প্রযুক্তির তুমুল ঝড়ের ভেতর তথ্য ও প্রজ্ঞার সংকেতকে আলাদা করা অত্যন্ত দুরূহ। ইমেজ ও সংকেতের দুনিয়ায় তাই চিত্রশিল্প এখন সম্ভবত একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে জনপ্রিয়তার সংকট, পুঁজির প্রবল প্রতাপে শৈল্পিক নিভৃতির বিলুপ্তি আর সামাজিক যোগাযোগের অতি প্রবৃদ্ধির উৎপাতে গভীর নিজস্বতায় চিত্রশিল্পের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ এবং শিল্পীত জীবন যাপন এই সময়ে তাই সাইবার যুদ্ধের মতোই জটিল ও সার্বক্ষণিক। 

আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এই যুদ্ধের জন্য ভবিষ্যতের সৈনিকদের কতটা চৌকস করে তুলতে পারছে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এই যোদ্ধাদের মূল অংশ প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্নকরে মাঠে নামেন। শিল্পী ফাইম ইসলাম লিমন এমনই এক যোদ্ধা যিনি সদ্যই প্রশিক্ষণ সম্পন্নকরে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন। তার শিল্পকর্মে তাই বহুমুখী ভাব, বহু মাধ্যমের ব্যবহার ও বিচিত্র উপস্থাপন পন্থা একটি লক্ষ্যণীয় বিষয়। রাইজোমেটিক জামানায় একক ভাবনায় স্থির থাকা অতি বড় সাধকের পক্ষেও দুষ্কর। তাই বহুকেন্দ্রিকতার ন্যারেটিভে ফাইমের আস্থাকে সময়ের প্রতিফলন বলেই মনে করা যায়। শিল্পের সঙ্গে যুদ্ধ ব্যাপারটি কিছুটা অশালীন শোনাতে পারে। তবে শিল্পী ফাইম ইসলাম লিমনের কাজ এমন শব্দ চয়নে উদ্বুদ্ধ করেছে। তার প্রস্তুতি পুরোদস্তুর যোদ্ধার মতো, এবং সেই যোদ্ধার চিন্তায় বারুদে ঠাসা কিছু চিত্রকর্মের হদিস পাওয়া যাচ্ছে।

শিল্পী ফাইম ইসলাম লিমনের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে চলছে ২০ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত।

