহার করে। এরা হচ্ছে তরুণ জনগোষ্ঠী। এখন ২২ শতাংশ মানুষই স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ ৭৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী কীভাবে ইনক্লুশনে আসবে। আগে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য একটা সাদা কাগজ পূরণ করলেই হতো। কিন্তু এখন আরও সহজ। এখন আমরা যেটা করি সিম্পলি *১৬৭# ডায়াল করলেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলে যাচ্ছে নগদে। অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে এখন বায়োমেট্রিক দিতে হচ্ছে। ফলে সহজেই গৃহকর্মীর তথ্য চলে আসছে। গৃহকর্মীদের বেশির ভাগের পরিবার গ্রামে থাকে। ফলে বেতনের অংশ তাকে গ্রামে পাঠাতে হয়। বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করেই সেন্ডমানি পুরোপুরি ফ্রি করা হচ্ছে। একজন গৃহকর্মী বিনা খরচেই টাকাটা তার গ্রামের বাড়িতে কারোর নগদ অ্যাকাউন্টে পাঠাতে পারছে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ক্ষেত্রে গৃহকর্মীর টাকা সুরক্ষিত থাকছে। তৃতীয়ত, ‘ইমারজেন্সি লোন’ দেওয়া হচ্ছে।
নবনীতা চৌধুরী
আমরা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পেছনে সবসময় বলি যে তার সম্পদে-অর্থে অ্যাকসেস অ্যান্ড কন্ট্রোল আছে কিনা। অভিগম্যতা আছে কিনা, তার নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনে নারীর অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে এখনও হ্যান্ডহোল্ডিংয়ের বড় প্রয়োজন আছে। তার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। তার ভয় কাটানোর প্রয়োজন আছে। এটা শুধু নারীর জন্যই না, প্রান্তিক মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের ডিজিটাল গ্যাপ রয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে বলা হয়েছে, নারী-পুরুষের গ্যাপ আসলে মোবাইল ফোন থাকার ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশের মতো এবং মোবাইলে ইন্টারনেট থাকার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের গ্যাপ ৫২ শতাংশের মতো। কাজেই বড় গ্যাপটা মেটাতে হবে। যদি আবার নারীকে বা প্রান্তিক মানুষকে বোঝাতে পারি যে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে তিনি কী কী সুবিধা পাবেন, এতে তাদের উৎসাহ বেড়ে যাবে। তাই ডিজিটাল গ্যাপ কমিয়ে আনতে হবে।
রুমানা এ তুলি
২০১৪ সালে ব্যাংক এশিয়া প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং প্রচলন করে বাংলাদেশে। আমাদের লক্ষ্যটা একটু ব্যতিক্রম। আমরা গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবাটা পুরোপুরি দেব। কারণ আমাদের কাছে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হচ্ছে নাগরিক অধিকারের মতো। এখানে অ্যাকাউন্টটা খোলা হচ্ছে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে। একজন গৃহকর্মী কিন্তু সারাজীবন গৃহকর্মী থাকবে না। সে একটা সময় হয়তো গ্রামে চলে যাবে বা ১০ বছর পরে হয়তো একটা ব্যবসা শুরু করতে পারে। সে কারণে তাকে আমাদের ব্যাংক ঋণ দেবে। নারীর ক্ষমতায়নেও ব্যাংক এশিয়া কাজ করছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আরও ৩০টি ব্যাংক কাজ করছে। এ সময়ে দেশে দুই কোটি গ্রাহক তৈরি হয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার গ্রাহকদের মধ্যে ৬৩ শতাংশই নারী। আমাদের ১১ শতাংশ এজেন্টও নারী।
সানজীদা সুলতানা
‘সূচনা প্রকল্প’টি একটা পাইলট প্রকল্প। প্রথম ৯ মাসে অনেক কঠিন ছিল। পরবর্তী সময়ে আট হাজার গৃহকর্মী ও নিয়োগকর্তা নারীকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে। এই সার্ভিসটাকে যতটা সহজীকরণ করা যাবে, ততই ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়বে। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যারা লেখাপড়া করেননি বা অল্প করেছেন, তারা ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন করতে ভয় পান। এ জন্য সচেতন করা জরুরি। অক্সফামের সঙ্গে কর্মজীবী নারীর একটি প্রকল্প চলমান। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহকর্মীদের অধিকার আদায়ে কাজ করা হচ্ছে। সম্প্রতি মিরপুর ও ধানমন্ডিতে দু’জন গৃহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ক্ষমতাশীল হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবার ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। এ জন্য গৃহকর্মীদের অধিকার আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।
মাহমুদ হাসান লিখন
