- বিশেষ আয়োজন
- শহরের অরক্ষিত খেলার মাঠ রক্ষায় উদ্যোগ প্রয়োজন
সমকাল-ওয়ার্ল্ড ভিশন গোলটেবিল বৈঠক
শহরের অরক্ষিত খেলার মাঠ রক্ষায় উদ্যোগ প্রয়োজন

নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে দেশের খেলার মাঠ ও পার্কগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এর নেতিবচাক প্রভাব পড়ছে বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের ওপর। খেলার মাঠ না থাকায় শিশুদের শৈশব ম্লান হয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলার সুযোগ না থাকায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে খেলার মাঠ উদ্ধার ও তৈরিতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য বেসরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন।
গত ১৫ জুন গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে ‘শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পার্ক ও খেলার মাঠের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজন এসব কথা বলেন। ‘দৈনিক সমকাল’ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ’ যৌথভাবে এর আয়োজন করে
সুপারিশ
শিল্পনগরীতে খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য আলাদা জায়গা রাখতে হবে।
সিটি করপোরেশন উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যানে খেলার মাঠ ও পার্কের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
গ্রামের মাঠগুলোয় শিশুদের জন্য রাইডের ব্যবস্থা এবং শহরের স্কুলের মাঠগুলো শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
বেদখলকৃত সব স্থান, পার্ক এবং খেলার মাঠ দ্রুত দখলমুক্ত করার পর সেগুলো সংস্কার করে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
পার্ক এবং খেলার মাঠের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
মেয়েদের জন্য পৃথক খেলার মাঠ ও পার্কের ব্যবস্থা করতে হবে।
নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন ক্রীড়াবিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাজেটে খেলার মাঠ ও পার্ক তৈরিতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
জাহিদ আহসান রাসেল
অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের কারণে শিশুরা মাঠে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমি যদি গাজীপুরকে ধরি; গাজীপুর ঢাকার পাশে হওয়ায় ঢাকার মধ্যকার যেসব ইন্ডাস্ট্রি তার বাইরে নিতে বলা হয়েছে, সবই অপরিকল্পিতভাবে এখানে স্থানান্তর করা হয়। যে যেখানে পেরেছে, এই জেলায় ফ্যাক্টরি নির্মাণ করেছে। এর কারণে খেলার মাঠ কমে গেছে। যেগুলো রয়েছে, তাতে খেলাধুলা করার সুযোগ থাকে না। গ্রামাঞ্চলে ছেলেমেয়েরা বাইরে খেলাধুলা করতে পারলেও, শহরে সে সুযোগ কম।
শিশুরা যাতে খেলাধুলা করতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের প্রতিটি উপজেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১২৫টি স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এক হাজার ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ১৮৬টি মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজ চলমান। এ ছাড়া ১২৬টি স্টেডিয়াম নির্মাণে ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলমান। এ ছাড়া সরকারিভাবে ইউনিয়ন পর্যায়েও একটি খেলার মাঠ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ মাঠগুলো হবে উন্মুক্ত। যে যখন ইচ্ছা, এসব মাঠে এসে খেলতে পারবে। সারাদেশে আমরা এ ধরনের এক হাজার মাঠ তৈরি করতে চাই।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ২০১৮ সাল থেকে জাতির পিতার নামে ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ অনূর্ধ্ব ১৭ এবং ২০১৯ সাল থেকে ‘বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ অনূর্ধ্ব ১৭ সফলভাবে আয়োজন করে চলেছে, যা কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এবং ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’-এর আয়োজন করা হচ্ছে। এ বছর থেকে বঙ্গবন্ধু আন্তঃকলেজ ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করা হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর আয়োজন করছি। এ ছাড়া যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু ক্রীড়া শিক্ষাবৃত্তি প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
