প্রস্তাবিত ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২১’-এর অনেক ধারাই আইনের ধারা হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এই আইনের অনেক ধারা এবং শাস্তি দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রস্তাবিত এ আইনে ভূমিদস্যুদের শাস্তি কমিয়ে এনে তাদের ভূমি দখলে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে এই আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য।

গত ২১ জুন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দৈনিক সমকালের সভাকক্ষে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২১’ শীর্ষক আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সমকাল, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) যৌথভাবে এর আয়োজন করে।

সুলতানা কামাল

প্রস্তাবিত এই আইনের নাম ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ হলেও প্রতিকার ও প্রতিরোধ করার মতো শক্ত কোনো বিষয় এতে নেই। বরং যা কিছু আছে সেটি অনেক বেশি অন্য পথে নিয়ে যাওয়ার একটি ব্যাপার আছে। সে জন্য এর উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া এবং সংজ্ঞাগুলো নিয়ে প্রশ্ন এসেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাহী থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার যে আন্দোলন হয়েছিল, এই আইনের মাধ্যমে তা নস্যাৎ হওয়ার পথে।

আমরা যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে আসলে প্রবেশ করেছি এবং সেদিকে খুব জোরে ধাবিত হচ্ছি, তাকে এই আইন আরও ত্বরান্বিত করবে। এই বিষয়ে আমাদের শক্ত অবস্থান নিতে এবং শক্তভাবে কথা বলতে হবে। সঠিক প্রতিকারের কথা চিন্তা না করে মামলার জট দূর করার জন্য যে পথ চিন্তা করা হয়েছে এই আইনে, আমার মনে হয় তা সঠিক নয়। এখানে আরও চিন্তা করার জায়গা রয়েছে।

আবু সাঈদ খান

ভূমি দখলের মতো ভয়ংকর থাবা এ দেশে কোনোক্রমেই থামছে না। এই দখলবাজদের মধ্যে ভূমিখেকোরা আছে, স্বার্থান্বেষী মহল আছে। এমনকি এই দলে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নাম লিখিয়েছে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে তেলেগু সুইপার কলোনির কথা। সেখানকার মানুষগুলোকে তাঁদের জায়গা থেকে মর্মান্তিকভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হয়নি। আমার মনে হয়, তেলেগু সম্প্রদায় এবং সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের সম্পত্তি দখল করাটা খুব সহজ। আরেকটা সহজ কাজ হলো, সরকারি সম্পত্তি দখল করা। যখন কোনো বাঙালি মুসলমানের সম্পত্তি দখল হয়, তখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে প্রতিবাদ হয়। যখন কোনো হিন্দুর সম্পত্তি দখল হয়, তখন বাঙালিদের মধ্য থেকে একটা প্রতিবাদ ওঠে। যখন তেলেগু, মুণ্ডা, সাঁওতাল কিংবা পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী এবং সরকারি সম্পত্তি দখল হয়, তখন প্রতিবাদ করার কেউ থাকে না। এর জন্য শক্ত আইন দরকার। তবে সেই আইনটি তড়িঘড়ি করে এমনভাবে করা ঠিক হবে না, যাতে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দখলবাজরা পার পেয়ে যায় কিংবা সাজাটা মওকুফ হয়।