গৃহকর্মীদের জন্য একটা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হলো ‘হ্যালো টাস্ক’। বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের খুঁজে পাওয়া ও তাদের চাকরি খুঁজে দেওয়ার জন্য এটি একটি প্ল্যাটফর্ম। ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আগেও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যে গৃহকর্মীরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না। তারা বাটন ফোন ব্যবহার করেন। তাদের ডিজিটালি ইনক্লুড করতে গেলে এমন একটা টেকনোলজি বানাতে হতো, যাতে করে আমরা ওই ইন্টারনেট ছাড়া বাটন ফোনকে কানেক্ট করতে পারি। গত বছর আর্টিফিশিয়ালি ইন্টিলেজেন্ট ব্যবহার করে আমরা একটা টেকনোলজি বানিয়েছি। যেটাকে বলছি ‘কম্পিউটার আপা’। এটা ব্যবহার করে একজন গৃহকর্মী যে কোনো ফোনে ইন্টারনেট কানেক্ট করতে পারবেন। অর্থাৎ যে সময়ে একজন অ্যাপস ব্যবহারকারী গৃহকর্মী পাওয়ার জন্য নক করবেন, সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফোনে কল যায়, তিনি চাইলে অ্যাকসেপ্ট করতেও পারেন আবার রিজেক্টও করতে পারেন। বর্তমানে তাদের পুরো বেতন চলে যাচ্ছে নগদ বা বিকাশ অ্যাকাউন্টে।
তানজুমা আরা পল্লি
আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী গৃহকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, সার্টিফিকেট প্রদান ও চাকরি দেওয়া। দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। চাকরির শুরু থেকেই গৃহকর্মীকে ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন দেওয়া হয়। ফলে গৃহকর্মী ও নিয়োগকর্তা দু’জনেই উপকৃত হচ্ছেন। গৃহকর্মীরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিচ্ছেন। নিজের টাকা নিজেই খরচ করছেন। এতে করে ক্ষমতায়নে এই গৃহকর্মীরা অনেক দূর এগিয়েছেন।
আবুল হোসেন
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস একটি স্মার্ট ব্যাপার। এটি ব্যবহারে গৃহকর্মীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল লেনদেনে প্রতারণার শিকার হতে হয়। এসব বিষয়েও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিনের দাবি গৃহকর্মীদের শোভন কাজ ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। কারণ এখনও গৃহকর্মীদের শ্রম জাতীয় পর্যায়ে মূল শ্রমধারাতে ও মানদণ্ডে স্বীকৃত নয়। দেশের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র গৃহকর্মীসহ কর্মক্ষম সব নাগরিককে সুরক্ষা দিতে বাধ্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ও বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় প্রণয়ন করা হয়েছে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫। কিন্তু গৃহকর্মীদের অধিকার নিশ্চিতে ও সুরক্ষা প্রদানে এ নীতি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর নয়।
তারেক আজিজ
নারীর হাতে অর্থ দিন, নারীকে সেই অর্থ খরচ করার ক্ষমতা দিন এবং তিনি যেন ইচ্ছেমতো তাঁর টাকাটা খরচ করতে পারেন, তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন। আমরা হ্যালো টাস্কের সঙ্গে কাজ করেছি। কোনো গৃহকর্মীর দুর্যোগে অর্থাৎ রাত ২টায়ও যদি টাকার প্রয়োজন হয় তাহলে এই ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে তাঁকে সহযোগিতা করা যাবে। অনেক নারী আছেন, যাদের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড এবং নগদ বা বিকাশের পিন নাম্বার স্বামীকে জানান। এই জানার বিষয়টা স্বামীরা অধিকার হিসেবে মনে করেন। পাসওয়ার্ড না দিলে নারী সহিংসতার শিকারও হন। ব্যাংকিং খাতে নারীদের সরকার অ্যাকসেস দিয়েছে। এখন সহজেই নারীরা ঋণ নিতে পারছেন। তবে এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীর নামে ঋণ নিলেও টাকাটা ব্যবহার করছেন পুরুষ। আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, পানি ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনেক গৃহকর্মীর হাতের ত্বক উঠে যায়। ফলে জাতীয় পরিচয়পত্র পান না, এমএফএস ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেন না। কারণ অনেক সময় তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট কাজ করে না। এ বিষয়ে বিকল্প কিছু ভাবতে হবে।
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী
বিভিন্ন বাসায় কর্মরত গৃহকর্মীদের একটি আনুষ্ঠানিক জাতীয় ডিজিটাল পদ্ধতি ‘ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (ডিএফএস)’-এর অধীনে এনে বেতন-ভাতা পরিশোধ করার মাধ্যমে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করার লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ‘সূচনা’ প্রকল্পটি মূলত ভিন্ন আঙ্গিকে, অন্যভাবে চিন্তা করেও কীভাবে নারীদের ক্ষমতায়নের পথে আনা যায়, সেই বিষয়টি নিয়েই কাজ করছে। আমরা তো নারীর অধিকার নিয়ে অনেক কথা বলি, সহিংসতার কথা বলি– এই পাইলট প্রকল্পটির মাধ্যমে অনেক বিষয় উঠে এসেছে। ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়োগকর্তা ও গৃহকর্মী দু’জনকে নিয়ে কাজ করেছে।