সরকারের একার পক্ষে কোনো কিছু সম্পূর্ণভাবে করা সম্ভব নয়। বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি বিনোদন পার্কগুলো তৈরি করে; সিটি করপোরেশনগুলো যদি এগিয়ে আসে, তাহলে কাজ অনেক সহজ হবে। সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোয় সরকার শুধু বরাদ্দ দেয়। সিটি করপোরেশনই কাজগুলো বাস্তবায়ন করে। এ ছাড়া আমরা দেশের শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ কোটি টাকার ওপরে খেলাধুলার সামগ্রী দিচ্ছি। কেননা, শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে খেলার মাঠের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে অভিভাবকদেরও এ বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। সন্তানদের মাঠে গিয়ে খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে।
মঞ্জু মারিয়া পালমা
দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সিটি করপোরেশন এলাকায় শিশুদের জন্য সরকারি বিনোদন পার্ক ও খেলাধুলার স্থান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এদিকটায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। ফলে সিটি এলাকার বস্তির শিশুরা খেলাধুলা এবং বিনোদনের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং তারা অলস সময় পার করছে। তারা যৌন হয়রানি, বিভিন্ন ডিভাইস ও মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকছে। তারা শিশুশ্রম, অসামাজিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপে লিপ্ত। যার ফলে তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
২০১৯ সালে করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক জরিপমতে, ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে (যেখানে প্রয়োজন ২,৪০০)। এর মধ্যে ১৪১টিই প্রাতিষ্ঠানিক। মাত্র ৪২টি খেলার মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে দখলে আছে ১৬টি; ১৭টি সরকারি মাঠ, ২৪টি আবাসিক কলোনি মাঠ এবং ১২টিতে ঈদ জামাত ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও কমেছে; বলছে সংগঠনটি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক, মেয়েদের জন্য পৃথক কোনো খেলার মাঠ নেই। তারা মাত্র ৭ শতাংশ মাঠে খেলতে পারে। রাজধানীতে উন্মুক্ত ২৪টি মাঠ রয়েছে। যার মধ্যে সিটি করপোরেশনের ১৮টি মাঠ (উত্তর সিটিতে ৬টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ১২টি)। এর মধ্যেও কিছু খেলার মাঠ আবার সংস্কার করা হয়েছে। ফলে মাঠের সৌন্দর্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব মাঠে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এদিকে ২০০০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, তখন ঢাকা শহরে খেলার মাঠ ছিল ১৫০টি (যদিও ঢাকার মাঠ নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি)। সংশোধিত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের অংশ হিসেবে রাজউকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের ৩৭টিতে কোনো খেলার মাঠ অথবা পার্ক নেই।
রাজধানীর মানুষকে স্বস্তি দিতে এবং জলবায়ুর অভিঘাত রুখতে উন্মুক্ত স্থান বাড়ানোর বিকল্প নেই। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ তৈরি এবং সেখানে শিশুদের খেলার সুযোগ করে দিতে না পারলে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। আরও বলা হচ্ছে, সব বয়সী মানুষের জন্যই দরকার পর্যাপ্ত খালি ও সবুজ স্থান। তাই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি খেলার মাঠ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। যেখানেই সরকারি ফাঁকা স্থান পাওয়া যাবে, সেখানেই পার্ক বা খেলার মাঠ তৈরি করা খুবই প্রয়োজন।
মো. ওয়াহিদ হোসেন
আমাদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকার ব্যাপক কার্যক্রম বাসস্তবায়ন করেছে। অনেক পার্ক করেছে; সারাদেশে মিনি স্টেডিয়াম করছে। বেসরকারি সামাজিক সংগঠনগুলো কি এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে? আর এলে তা কতটুকু? কতটি ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ইভেন্ট হচ্ছে এলাকাভিত্তিক? সেখানে কতগুলো সংগঠন আছে; তাদের দাবিগুলা কতটা যৌক্তিক– এটা আমাদের ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া পার্কগুলো বেসরকারিভাবে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেও গড়ে উঠতে পারে। সেখানে ৩০ বা ৫০ টাকা টিকিটের বিনিময়ে দর্শনার্থীদের প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
আবদুল হান্নান
খেলাধুলা শুধু শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটায়, তা নয়। শিশুর বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। প্রধানমন্ত্রী যে ইস্পাত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন, সেটা আজকের শিশুরা পূরণ করবে। আমরা চাই, আমাদের সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে যেন একটি খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত স্থান থাকে।
আনোয়ার হোসেন জাহিদ
শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলার মাঠের বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার প্রতিটি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করে দিচ্ছে। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডেও খেলার মাঠের ব্যবস্থা সরকার করতে পারে। খেলার মাঠ তৈরির পাশাপাশি সেগুলোতে সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
জামাল হোসেন
সরকার সারাদেশে খেলার মাঠ তৈরি করছে। এর অংশ হিসেবে গাজীপুরেও খেলার মাঠ তৈরি হচ্ছে। আমি আশা করব, এই স্টেডিয়ামে পথশিশুরাও যেন খেলার সুযোগ পায়। ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে গাজীপুর একটা বৃহৎ সিটি করপোরেশন। এ সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে যেন একটা খেলার মাঠ থাকে। এতে আমরা ভবিষ্যতে অনেক খেলোয়াড় পাব। পাশাপাশি মাদকমুক্ত পরিবেশও তৈরি হবে। সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলে এটা করা সহজ হবে।
সাবিহা সুলতানা
বর্তমানে আমাদের সমাজে খেলার মাঠ ও পার্কের অভাব রয়েছে। আমাদের একটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে শিশু সুরক্ষা হাব রয়েছে। খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত শিশুরা ইনডোর গেমসের সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের এই প্রকল্প শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে একটু হলেও ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে, আউটডোর গেমসের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ যেন ব্যবহারের উপযোগী করা হয়, এ বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
শিরিন আক্তার
দেশে খেলার মাঠের সংখ্যা এমনিতেই কম। সব শিশু খেলাধুলা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে মেয়েরা তো আরও পিছিয়ে। মেয়েশিশুরাও যেন খেলাধুলার সমান সুযোগ পায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মো. আব্দুল মতিন
একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে খেলার মাঠ ও পার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। আমার গাজীপুরের অনেক স্কুল পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি, অনেক স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। তবে যে মাঠগুলো আছে, সেগুলো উন্মুক্ত। সব শিশুই সেখানে খেলাধুলা করতে পারে। তবে সিটি করপোরেশন যদি আলাদা করে আরও কয়েকটা মাঠের ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে আমার মনে হয়, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে তা সহায়ক হবে।
অধ্যাপক অসীম বিভাকর
খেলাধুলা জীবনের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। খেলার মাঠকে বিদ্যালয়ের যথার্থ বিকল্প হিসেবে মনে করা হয়। কেননা, বিদ্যালয় থেকে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, খেলার মাঠে সেটির অনুশীলন হয়। আমরা যদি খেলাধুলার নিয়মের দিকে একটু খেয়াল করি, তাহলে সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা– সবই আমরা খেলার মাঠ থেকে শিখতে পারি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, খেলার মাঠ দ্রুত কমে যাচ্ছে। ফলে আমাদের শিশুরা খেলার মাঠে যেতে পারছে না। তাদের জন্য খেলার মাঠ নেই। যদি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা না যায়, হারিয়ে যাওয়া খেলার মাঠগুলো উদ্ধার করা না যায়, তাহলে একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে উঠবে না। সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে না পারলে আমরা জাতি হিসেবে পঙ্গু হয়ে যাব। সাম্য এবং পারস্পরিক সহমর্মিতাবোধ আমরা খেলার মাঠ থেকে পাই। কাজেই বোধসম্পন্ন এবং সুস্থ মানুষ তৈরি করতে হলে আমাদের খেলার মাঠ করতেই হবে।
সিরাজুল ইসলাম
গাজীপুর জেলার বিদ্যালয়গুলোর মাঠ খেলার উপযোগী করে তোলার বিষয়ে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। এ জেলার অধিকাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ আছে। অল্প কিছু বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। আমরা খেলার মাঠের বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সেটা পাস হলে গাজীপুর সিটিতে আশা করছি, খেলার মাঠের সংকট থাকবে না।
সঞ্জয় সাহা পিয়াল
এ দেশে মাঠ-জমি একটা বৈষয়িক বিষয়। আমার মনে হয়, গ্রামে যে মাঠগুলো আছে, সেই মাঠগুলোয় যদি পার্কের ব্যবস্থা এবং তাতে রাইডের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, তাহলে ভালো হয়। গ্রামের ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুরা যেন এতে চড়তে পারে। তারা কিন্তু শহরের পার্কে এসে চড়তে চায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে।