মিনহাজুল হক চৌধুরী

এই আইনে যেসব সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাতে এই আইনকে পরিপূর্ণ ও সঠিকভাবে জনকল্যাণে কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এই আইনের ৪ থেকে ২৮ নম্বর ধারা পর্যন্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। যদি ৪ নম্বর ধারার কথাই বলি, তাহলে এই ধারায় জাল দলিলের কথা বলা হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে আইনে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। জাল দলিলের বিরুদ্ধে প্রতিকার ‘সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭’-এর ৩৯ ধারায় বলা আছে। এই ধারায় অনেক মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে। অন্যান্য আইনেও এই বিষয়ে মামলা করা যায়। এ ছাড়া ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৬৫, ৪৬৬, ৪৬৭, ৪৬৮ এবং ৪৬৯– এই পাঁচটি ধারায় জাল দলিল তৈরি করা এবং কোন উদ্দেশ্যে কী ধরনের জমির জাল দলিল করলে কী শাস্তি– তা আলাদা আলাদাভাবে বলা আছে। এতে সর্বনিম্ন শাস্তি দুই বছর এবং সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর। প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধকে বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, এর সাজা ১০ বছর থেকে কমিয়ে ২ বছর করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য কী? এটি ছাড়াও প্রস্তাবিত আইনের এমন অনেক ধারা আছে, যা কোনো আইনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এরপর এই আইনের ৫ নম্বর ধারায় রয়েছে, মালিকানার অতিরিক্ত জমির দলিল সম্পাদনের দণ্ড। এটি যদি কোনো দাতা করে থাকেন তার জন্য। ৬ নম্বর ধারায় বলা আছে, একই মালিকানা অতিরিক্ত জমি লিখিয়ে নেওয়ার দণ্ড। এটি গ্রহীতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ভূমি হস্তান্তর দলিল সম্পাদনকালে দাতা হিসেবে লাভবান হইবার লক্ষ্যে কোনো জমিতে মালিকানা ও দখল না থাকা সত্ত্বেও নিজেকে উক্ত জমির মালিক-দখলকারী হিসেবে উপস্থাপন করিয়া অন্য কোনো ব্যক্তির বরাবরে জাল দলিল সম্পাদন করিয়া থাকেন তাহা হইলে তাহার শাস্তির বিধান বলা আছে।’ এটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, এই ধারাটি কোনো আইনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। যিনি এটি করেছেন, ওনার আইন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। কেননা একজন ব্যক্তি যখন দলিল করবেন, তখন তিনি কখনোই স্বীকার করবেন না যে, তার মালিকানাও নেই, দখলও নেই।

এই আইনের অনেক ধারার নিচে লেখা আছে যে, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের আওতায় নেওয়া যাইতে পারে।’ উদাহরণ হিসেবে ২২ নম্বর ধারার কথা বলা যায়। এই ধারার নিচে লেখা আছে, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯-এর আওতায় নেওয়া যাইতে পারে।’ ১৯ নম্বর ধারাতেও একই কথা বলা আছে। এই আইনের উদ্দেশ্যই হলো, ভূমি আইনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে আওতায় নেওয়া। এটি বিচার বিভাগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একটি আইন যখন করা হয়, তখন বিদ্যমান সকল আইনের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য রাখতে হয়। পারস্পরিক সাংঘর্ষিক কোনো আইন করা যাবে না। ধরা যাক, চারটি আইন করা হলো এবং বলা হলো প্রতিটি আইন একে অপরের ওপরে প্রাধান্য পাবে। এখন একটি আইন যদি আরেকটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে কোনটি প্রাধান্য পাবে?

আরেকটি নতুন বিষয় এসেছে এই আইনে, তা হলো প্রশাসনিক জরিমানা। হয়তো নিরাপদ খাদ্য আইনে এ ধরনের কিছু আছে। এই প্রশাসনিক জরিমানাটা কিন্তু কোনো বিচারিক কর্মকর্তা দিতে পারবেন না। ‘সরকার সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা সহকারী কমিশনার (ভূমি)কে তাহার অধীন এলাকায় সংঘটিত অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবেন।’ অর্থাৎ প্রশাসনিক জরিমানা করবেন শুধু প্রশাসনের লোক। এটা হবে দণ্ডের অতিরিক্ত। আমরা জানি, এ দেশে একেকটি আইন করার ক্ষেত্রে ৫ বছর, ৭ বছর বা ১০ বছরের একেকটা কমিশন করে করা হয়েছে।  এ আইনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কমিশন না করেই যখন যা ইচ্ছা হয়েছে, তখনই তা আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এই আইনের ৩৩ নম্বর ধারায় ইউএনও এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর ক্ষমতার বিষয়ে বলা আছে, ‘তাহারা তাহাদের অধীন ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি খাস ভূমিসহ যে কোনো ভূমি উত্তোলন প্রতিরোধসহ জবরদখল সকলই করিতে পারিবেন।’ আবার ৪৯ ধারায় ‘ইনডেমনিটি’ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা সরল বিশ্বাসে যাই-ই করবেন, তার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। তাহলে সরকারি ভূমির ক্ষেত্রে ইউএনও হচ্ছেন মালিক, উনি অভিযোগকারী আবার ৩৩ ধারায় তিনিই বিচার করবেন। তিনিই রায় দেবেন এবং তিনিই রায় বাস্তবায়ন করবেন। অর্থাৎ একই ব্যক্তি অভিযোগ থেকে শুরু করে রায় বাস্তবায়ন– সবই করবেন। আইনের কোনো নীতিতেই এটি যায় না। এই আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সম্বন্ধে বলা আছে। এটা কোনো আইনের অংশ হতে পারে না। এটা ‘সাবজেক্ট গাইডলাইন’।

