
যে মৃণাল ফুটেছিল একশ বছর আগে, তার তরঙ্গ আজও সিনেমাসমুদ্রে ঢেউ তোলে, তরঙ্গায়িত করে সিনেমাপ্রেমীদের। আজকালকার মতো বক্স অফিসের পেছনে ছোটা নয়, জনতুষ্টির তোয়াক্কা নয়, রাষ্ট্রক্ষমতাকে তোয়াজ নয়; এক দুর্দমনীয় সাহস, বিপন্ন বিস্ময় আর মানুষের জন্য অদম্য মমতা লালন করে, শিল্পকে তিনি করে তুলেছিলেন নিজের প্রতর্ক হাজির করার এক মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে। যে সময়ে তিনি শিল্প সৃষ্টিতে ব্রতী হয়েছিলেন, সেটি ছিল ভীষণ উত্তাল সময়। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক, শুধু উপমহাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, বিস্ফোরণে জানান দিচ্ছিল নতুন সময় সমাগত। সমকালের শিল্পীরাও সেই অদূর পরিবর্তনের স্বরধ্বনির সঙ্গে কোরাসে মিলিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। মৃণাল সেন সেই সময়েরই শিল্পী। সেই সময়েরই এক বিস্ফোরণোন্মুখ চলচ্চিত্র নির্মাতা। নতুন শতকেও তিনি সিনেমা বানিয়েছেন, তবে তা শুরুর তিন দশকের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে, ১৯২৩ সালের ১৪ মে জন্ম নেওয়া ক্ষণজন্মা মৃণাল সেনের কিশোরকাল কেটেছে অধুনা বাংলাদেশেই। ১৯৪০ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর ছেড়ে তিনি কলকাতায় যান, তখন তিনি সতেরো। ফরিদপুরে থাকতেই বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতায় কলেজে ভর্তির পর সেই সম্পৃক্ততা আরও বাড়ে। বোর্ডিং স্কুলের দিনগুলোতে হাজতবাসও হয় তাঁর। এমন পোড় খাওয়া মানুষ, যিনি কৈশোরে জন্মভিটা ছেড়েছেন, যুগের যন্ত্রণা দেখেছেন এবং হাজতবাস করেছেন, তাঁর হাত দিয়ে আগুনচাপা ছবিই তো হবে।
যদিও প্রথম দুটি ছবি ‘রাতভোর’ (১৯৫৫) ও ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯) নিয়ে নিজেই অতটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবে তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) থেকে মৃণাল যেন রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে শুরু করেন বড় পর্দায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পান তিনি। কানাই বসুর কাহিনি থেকে নির্মিত এই ছবিতে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষকে মৃণাল দেখিয়েছেন এক দম্পতির করুণ সমাপ্তির ভেতর দিয়ে। সেই প্রিয়নাথ ও মালতির সাজানো গোছানো সংসার এক ঝড়ের ধাক্কায় শেষ হয়ে যায়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষের কারণে। এর পরিণতি মালতির আত্মহত্যা। মৃণাল এই কাহিনির ফাঁকেই বলতে ভোলেন না, প্রিয়নাথের পূর্বপুরুষেরা এক সময় ছিলেন ভোগবাদী, অত্যাচারী ও অনাচারী। তারই ফলে এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়নাথ। কি দারুণ রাজনৈতিক রূপক ব্যবহার করলেন মৃণাল।
এই ছবির পর মৃণালের বক্তব্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মাইলফলক যদি বলি তো সত্তরের দশকে এসে তাঁর কলকাতা ত্রয়ী ও অন্যান্য ছবির কথা বলতে হয়। বিশেষ করে ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০), ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) ও ‘পদাতিক’ (১৯৭৩) এই ত্রয়ীর পর কোরাস (১৯৭৪)– এই চারটি ছবি যেন ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক জড়তা, রাজনৈতিক সংকট, তারুণ্যের আদর্শিক অঙ্গীকার ও স্বপ্নভঙ্গ এবং দ্রোহের মন্ত্র নিয়ে উচ্চারিত হলো। বুর্জোয়া ও পাতিবুর্জোয়া কিংবা মুৎসুদ্দিদের নির্লজ্জ লোভলালসাকে তীক্ষ্ণ দৃশ্যভাষায় আক্রমণ ছাড়াও মৃণাল আঙুল তুলেছেন মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা, স্বার্থপরতা ও পলায়নপর মানসিকতার দিকেও। ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) ছবিতে যে মেয়েটি সারারাত ঘরে ফেরেনি, তাকে ঘিরে যে শঙ্কা-রাগ-সন্দেহ তাতে মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্র স্পষ্ট। অন্যদিকে ‘খারিজ’ (১৯৮২) ছবিতে কাজের ছেলেটি মারা গেলে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত দম্পতির পালাবার পথ খুঁজবার যে দৃশ্যায়ন, সেটিও সেই শ্রেণির বৈশিষ্ট্যকেই ইঙ্গিত করে। মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা, পলায়নপর মনোবৃত্তি ও সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করার এক দারুণ আখ্যান হিসেবে হাজির করা যেতে পারে ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩) ছবিটিকে। যেখানে দেখা যায় এক শহুরে চিত্রগ্রাহক গ্রামে গিয়ে বিবাহযোগ্যা এক মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে শহরে ফিরে আসে এবং নিজের তোলা মেয়েটির একটি ছবি টাঙিয়ে রাখে নিজের স্টুডিয়োতে। বলাবাহুল্য নয়, যুবকটি আর গ্রামে ফিরে যায়নি, কারণ সে বন্ধুর সঙ্গে দু’দিন ছুটি কাটাতে গিয়েছিল সেখানে। এভাবে ধরে ধরে মৃণাল সেনের তৈরি করা ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে হয় তো আলোচনা করা যাবে, তা থেকে ওই একটি বাণীই প্রতিধ্বনিত হবে, তা হলো সত্য বলা ও প্রতিবাদ করতে পারাটাই শিল্পীর স্বাধীনতা।
এই মতের সঙ্গে যে সবার একমত হতে হবে, তা কিন্তু মনে করতেন না মৃণাল। মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকবেই। তাই নিজের ছবি নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে মৃণাল বলেছিলেন, ‘মার্কস এঙ্গেলস লেনিনের নামে একই দেশে সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রশ্নে যদি এক ডজন দল গড়ে উঠতে পারে তাহলে আমাদের মতো ছবি-করিয়ের দলের ভাবনাচিন্তায় দেশের সমস্ত মানুষ একমত হবেন এটা আশা করা বাস্তব অবস্থাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা। বরং আমাদের কোনো ছবি যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে বা সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কোনো তর্ক তুলতে পারে, তাহলে বলব ছবি করিয়ে হিসেবে আমাদের চেষ্টা সার্থক।’
নিজেকে ‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’ বলতেন মৃণাল। তাই হেগেলের সূত্রে মার্কসবাদে প্রবেশ করা দার্শনিকতা ও দ্বান্দ্বিক বিচারকে নিজের শিল্প সৃষ্টির এক অন্যতম হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন মৃণাল। ছবি বলতেই তিনি বুঝতেন ‘ডায়ালেকটিকস’। যেখানে দর্শক ভিজুয়াল ও ওরাল পারসেপশনের ভেতর দিয়ে একটি ইন্টেলেকচুয়াল পারসেপশনে পৌঁছুবে। এই চিন্তা মৃণাল পেয়েছেন সোভিয়েত চিত্রপরিচালক আইজেনস্টাইনের কাছ থেকে। ইন্টেলেকচুয়াল পারসেপশনের বাংলা মৃণাল করছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শব্দ ধার করে–চৈতন্য। মৃণাল মনে করেন, দর্শক চোখে দেখা ও কানে শোনার মধ্য দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে, চৈতন্য দিয়ে একটি দৃশ্যের মর্মার্থ উদ্ধার করবে। কবিতার পাঠক যেমন তাঁর বুদ্ধি খাটিয়ে, তাঁর সৃজনী শক্তি দিয়ে, তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে বইয়ের পাতার সেই আক্ষরিকতার আড়ালে আত্মিক আবহাওয়াটির আমেজ পেয়ে থাকেন, ঠিক তেমনি সিনেমার দর্শকও তাঁর বুদ্ধি ও হৃদয় দিয়ে ছবি ও শব্দের সীমানা পেরিয়ে ‘চৈতন্যে’র রাজ্যে প্রবেশ করেন।
তবে বর্তমানের মুক্তবাজার অর্থনীতির মোড়কে যেভাবে বড় পুঁজির ছবি অপেক্ষাকৃত ছোট বাজারের ওপরও হামলে পড়ছে, সেখানে মৃণালের কাঙ্ক্ষিত চৈতন্য নিয়ে খুব কম নির্মাতাই কাজ করেন। কারণ এখন বিশুদ্ধ শিল্প বলি, বা মানুষের জন্য শিল্প বলি, কোনোটাই নেই। কলাকৈবল্যবাদ যেমন বিদায় নিয়েছে, তেমনি অস্ত গেছে গণমানুষের জন্য শিল্পসৃষ্টির তাগিদ। তার জায়গায় এসেছে বাণিজ্যিক ও আধাবাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাতারা। বুদ্ধি ও হৃদয় নিয়ে দর্শক যেন চলচ্চিত্রে ‘চৈতন্য’ আবিষ্কার করতে পারে সেরকম ছবির নির্মাতা এখন কোথায়? আসলে গত শতাব্দীর সে এক সময় ছিল, যখন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, সুভাষ দত্তরা ছিলেন। তাঁরা জানতেন, উজানে কেমন করে নৌকার বৈঠা ঠেলতে হয়। ইদানীং প্রায় সকলেই দেখি ভাটি গাঙের নাইয়া।
লেখক: চলচ্চিত্র বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন