ছেলেবেলায় ইন্দোনেশিয়াকে চিনেছি দারুচিনি দ্বীপ বলে। সানাউল্লাহ নূরীর দারুচিনি দ্বীপের দেশে ভ্রমণকাহিনির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। তখন বুঝিনি কেন দারুচিনি ডাকা হয় তাঁকে। তারপর ধীরে ধীরে যখন ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় হলো, তখন জেনেছি গোলমরিচের কথা। যে গোলমরিচের লোভে ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে এসেছিল, তার আগে আরবরা। সবচেয়ে ভালো গোলমরিচ পাওয়া যেত মালাক্কা প্রণালির দ্বীপপুঞ্জে। ডাচরা সে জন্য ভারত থেকে চলে যায় বাটাভিয়ায়। সেদিনের বাটাভিয়াই আজকের জাকার্তা, যা ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী।

নারকেল গাছ, নীলাভ জলরাশি, সবুজ ধানক্ষেত, সমুদ্রের ঢেউ, সুশীতল হাওয়া– সব মিলিয়ে দ্বীপকন্যা বালি। এটি ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রদেশ। বালিকে ঘিরে রেখেছে সমুদ্রসৈকত প্রবালপ্রাচীর, জলপ্রপাত, নানা ঐতিহ্যপূর্ণ স্থাপনা, পুরাণ, ইতিহাস, উপকথা, কিংবদন্তি আর ছোট-বড় আগ্নেয় পর্বতমালা। সেখানে আমারও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সমুদ্রসৈকত এই দ্বীপশহরে সৈকতের অভাব নেই। নুসা দুয়া সাগর সৈকত, বালির অভিজাত এলাকায় এর অবস্থান। আট দিনের ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে পাঁচ দিন ব্যয় করেছি বালিতে। ঘুরে বেরিয়েছি তিনটি সৈকতে। সেখানকার ফুল, বৃক্ষরাজি, দূরের বন, আকাশের রং আর নীল সাগর আপনাকে অন্য পৃথিবীতে নিয়ে যাবে। বালির কুটা বিচ একটি মুখরিত প্রাঙ্গণ। পাতাই প্যানোয়া সৈকতও ভীষণ জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে। চারধারের দৃশ্যটা কিছুটা এ রকম– কেউ ছবি তুলছে, কেউ সার্ফিং করছে, কেউবা বালিয়াড়িতে উদোম শরীরে রয়েছে। মহাসাগরের তলদেশে বালির ওশান ওয়াক ঠিক স্কুবা ডাইভের মতো নয়, আপনাকে সাঁতারও কাটতে হবে না। মহাসাগরের তলদেশে আপনি হেঁটে বেড়াবেন, রংবেরঙের মাছের সঙ্গে কথা বলবেন। ১৫ ফুট নিচে গিয়ে আপনি উপভোগ করতে পারবেন মহাসাগরের তলদেশ। বালির বিভিন্ন সৈকত থেকে এই আয়োজন করা হয়। তানজুং বেনোয়া নামক স্থান থেকে এই মহাসাগরের তলদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম। এ সময় একটি বিশেষ ধরনের আঁটসাঁট কিন্তু বেশ হালকা ধরনের পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয়। তার পর শরীরে বেশ কিছু ওজনযুক্ত করা হয় পানির নিচে যাওয়ার জন্য এবং একটি বিশেষ ধরনের সি-ওয়াকার হ্যালমেট দেওয়া হয় ঠিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য। পানির নিচে ছবি তোলার, ভিডিও করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ জন্য টিকিট করা ছাড়াও কিছু অতিরিক্ত পয়সা গুনতে হবে। মহাসাগরের তলদেশে গিয়ে দেখলাম, আসলেই তো হেঁটে বেড়াচ্ছি। চারদিকে নানা রঙের মাছ, শৈবাল, জলজ উদ্ভিদ। ব্যারং নৃত্য ‘ব্যারং’ নৃত্য বালির অন্যতম প্রাচীন এক নৃত্যরীতি। এই নৃত্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে বালির উত্তর প্রান্তে। ডেনপাসার বালি প্রদেশের রাজধানী। শহর ছেড়ে এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে দেখেছিলাম এই ট্র্যাডিশনাল ডান্স । শুভ-অশুভর চিরন্তন লড়াইয়ের নৃত্যরূপ হলো ব্যারং। ব্যারং নৃত্যের একটা মূল বৈশিষ্ট্য হলো, এর সংগীত ও এতে ব্যবহৃত মূল বাদ্যযন্ত্রটি হলো গ্যামেলান। সাংস্কৃতিক রাজধানী উবুদ ও