নাসরিন আহমেদ
‘সূচনা প্রকল্প’টি ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবায় নারী গৃহকর্মীদের অংশগ্রহণে পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রকল্পটি ২০২১ সালের নভেম্বরে শুরু হয়েছে। শেষ হবে চলতি বছরের আগস্ট মাসে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। কেন গৃহকর্মীর জন্য ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবা প্রয়োজন? কারণ গৃহকর্মীদের বেতন গ্রহণের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক উপায় (ডিএফএস) সহজীকরণ। তৃণমূল পর্যায়ে এমনকি অনেক নারী নিয়োগদাতার ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। অনিয়মিত বেতন প্রাপ্তি থেকে নিয়মিত বেতন প্রাপ্তি, নিজের টাকা নিজের থাকে, বেদখল/হারানো এগুলো থেকে নিজের রোজগার সুরক্ষিত থাকে, নিজের আয়ত্তে থাকার ফলে পরিবারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবস্থান তৈরি হয়। সহজে সঞ্চয়ের সুবিধা থাকে, ফলে এককালীন টাকা জমিয়ে জীবনযাপন উন্নীতকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। সংসারের অবস্থা পরিবর্তন, সন্তানের শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, নিজের/পরিবারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে খরচের সুযোগ তৈরি হয়। সর্বোপরি নিজের টাকা নিজের হিসাব থেকে সংসার ও দৈনন্দিন জীবনে খরচ করার অধিকারের মাধ্যমে যে অভ্যাস তৈরি হয়, তা একজন গৃহকর্মীর আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে; যা তাকে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকে ধাবিত করে।
সোনিয়া আক্তার
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাসার গৃহকর্মী বিকাশে বেতন দেওয়ার কথা বললেও আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। দু-তিনবার বলার পর বিকাশেই বেতন দিই। এতে আমার নিজেরও অনেক উপকার হয়েছে। বিকাশ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছি। সব মিলিয়ে নিজের যেমন উপকার হয়েছে, গৃহকর্মীরও উপকার হয়েছে।
সাথী আক্তার
আমি আগে বেতন নিতাম হাতে। এখন নিই নগদে। আগে সংসারে অভাব লাইগাই থাকত। এখন অনেকটা সুখে কাটাই। ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন দিতে পারি। এক বছরে অল্প অল্প টাকা জমাইয়া ৫ হাজার টাকা দিয়া একটা সেলাই মেশিনও কিনছি। বিকেলে মেশিনের কাজ কইরা বাড়তি টাকাও আয় করি।
সভাপতি
শাহিন আনাম
নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)
সঞ্চালক
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
মূল প্রবন্ধ
নাসরিন আহমেদ
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)
আলোচক
মোরশেদা আক্তার
যুগ্ম সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
ফেরদৌস আরা বেগম
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিল্ড
শাহিন আক্তার ডলি
নির্বাহী পরিচালক, নারী মৈত্রী
রোকসানা সুলতানা
নির্বাহী পরিচালক, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স
এ কে এম আহমেদুল ইসলাম বাবু
পরিচালক, বেসিস এবং প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী টেকনোগ্রাম লিমিটেড
মো. তহুরুল ইসলাম
হেড অব ডিজিটাল ফাইন্যান্স সার্ভিস অ্যান্ড ডিজিটাল সেন্টার, এটুআই
রুখসানা মিলি
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, বিকাশ
মোহাম্মদ মাহবুব সোবহান
হেড অব বিজনেস (সেলস), নগদ
নবনীতা চৌধুরী
জেন্ডার কর্মসূচি পরিচালক, ব্র্যাক
রুমানা এ তুলি
অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, ব্যাংক এশিয়া
সানজীদা সুলতানা
অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক, কর্মজীবী নারী
মাহমুদ হাসান লিখন
নির্বাহী পরিচালক, হ্যালো টাস্ক
তানজুমা আরা পল্লি
প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, ভরসা ইনস্টিটিউট
আবুল হোসেন
অ্যাকটিং কোঅর্ডিনেটর
ডোমেস্টিক ওয়ার্কার রাইট নেটওয়ার্ক
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী
প্রোগ্রাম পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)
তারেক আজিজ
প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, অক্সফাম
সোনিয়া আক্তার
নিয়োগকর্তা
সাথী আক্তার
গৃহকর্মী
অনুলিখন
সাজিদা ইসলাম পারুল
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল
ইভেন্ট সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল
মন্তব্য করুন