যাঁরা এই আইন করেছেন, তাঁরা মনে করেছেন এখানে অসুবিধা থাকতে পারে, যার জন্য তাঁরা এই আইনের ৪৭ নম্বর ধারায় অসুবিধা দূরীকরণের বিষয়টির যোগ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের কোনো বিধানের অস্পষ্টতার কারণে উহা কার্যকর করিবার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে সরকার আইনের অন্যান্য বিধানের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া উক্ত অসুবিধা দূরীকরণার্থে সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রয়োজনীয় যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ এই ধারা দিয়ে এই আইনের দুর্বলতাটাকে তাঁরা প্রকাশ করে দিয়েছেন।

২০০৭ সালের পর প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের মধ্যে যে পৃথককরণ হয়েছে। আমরা বারবার দেখছি, সেই বিচার বিভাগের কাজকে কুক্ষিগত করার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়া হলো একটি প্রক্রিয়া। এটি কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা বা অনিচ্ছার বিষয় নয়। একজন বিচারক যদি মনে করেন, তিনি চাইলেই এটা-ওটা করবেন, তা কিন্তু তিনি পারেন না। যদি না বিচার প্রক্রিয়া এবং আইন তাঁকে সমর্থন করে। কিন্তু এই আইন দিয়ে স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সেটি যাঁকেই দেওয়া হোক। সুতরাং এই আইন জনকল্যাণমূলক আইন নয়।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

এই আইনটার উদ্দেশ্য কী? আদৌ কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এ আইনটা করছে কিনা? সরকারকে যদি আমি ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিই, তাহলে আমার মনে হয় এ আইনটি একটি ভালো উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে এই আইনের ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ না করে চূড়ান্ত করা ঠিক হবে না। ভূমি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ, যেন নাগরিক সেই অধিকার সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে। সেই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব একজন প্রশাসনিক ম্যাজিস্ট্রেট নয়, বরং এটি হাইকোর্টের হাতে তুলে দিতে হবে। সরকার যদি মনে করে, ভূমিসংক্রান্ত মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে অনেক লম্বা সময় লাগে। তাহলে সেই দীর্ঘসূত্রতা কীভাবে কমানো যায়, তার একটি দিকনির্দেশনা এই আইনে থাকতে পারে।

সরকার যদি সত্যিই ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ করতে চায়, তাহলে ভূমি অপরাধের সংজ্ঞা সরকারকে পরিষ্কারভাবে দিতে হবে যে, কোন কোন ভূমি অপরাধ সরকার এই আইনে দেখবে। একইসঙ্গে প্রতিকারটিকে কার্যকর করে দিতে হবে। অন্যের জমি জোর করে দখল করে নেওয়া এক ধরনের সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কিছু কোম্পানির মাধ্যমে এটি হচ্ছে। তারা সাধারণ মানুষ ও সরকারের জমি দখল করছে। এ জন্য আমরা এত নদী দখলদার এবং ইকোনমিক জোন দেখতে পাই। এত ইকোনমিক জোন হয় আর কেউ প্রতিবাদ করে না– এটি কি হতে পারে? নিজের ভিটেমাটির প্রতি তো মানুষের অন্যরকম আবেগ কাজ করে। ফলে সরকারকে এই আইনে ভূমি অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। একইসঙ্গে অপরাধের কার্যকর প্রতিকার ডিজাইন করতে হবে। ভূমি দখলদারদের শুধু ২ বছরের জেল দিলে হবে না। তাদের ভূমি দখলের ফলে ভূমির আসল মালিকদের যে ক্ষতি হবে, তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও ব্যবস্থা এই আইনে করতে হবে। ভূমি অপরাধ হলে এই বিষয়ে অভিযোগ থেকে শুরু করে নিষ্পত্তির রূপরেখা এই আইনে আসা জরুরি।

শামসুল হুদা

প্রস্তাবিত আইনটি সারাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে বলা হয়েছে। যেসব আইন সারাদেশে প্রযোজ্য হওয়ার কথা বলা আছে, সেটি সারাদেশেই প্রযোজ্য হবে। তবে কিছু কিছু আইন আছে, যাতে লেখা আছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান বাদে দেশের অন্যান্য জেলার জন্য প্রযোজ্য হবে। যেহেতু এই আইনে এই রকম কিছু লেখা নেই, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, এই আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার জন্যও কার্যকর হবে। যদি তাই-ই হয়, তবে পার্বত্য শান্তি চুক্তির কী হবে? এই চুক্তির আওতায় যেসব পরিষদ এবং আইন হয়েছে, তার কী হবে? পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কী হবে? এই আইনে যে খাসজমির কথা বলা আছে, তা পার্বত্য এলাকার জন্য প্রযোজ্য নয়। পার্বত্য এলাকায় খাসজমি বলে আসলে কিছু নেই। সেখানে বনভূমি, পাহাড় এবং জুম ক্ষেত আছে। এ ছাড়া সেখানকার বাসিন্দাদের একটা সাধারণ সম্পত্তি রয়েছে, যা তাঁরা প্রথাগত আইনের অধীনে সবাই মিলে ভোগ করেন। সেই জায়গাটাকে নিয়ে নেওয়ার জন্য, পার্বত্য চুক্তি যাতে বাস্তবায়িত না হয় এবং সেখানকার বাসিন্দাদের যাতে উচ্ছেদ করা যায়, এই আইনটি কি তার একটা উদ্যোগ? এই প্রশ্নের উত্তর এই আইনে নেই।

ক্ষমতাবান প্রভাবশালী শ্রেণির লোকেরা পাঁচ বিঘা জমি কিনলে দখল করেন ২৫ বিঘা। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় না। ভূমি মন্ত্রণালয় কোনো মামলা করে না। সেই দখল করা জায়গার একটা বড় অংশ হচ্ছে সরকারি এবং দরিদ্রদের জায়গা। দরিদ্ররা মামলা চালাতে পারে না, আদালতে যেতে পারে না, বিচার চাইতে পারে না। তার জন্য কোনো প্রতিকার নেই। এগুলো কি ভূমি অপরাধ নয়? এগুলোই তো আসল ভূমি অপরাধ। কিন্তু এই আইনে ভূমি অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে; যার কোনো কাগজ নেই, সেই অপরাধী। তার মানে ভোলা, পটুয়াখালী, রামগতি, লক্ষ্মীপুর কিংবা নোয়াখালীর চরে বসবাসরত ভূমিহীন নদীভাঙা পরিবারের কাছে যেহেতু কাগজ নেই, তাই তাদের উচ্ছেদ করা হয়। তাদের উচ্ছেদ করে ওই জায়গা লিজ দেওয়া হয় বড় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান অথবা প্রকল্পকে, যা কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
সরকারি প্রকল্প বা উন্নয়নের নামে আমরা প্রতি বছর এক শতাংশ করে কৃষিজমি হারাচ্ছি। যদিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে যে, দুই বা তিন ফসলি জমি প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। এখনও পর্যন্ত এই আদেশ বহাল আছে। কিন্তু এই আদেশ বহাল থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রতিদিনই দেখছি যে আমাদের কৃষিজমি কমে যাচ্ছে এবং অকৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এই আইনের কোনো কার্যকারিতার জায়গা আমি দেখছি না। এই আইনের ৪৯ ধারায় দায়মুক্তির কথা বলা আছে। এই দায়মুক্তি কিসের দায়মুক্তি? এটি কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইন যে, রাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করা যাবে না? যাঁরা অন্যায়-অপরাধ করেন, তাঁদের নিশ্চয়ই ভূমি প্রশাসনের লোকজনই পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কেননা এই কাজ সাধারণ কোনো মানুষ করতে পারবেন না। অবশ্যই তাঁদের সহযোগিতা লাগবে। এই আইন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি করলে ভূমি বঞ্চনা এবং ভূমি বৈষম্য আরও বহুগুণে বেড়ে যাবে। এতে ভূমিহীন, দরিদ্র এবং সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার লঙ্ঘিত হবে।

অধ্যাপক রিজওয়ানুল ইসলাম

আমরা সবাই জানি, এ দেশে দেওয়ানি মামলার সংখ্যা বেশি। বলা হয়ে থাকে শতকরা ৮০ ভাগ দেওয়ানি মামলাই কোনো না কোনোভাবে ভূমি-সংক্রান্ত। আমাদের দেশে প্রশাসনিক আদালতেও মামলাজট আছে। তাহলে কি আমরা আগামীতে এই প্রস্তাবনা আনব যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি নিয়ে যে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আছে, তাতেও মামলা জট আছে; সুতরাং আমরা এটি এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে ছেড়ে দেব? এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ‘কোয়াসি জুডিশিয়াল বডি’ এই মামলা নিরসন করবেন। নিশ্চয়ই আমরা এই ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখব না। সেখানে যদি এটি প্রয়োজন না হয়, ভূমির মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এটি কেন প্রয়োজন– এই প্রশ্নটা আমাদের জোরেশোরে তুলতে হবে।

