- সমতা
- 'পড়াশোনা আর সংসার চালাতে খেয়া বাই'
'পড়াশোনা আর সংসার চালাতে খেয়া বাই'

'পড়াশোনা আর সংসার চালাতে খেয়া বাই। সকাল হলেই যাত্রীর অপেক্ষায় বসে থাকি। একজন যাত্রী এলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। মায়ের মুখটা এখন আর মনে নেই। বাবা বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। তাই আমাকেই খেয়া নৌকার বৈঠা হাতে নিতে হয়েছে। খেয়া চালিয়ে যা পাই, তা দিয়েই চলে আমার পড়াশোনা আর সংসার।' কথাগুলো পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার চরবাসড়ী গ্রামের হাফসা আক্তার মনিরার।
কাউখালী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। দরিদ্র বাবার একমাত্র মেয়ে। কাউখালী উপজেলা সদর থেকে সামান্য পূর্বদিকে সন্ধ্যা নদী থেকে উঠে আসা চিড়াপারা খালের খেয়াঘাট। ওই ঘাটে মনিরা খেয়া পারাপার করে। যে বয়সে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা করার কথা, সে সময়ে ক্লাসের আগে-পরে সময়টা তার কাটে ওই ঘাটে খেয়া বেয়ে। আয়ের টাকা দিয়ে খাতা-কলমসহ শিক্ষা উপকরণ কেনে মনিরা। বাকি টাকা ব্যয় করে বাবা ও তার ভরণপোষণে। স্কুলের সময় তার বাবা মনির হোসেন খেয়া বেয়ে থাকেন। রান্নাসহ সংসারের সব কাজ করতে হয় মনিরাকে।
খেয়াঘাটে মনিরার সঙ্গে দেখা হয় এ প্রতিবেদকের। এ বয়সে কেন খেয়া নৌকার হাল ধরলে? জবাবে মনিরা জানায়, 'পড়াশোনা করতে হবে, আর খেয়ে-পরেও বাঁচতে হবে। তাই স্কুলের ফাঁকে এ কাজ করছি।' কথা বলতে বলতে ঘাটে এসে উপস্থিত হলেন আব্দুল জলিল ও আমিনা দম্পতি। তাঁরা খেয়া পার হবেন। খেয়া নৌকায় উঠতেই জলিল বলেন, 'মনিরার খেয়ায় পার হতে ভালো লাগে। ওর হাসিমুখ দেখলে আমরাও খুশি হই। চেষ্টা করি সব সময় পারিশ্রমিকের চেয়ে বেশি দিতে।' জলিল ও আমিনা দম্পতিকে পার করে দিয়ে মনিরা ফিরে আসে।
মনিরা তার জীবনের গল্প বলে। চর বাসরীর ঘাটেই মনিরাদের বাড়ি। পলিথিনের বেড়া, ওপরে টিনের জীর্ণ কুটির। ঘরে আছে শুধু একখানা খাট। ওই খাটেই বসে মনিরা পড়াশোনা করে এবং বাবাকে নিয়ে ঘুমায়।
জীর্ণ কুটিরের সামনেই বাবাকে পাশে নিয়ে মনিরা বলে, 'বাবা শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় দেড় বছর বয়সে মা পলি বেগম আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। প্রায় রাতেই মায়ের জন্য কাঁদি। কিন্তু কী করব? মা আর ফিরে আসবে না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। তাই অসুস্থ বাবাকে নিয়েই চলছি।'
কাউখালী উপজেলা শাখা সমকাল সুহৃদ সমাবেশের সভাপতি আব্দুল লতিফ খসরু বলেন, 'পাশেই আশ্রয়ণের শিশুদের মধ্যে বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে গিয়ে নজরে আসে মেয়েটি। ওর সঙ্গে কথা বলে ওর জীবন-সংগ্রামের তথ্য পেয়েছি। ওর কথা শুনে স্কুল ড্রেস, শিক্ষা উপকরণ, ভালো জামা-কাপড় কিনে দিয়েছি। ঘরটি বসবাসের অনুপযোগী; নেই চেয়ার-টেবিল। ওর সম্পর্কে সবকিছু জেনে আমার মনে হচ্ছে, সমাজের অর্থশালী মানুষ ওর পাশে দাঁড়ালে মনিরা একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।'
কাউখালী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, 'মনিরা লেখাপড়ায় খুবই ভালো ও মনোযোগী। আমরা আমাদের সাধ্যমতো ওর জন্য চেষ্টা করছি। ওর মেধা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলে দেশের কল্যাণে আসবে।'
কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. খালেদা খাতুন রেখা বলেন, এমন খবর তিনি জানেন না। তিনি ওই এলাকার পুরুষ ও নারী ইউপি সদস্যদের ফোন করে কথা বলেন। এর পর ইউএনও বলেন, 'ওর জন্য যতটুকু সম্ভব, সবই করব।'
মন্তব্য করুন