গ্রামের মাঠগুলোয় রাইডের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি শহরের যে মাঠগুলো রয়েছে, তা উন্মুক্ত করা উচিত। আমি নিজে যে এলাকায় থাকি, তার পাশে একটা বস্তি আছে। সেখানে আমি দেখেছি, ছেলেমেয়েরা খেলতে পারে না। পাশে একটা সরকারি স্কুল আছে। বিকেলে সেই স্কুলের ফটক বন্ধ থাকে। যেহেতু শহরে জায়গার সংকট, সেহেতু এসব বিদ্যালয়ের মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত। সব শিশুর জন্য বিকেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই মাঠগুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে। এটা বেসরকারি স্কুলেও হতে পারে।
মো. নুরুল আমিন
আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে উত্তর সালনায় একটা মাঠ করেছিলাম। আমি উপস্থিত থেকে রাতে চাঁদের আলোতে ছাত্রদের নিয়ে মাটিও কেটেছি। সেই মাঠটি এখনও চালু আছে। আমি মনে করি, এ রকম আরও অনেক মাঠ আছে, যেগুলোর সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এ ছাড়া অনেক খাসজমি পড়ে আছে; মানুষ দখল করে রেখেছে। এই সরকার আসার পর আমি দেখেছি, খেলাধুলার ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোয় খেলাধুলার শিক্ষকের অভাব। আমার মনে হয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় খেলাধুলাবিষয়ক শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তাহলে শিশুরা খেলাধুলায় আরও আগ্রহী হবে।
অধ্যাপক ড. এ.বি.কিউ.এম. ইসমাইল হোসেন খান
বর্তমান সরকার শিশুদের বিকাশে দেশের বিভিন্ন জেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম করে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলে দুটি স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে অনেক কাজ করছেন। আগের দিনে আমরা দেখতাম, স্কুলগুলোর মাঠ অনেক বড় থাকত। বর্তমানে তা ছোট হয়ে আসছে। সব স্কুলে যেন অন্তত একটা মাঠ থাকে, এটি নিশ্চিত করতে হবে।
মুকুল কুমার মল্লিক
আমরা সবাই স্মৃতিকাতর; স্মৃতি রোমন্থন করতে পছন্দ করি। বিশেষ করে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিই আমাদের বেশি পছন্দের। শৈশবে আমাদের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। আজকে সেদিন হারিয়ে গেছে। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সময়েরও পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই আধুনিকতার কারণে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছি। আমরা স্কুলে ছোটবেলায় খেলার মাঠ পেয়েছি। বর্তমানে শিশুরা সেটা পাচ্ছে না। খেলার মাঠ শান্তি ও সৌহার্দ্যের চারণভূমি। সেখানে প্রতিপক্ষ থাকে, তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, কিন্তু সহিংসতা নেই। কাজেই খেলার মাঠ যে আমাদের কতটা প্রয়োজনীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যোয়ান্না ডি রোজারিও
খেলার মাঠ শিশুদের প্রাণের দাবি। আমাদেরও একই দাবি। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে খেলার মাঠ নিশ্চিতকরণে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের আরবান প্রোগ্রাম সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সাল থেকে এ বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ কার্যক্রমে শিশুদেরও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। শুধু তৃণমূল পর্যায়েই নয়; সিটি করপোরেশন ও জেলা পর্যায়ে আমরা কাজ করছি। এ ছাড়া আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আমরা সংলাপ, টকশো, গোলটেবিল আলোচনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
মাওলানা খ. ম. রুহুল আমীন
আমরা এক সময় খেলাধুলা করে নিজেদের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করেছি। বর্তমানে শিশুরা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার গেমসে আসক্ত হয়ে গেছে। দেখা যায়, যেসব মাঠ আছে, সেখানে মাসের পর মাস বিভিন্ন ধরনের মেলা ও অনুষ্ঠান হতে থাকে। শিশুরা খেলবে কী করে? মাঠগুলো বিভিন্নভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। যে মাঠগুলো এখনও আছে, তা খেলার উপযোগী নেই। মাঠে না আছে ঘাস, না মাঠটি সমান্তরাল। অর্থাৎ খেলার পরিবেশ নেই। গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। কোনো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সেখানে বিপর্যয় নেমে আসবে। সঠিক পরিকল্পনা দরকার। খেলার মাঠের জন্য আলাদা বাজেট করা প্রয়োজন।
নূরজাহান আক্তার শিউলী