একজন আইনের ছাত্র হিসেবে আমি বলতে পারি, ভ্রাম্যমাণ আদালত কখনও কখনও কোনো কোনো বিষয়ে প্রয়োজন হতে পারে। এটি ব্রিটিশ আমল থেকেই কোনো কোনো জায়গায় ছিল। কিন্তু এর মূল ধারণাটি হচ্ছে– যেখানে সাক্ষ্য-প্রমাণের তেমন কোনো অবকাশ নেই, সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রযোজ্য হতে পারে। চোখের সামনে কোনো অপরাধ ঘটলে সেই স্থানেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভূমির ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রমাণ এবং তদন্তের প্রয়োজন হয় সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে বিচার করা সম্ভব নয়।

ভূমির মালিকানা নিয়ে শুধু বিভিন্ন অপরাধ হয়, তা কিন্তু নয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বিরোধ থাকে। এখানে কেউই হয়তো অপরাধী নয়, দুই পক্ষেরই হয়তো দাবি থাকতে পারে। এখানে আদালতের দায়িত্ব এই বিরোধ নিষ্পত্তি করা। সেখানে দালিলিক প্রমাণ ও মৌখিক সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাহলে এই ধরনের বিরোধ যে ‘সামারি কোর্টে’ নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়, তা আইনজীবীরা সহজেই বলতে পারবেন।
এই আইনের ৪২ নম্বর ধারায় যে কথাটি বলা আছে, তা হয়তোবা এই আইনের কিছুটা ভালো দিক হলেও হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ভূসম্পত্তির তালিকা করলে তার মধ্যে কতটুকু সরকারি বা আধা-সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে বা কীভাবে তাঁরা বেদখল হলেন– এগুলো তাঁরা লিপিবদ্ধ করতে চান; এর জন্য আলাদা কোনো আইনের প্রয়োজন হয় না। এর জন্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ বা নিজস্ব প্রক্রিয়াই যথেষ্ট। তবে এই আইনে এ বিষয়টি কতটুকু বাঞ্ছনীয়, তা আমার বোধগম্য নয়।

জাল দলিল তৈরি করা বা অবৈধভাবে ভূমি দখল করা– এ দেশের বিদ্যমান আইনের দণ্ডবিধিতে এসব অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। সুতরাং এগুলোর পুনরুক্তি করে নতুন আইন দিয়ে ইতিবাচক ফল আসবে বলে আমার মনে হয় না। এই আইনের ১৮ নম্বর ধারায় অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার কথা বলা আছে। এ ক্ষেত্রে বড় অপরাধী হচ্ছে সরকারি সংস্থাগুলো। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো কথা এতে বলা হয়নি। আমার আশঙ্কা, অনেক ক্ষেত্রে দুস্থ মানুষ যাঁরা উপায় না পেয়ে সরকারি জমিতে বসবাস করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার জন্য প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ হতে পারে এই আইনে।

এই আইনের ভাষ্য অনুযায়ী যদি ধরে নেওয়া হয় যে, মামলাজট দূর করাই এ আইনের প্রধান উদ্দেশ্য। তাহলে কেন আমরা পদ্ধতিগুলোর ওপর হাত দিচ্ছি না? আমরা কেন ‘কোড অব সিভিল প্রসিডিউর’ যা ১০০ বছর ধরে চলছে, সেখানে কেন আমরা সংশোধনীর কথা চিন্তা করছি না? যদি বিচারকের অপ্রতুলতা সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে আরও বিচার বিভাগীয় বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। একইসঙ্গে আমরা আইনের পদ্ধতিগত সংস্কার করতে পারি। সে ক্ষেত্রে আমরা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে পারি।

তবারক হোসেইন

এই আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে মূলত আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য। পাকিস্তানি আমলে যখন আমাদের রাজনীতিবিদরা বক্তব্য দিয়েছেন, তখন সবাই লালফিতার দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সেই লালফিতার দৌরাত্ম্য বলতে তাঁরা আমলাতন্ত্রকেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা সেই আমলাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছেন। এটি এই জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের। সেই আমলাতন্ত্র তাঁদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য আজ ‘দুঃসাহসিক চেষ্টা’র অংশ হিসেবে এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ আইনটা পাস হলে আমাদের শতবর্ষীয় অনেক আইন তার কার্যকারিতা হারাবে। এই আইনে বলা আছে, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করে রায় দিয়ে তা বাস্তবায়ন করবেন। এতে কোনো সাক্ষী লাগবে না, কাউকে জেরাও করা যাবে না। আমার কাছে এই আইনকে সোজা কথায় জঙ্গলের আইন মনে হয়েছে। একজন মানুষকে তাঁর স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য আমাদের প্রচলিত আইনের বিধান অনুযায়ী, সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়। সেই সাক্ষী কতটুকু সত্য বলছেন সেটি নিরূপণ করার জন্য তাঁকে জেরা করা হয়। হাকিম সেই পুরোটা শোনার পর তা বিচার করেন। তাঁর কথা সত্য প্রমাণিত হলেই অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতে এর কোনো বিধান থাকে না।

অস্ত্র আইন অনুযায়ী, গৃহকাজে ব্যবহৃত একটি দাকে অপরাধের কাজে ব্যবহার করার আগ পর্যন্ত তা কিন্তু অস্ত্রে পরিণত হবে না। তবে এই আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, রান্নাঘরের বঁটিটা রাখাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কারও বাড়ি জঙ্গলের কাছে থাকা কোনো ব্যক্তির ঘরে হিংস্র পশু তাড়াতে যদি একটা লাঠিও থাকে, সেটি অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবে এই আইনে। এভাবে এত অপরিপক্ব আইন প্রস্তাব বা প্রণয়ন হতে পারে, যা আমার বিবেচনায় মনে হয়, আমরা বোধহয় মূর্খের স্বর্গে বাস করছি। এই আইনের ২৩, ২৭ এবং ২৯ ধারার নিচের দিকে বলা আছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯-এর আওতায় আনা
যেতে পারে। এই আইনের সঙ্গে সঙ্গেই যদি আবার ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনও সংশোধন করা হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এই সোনায় সোহাগা করার জন্যই এ প্রস্তাবটা রাখা হয়েছে। এই আইন আমলাতন্ত্রের কাছে দেশের মানুষকে বন্দি করার একটা ষড়যন্ত্র।

মো. আশরাফ আলী

এই আইনে বিরোধগুলোকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে এর জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। সব বিরোধই কিন্তু অপরাধ নয়। কেননা ভূমিসংক্রান্ত যতগুলো বিরোধ আমাদের মধ্যে হয়ে থাকে, সব বিরোধই অপরাধের মধ্যে পড়ে না। কিছু আছে অপরাধ, কিছু আছে বিরোধ। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানি আদালত রয়েছে। অপরাধের ক্ষেত্রে পেনাল কোড রয়েছে, যার আওতায় বিচার করা হয়। তবে প্রস্তাবিত আইনে বিরোধগুলোকে অপরাধের মধ্যে সংজ্ঞায়িত করে এর জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। সর্বোপরি বিরোধ ও অপরাধকে এ আইনে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে।

এ আইনে অনেক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই আইনের ২-এর ১০ নম্বর ধারায় দলিল বা দলিলাদি সম্পর্কে বলা আছে, ভূমি হস্তান্তরের লক্ষ্যে নিবন্ধিত যে কোনো মোক্তারনামা, নকশা, খতিয়ান, নামজারি– এগুলো দলিল হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব কাগজপত্র মালিকানার দলিল হিসেবে গণ্য হয় না। এগুলো কোনো মালিকানার দলিল নয়। এই দলিল বা দলিলাদি কথাটি আইনটির বিভিন্ন ধারায় প্রয়োগ করা হয়েছে।

সভাপতি ও সঞ্চালনা

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানবাধিকার
সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন

স্বাগত বক্তব্য
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল

মূল প্রবন্ধ
অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আলোচক

অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
প্রধান নির্বাহী
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)

শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)

রিজওয়ানুল ইসলাম
অধ্যাপক, আইন বিভাগ
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

অ্যাডভােকেট তবারক হোসেইন
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ব্যারিস্টার মো. আশরাফ আলী
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

অনুলিখন
মাজহারুল ইসলাম রবিন
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল

স্থিরচিত্র ধারণ
মাহবুব হোসেন নবীন
চিফ ফটো জার্নালিস্ট, সমকাল

সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্টস, সমকাল