লুওয়াক কফি ফার্ম উবুদ গ্রাম কিংবা উবুদ প্রদেশ যাই বলি না কেন, এই অঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর পর একে আমার বালির সাংস্কৃতিক রাজধানী মনে হয়েছে। অলিগলিতে ছড়িয়ে হস্তশিল্পের দোকান। কাঠের শিল্পসামগ্রী, পাথরের মূর্তি, রুপার গহনা, আর্ট গ্যালারি ও বাটিক প্রিন্টের কাপড়। উবুদ ছাড়িয়ে খানিকটা গেলেই ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত লুওয়াক কফি ফার্ম। সেখানে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে এক তরুণী এই কফির আদ্যোপ্রান্ত বর্ণনা করতে লাগলেন। এশিয়ান পাম সিভেট (স্থানীয় ভাষায় লুওয়াক, বিশেষ ধরনের খরগোশ) বাগানের গাছ থেকে কফির দানা খায় আর তার মলের সঙ্গে সেই দানাগুলো বেরিয়ে আসে অবিকৃত অবস্থায়। সেই দানাগুলোকেই ফার্মে এনে যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে তৈরি হয় এই কফি। কেজিপ্রতি প্রায় ৮০০ ডলার! উলুওয়াটু মন্দির থেকে সূর্যাস্ত দেখা বালি ভ্রমণে গেলে উলুওয়াটু সানসেট পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত না দেখলে বালি ভ্রমণ সম্পন্ন হবে না। জায়গাটি সাগরের পাশেই অনেক উঁচু একটি পাহাড়। নিচে সাগরের পানি এসে পাথরে আছড়ে পড়ছে। সাগর, পাহাড়, সবুজ বনানি সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। উলুওয়াটুর এই জায়গাটি বালি সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নাচ কেকাক পরিবেশনার জন্য বিখ্যাত। সূর্যাস্তের পর পরই কেকাক নাচ শুরু হয়। কেকাকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ আয়োজনে কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয় না। এ সময় ৬০ জনের মতো বালিনিজ পুরুষ তাদের মুখ দিয়ে একই তালে আওয়াজ করতে থাকে। মঞ্চে মূলত সংলাপহীন সংক্ষিপ্ত রামায়ণ মঞ্চস্থ হয়। ব্রাটান লেক ও উলুনদানু মন্দির বালির পাহাড়ি উপত্যকা বেদুগুল। এখানকার মূল আকর্ষণ দুটি ব্রাটান লেক ও উলুনদানু মন্দির। বালি শহরের দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক ব্রাটান। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১২০০ মিটার ওপরে। বালির অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট এই ব্রাটান লেক। পুরো বালি শহরে পানির মূল সোর্স লেক ব্রাটান। এর আয়তন ৩৫০ হেক্টর। এই লেকের তীরবর্তী মন্দির উলুনদানু। এখানে রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের নামাঙ্কিত তিনটি মন্দির। বালির মন্দির প্রাঙ্গণগুলোতে আরেকটি স্থাপত্যের কথা উল্লেখ না করলেই নয় সেটি হলো, এক বা একাধিক দ্বিখণ্ডিত দরজা, স্থানীয় ভাষায় ‘কান্ডি বেন্টার’। আরও কত গন্তব্য রয়েছে বালিতে। গোয়া গাজাহ মন্দির, বাটুর পর্বতে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, মাংকি টেম্পল, টার্টেল আইল্যান্ড, তামান ত্যায়েন মন্দিরের গল্প না হয় অন্য কোনো অবসরে বলব। জরুরি কিছু কথা বালিতে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে ট্রানজিট নিয়ে যেতে হয়। মাস দেড়েক আগে প্ল্যান করলে এয়ার টিকিটের দাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো লাগবে। বাংলাদেশ থেকে মালিন্দো, এয়ার এশিয়ার ফ্লাইট বালি যায়। যাওয়ার আগে ভিসা করার প্রয়োজন নেই। হোটেল বুকিং ও রিটার্ন এয়ার টিকিটের প্রিন্ট কপি ইমিগ্রেশনে জমা করলে ৩০ দিনের ভিসা পাওয়া যায়। 

বিষয় : দ্বীপকন্যা বালি

মন্তব্য করুন