আমাদের টঙ্গী এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ডে কোনো মাঠ নেই। শুধু এরশাদনগরে ওয়ার্ল্ড ভিশনের সহযোগিতায় একটি পার্ক করা হয়েছে। আমি ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এখানে একটি খেলার মাঠ ছিল, তাও দখলে চলে গেছে। ৫১ এবং ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডেও একই অবস্থা। সেখানকার শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি– সরকার যেন শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নিশ্চিত করে।
আকরাম হোসাইন
খেলার মাঠ না থাকার কারণে যুব ও শিশুরা অনলাইন গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ে কিংবা বাজে আড্ডায় মেতে ওঠে। ফলে তারা সাইবার অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া নানা মানসিক সমস্যায় তারা ভোগে। আমাদের টঙ্গীর ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে তেমন খেলার মাঠ নেই। একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ছিল; সেখানে শিশুরা খেলাধুলা করত এবং বয়স্করা হাঁটাচলা করতেন। কিন্তু প্রভাবশালীরা সেটা দখলে নিয়ে গেছে। আমরা চাই, আমাদের খেলাধুলার জন্য মাঠের ব্যবস্থা করা হোক।
শেখ রোকন
এক সময় ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহর ছিল অপরাধপ্রবণ। নগরের কর্মকর্তারা অপরাধ কমানোর উদ্দেশ্যে ‘ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড’ ও ‘ম্যানচেস্টার সিটি’ নামে দুটি ফুটবল ক্লাব গড়ে তোলেন। আজ এ শহরটিই বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ শহর। খেলাধুলা এই শহরের অপরাধ কমাতে সাহায্য করেছে।
শিল্পায়ন খারাপ কিছু নয়। তবে পরিবেশকে রক্ষা করে শিল্পায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে এলাকার খেলার মাঠগুলো রক্ষা করে এটি করতে হবে। যদি পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, জামশেদপুরসহ যত শিল্প শহর আছে, তাতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও বিনোদনের জায়গা রেখে শিল্প শহরগুলো করা হয়েছে। আমরা গাজীপুরকে একটা শিল্প শহর করতে চাই। এখানে শিল্প হোক। একই সঙ্গে সামাজিক এবং পরিবেশগত যে স্থিতিশীলতা-স্থায়িত্ব, সেগুলো থাকুক– সেটাও আমরা চাই। একটা সামাজিক আন্দোলন তখনই গড়ে উঠবে যখন সরকারের সঙ্গে বেসরকারি পক্ষগুলোও এগিয়ে আসবে। কিন্তু এটা আমাদের আবার মনে রাখতে হবে, এগিয়ে আসার যে নীতি-কাঠামো, এগুলো সরকারের পক্ষ থেকে ঠিক করে দিতে হবে; তাহলে তাদের জন্য সুবিধা হবে। একই সঙ্গে এটা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ, সুযোগ-সুবিধা এবং প্রচার করতে হবে।
প্রধান অতিথি
জাহিদ আহসান রাসেল
প্রতিমন্ত্রী, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়
সঞ্চালনা
শেখ রোকন
সহযোগী সম্পাদক, সমকাল
মূল প্রবন্ধ
মঞ্জু মারিয়া পালমা
ডেপুটি ডিরেক্টর, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
শুভেচ্ছা বক্তব্য
যোয়ান্না ডি রোজারিও
টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর, ওয়ার্ল্ড ভিশন
আলোচক
মো. ওয়াহিদ হোসেন
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, গাজীপুর
মো. আব্দুল হান্নান
সচিব, গাজীপুর সিটি করপোরেশন
আনোয়ার হোসেন জাহিদ
জেলা কোচ
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), গাজীপুর
জামাল হোসেন
সাধারণ সম্পাদক
গাজীপুর জেলা ক্রীড়া অ্যাসোসিয়েশন
সঞ্জয় সাহা পিয়াল
ক্রীড়া সম্পাদক, সমকাল
সাবিহা সুলতানা
চাইল্ড রাইটস ফ্যাসিলিটেটর
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গাজীপুর
শিরিনা আক্তার
প্রোগ্রাম অফিসার
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, গাজীপুর
মো. আব্দুল মতিন
পরিচালক
জেলা শিক্ষা অফিস, গাজীপুর
সিরাজুল ইসলাম
সহকারী মনিটরিং কর্মকর্তা
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, গাজীপুর
মো. নুরুল আমিন
মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা
শ্রীপুর উপজেলা, গাজীপুর
অধ্যাপক ড. এ.বি.কিউ.এম. ইসমাইল হোসেন খান
অধ্যক্ষ, গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ
অধ্যাপক অসীম বিভাকর
বাংলা বিভাগের প্রধান
গাজীপুর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ
মুকুল কুমার মল্লিক
কলেজ শিক্ষক
মাওলানা খ. ম. রুহুল আমীন
পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ ইমাম, গাজীপুর জেলা
নূরজাহান আক্তার শিউলী
সহসভাপতি, টঙ্গী যুব ফোরাম
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
আকরাম হোসাইন
সদস্য, টঙ্গী যুব ফোরাম
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
অনুলিখন
মাজহারুল ইসলাম রবিন
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল
সার্বিক তত্ত্বাবধানে
মীর রেজাউল করিম
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর, আরবান প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল
ইজাজ আহ্মেদ মিলন
জেলা প্রতিনিধি, গাজীপুর, সমকাল
মন্তব্য করুন