তার মোরগের লড়াই, মকরের নিষ্ঠা, ঈগলের শিকার, কুটিল দাবার চাল, গণিতের সূত্র আর আক্ষরিক অর্থেই রাশিচক্রে বসে থাকা সাধকের হাতে দেখা যায় ফুলের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ গ্রেনেড, যার মাথার ভেতরেও মগজের পরিবর্তে গোলা-বারুদের স্তুপ। শিল্পী জানেন যুদ্ধ অনিবার্য তাই রাশিচক্রের বৃত্তে বসেও শুধু ভাগ্যের বশীভূত না থেকে জানতে হয় বিজয়ের কৌশল। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের টানাপোড়েনে তৈরি হয়েছে তাঁর শিল্পের জমিন। শিশুর সারল্য নিয়ে যে পৃথিবীকে দেখতে চায় সেখানে জটিল গণিতের সূত্র তাকে ক্রমাগত জড়িয়ে ধরছে। যাপিত জীবনের বিবিধ সমীকরণের সমাধান তাই এখন উপেক্ষা করার মতো কোনো বিষয় নয়। পাজল হয়ে যাওয়া মগজে ঘুরছে অসংখ্য হতবুদ্ধিকর সমাধানের ইশারা। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এসব ধাঁধার সমাধান কি কেউ করতে পারে? জাগতিক বাস্তবতাকে তার ভাগ্যচক্র কি ঘুরিয়ে দিতে পারে? ভাগ্যচক্র ও নির্মোহ নান্দনিক জীবনের পাজলে বিগড়ে না যাওয়ার কৌশল তাই শিল্পীকে রপ্ত করতে হয়। কেবলি প্রতিরূপায়নের যুগ সমাপ্ত হয়েছে আগেই, তাই শিল্পীর ভাষা বদলে এখানে প্লুরালিটির যথার্থ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। শিল্পী জানেন তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে বেঁচে থাকাটা একটা দৈনন্দিন লড়াই। আর শিল্পের সাথে বেঁচে থাকা এক তুমুল যুদ্ধ। তাই তেজি মোরগের সিংহাসনে আরোহনের মাধ্যমেই নির্দেশনা প্রদান করতে হয়। কিন্তু এই লড়াইয়ে সবাই পাড় হতে পারে না। কেউ কেউ ঝুলে থাকে মৃত্যুর হীমশীতল আত্মহনন অথবা আততায়ীর নির্মম রজ্জুতে। কেউবা বোতল বন্ধি হয়ে পড়ে থাকে লড়াইয়ের অন্ধকার মাঠে। হতবুদ্ধির পাজলে নিজেরই মাথা আটকে গেলে এই ধাঁধার সমাধান হবে কেমন করে? শিল্পী জানেন এখানে রাশিচক্র ঠিক কাজ করবে না। ভাগ্য তাকে এই দুর্জ্ঞেয় সমস্যা থেকে মুক্ত করার সামর্থ্য রাখে না। তাই মগজের ধোঁকা থেকে বেরুবার পথ হিসেবে তিনি একেছেন অধ্যাবসায়ের সাধন-চক্র। যেখানে তাসের ইউরোপীয় রাজা-রাণী নয়, তাকে পথ দেখাতে পারে হরপ্পার হাতে গড়া মাটির পুতুল। অন্তত পাঁচ হাজার বছরের সাধনাকে কেউ চাইলেই ভুলিয়ে দিতে পারে না। মকর রাশির জাতক শিল্পী ফাইম ইসলাম লিমন বাস্তববাদী, সতর্ক ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান বলেই আরো ভালো করে জানেন তাঁর শৈশব ছিনিয়ে নেয়া শিকারি ঈগলের কাছে মিনতি করে কোনো লাভ নেই। পশ্চিমা পাঠক্রমে পৃথিবী দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর উপলব্ধি এখানে নিজস্ব ঐতিহ্যের সাথে ক্রমাগত চলছে বিভিন্নমাত্রায় দাবার চাল। বেনারসি, মসলিন আর সওদাগরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে কেউ ফিরিয়ে দেবে না। গাণিতিক নিয়মেই তাকে কাবুকরে লিওনার্দোর ভিট্রুভিয়ান ম্যানের বদলে ফিরিয়ে আনতে হবে বঙ্গীয় পরম্পরায় শুক্রাচার্যের উত্তম নবতাল। যার ফলশ্রুতিতে সূচনা হতে পারে নতুন পথের দিশা। 

শিল্পী ফাইম ইসলাম লিমন তাই এ বিষয়ে সচেতন; ঐতিহ্যের পথে অবগাহনের নামে পশ্চাদপদতার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয় না তার কাজে, বরং সমসাময়িক বৈশ্বিক প্রজ্ঞার পথে তাঁর আত্মপরিচয়ের নিবেদন তৈরি করে সম্ভাবনার নতুন পথরেখা। উত্তরাধুনিক সময়ে পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী কৌশলগুলো ভোতা হয়ে গেছে। এখন এই হাইপাররিয়েল সময়ে চিত্রকলা বা দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবির কৌশল ও প্রজ্ঞার সাথে সর্বশেষ প্রযুক্তির যোগাযোগে তৈরি হবে নতুন এশিয়া, নতুন প্রাচ্য। বঙ্গীয় ধারার সম্ভাব্য নবতর সূচনার কালে শিল্পী ফাইম ইসলাম লিমন তাঁর পাজল সমাধানের মাধ্যমে ডোপামিন বাড়িয়ে দেবার যে প্রয়াস চিত্রকলা মাধ্যমে করেছেন সেটি আমাদের যুদ্ধ যাত্রার অগ্রণী ভূমিকায় বুদ্ধিবৃত্তিক রচনার নজির হয়ে থাকবে। প্রাচীন ভূতের মতো বোতলবন্ধি করে সামনে লোভনীয় বাকল ছাড়ানো কলার নৃত্য করার অংক সবার জানা হয়ে গেছে। ডলার-ইউরোর পাজল খুলে নতুন চালের পরিকল্পনায় ছক সাজিয়ে বসে আছেন নতুন যুগের শিল্পী ফাইম ইসলাম লিমন। মকর রাশির কর্মনিষ্ঠায় রূপ-রস-সত্য-সুন্দর ও ধাঁধায় বিহম্বল সমস্যা সঙ্কুল পৃথিবীর পাজল সমাধানের নান্দনিক দুনিয়ায় শিল্পীকে স্বাগতম।