
সরকারি চিকিৎসকরা কর্মঘণ্টার পর এখন থেকে বিকেলে নিজ হাসপাতালেই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নিবিড়ভাবে রোগী দেখবেন। আগামী মার্চ থেকে এ প্রক্রিয়া চালু হতে পারে। গত রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ফি কত টাকা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া কী হবে- এসবের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির একাধিক সদস্য সমকালকে বলেন, বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকদের এ কাজ করতে হবে বাধ্যতামূলক। তবে প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে হতে পারে দু-এক দিন। রোগী দেখার জন্য আলাদা সম্মানীর ব্যবস্থা রাখা হবে। চিকিৎসকের মান অনুযায়ী এ সম্মানী হতে পারে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত কম সময়ে এটি চালু করা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে যেন রোগী-চিকিৎসকসহ সংশ্নিষ্ট সবার স্বার্থ রক্ষা হয়। পাশাপাশি বেসরকারি খাতনির্ভর স্বাস্থ্যসেবা পরিবর্তনে যেন ভূমিকা রাখতে পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমদ বলেন, সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে অবশ্যই অবকাঠামো ও জনবল সংকট নিরসন এবং আলাদা সম্মানীর ব্যবস্থা রাখা হবে। ২০১১ সাল থেকে বিএসএমএমইউর ২৬ বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কর্মঘণ্টা শেষে এই পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন। এজন্য দুপুর আড়াইটা থেকে বহির্বিভাগের বিশেষ সেবার টিকিট বিক্রি শুরু হয়। শুরুতে অনেকেই এর বিরোধিতা ও সমালোচনা করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিয়ম মেনে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা বিকেলে সংশ্নিষ্ট বিভাগেই রোগী দেখছেন। বারডেম হাসপাতালও একই পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।
নীতিমালার কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপাচার্য বলেন, নীতিমালা প্রস্তুত হতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগবে। বিএসএমএমইউতে চিকিৎসকরা যেভাবে রোগী দেখেন, সেভাবেই প্রস্তাব দেওয়া হবে। যে হাসপাতালে রোগী দেখবেন, সেখানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একজন রোগীর বাইরে ডাক্তার দেখাতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম খরচে ভালো সেবা মিলবে। রোগীরা কম পয়সায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারবেন। যাঁরা ভর্তি আছেন, তাঁরাও চিকিৎসা পাবেন। সরকারি হাসপাতালে একসঙ্গে অনেক ডাক্তার পাওয়া যাবে। এতে সরকারি হাসপাতালে কোনো চিকিৎসককে জরুরি প্রয়োজন হলে তাঁকে পাওয়াটা সহজ হবে। সেই সঙ্গে সরকারি চিকিৎসকরা ধীরে ধীরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নিরুৎসাহিত হবেন। প্রাথমিকভাবে ২০ জেলা ও ৫০ উপজেলা হাসপাতালের পাশাপাশি পাঁচটি মেডিকেল কলেজে পরীক্ষামূলক এই কার্যক্রম শুরু হবে।
এদিকে বৈকালিক সেবা কতটা ফলপ্রসূ হবে এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সব দিক মূল্যায়ন না করেই সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক সেবা চালু করার সিদ্ধান্ত ঠিক নয় বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি হাসপাতালের ভেতরের স্বাস্থ্যসেবা ঠিক রাখা কঠিন হবে। শুধু বিএসএমএমইউর মডেল দেখে কোনো মূল্যায়ন ছাড়া সারাদেশে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা নেই। সাধারণত সুচিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তারের বিপরীতে তিনজন নার্স, পাঁচজন টেকনোলজিস্টের প্রয়োজন হয়। দেশে এই জনবল নেই বললেই চলে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেনিন চৌধুরী বলেন, সকালে যে চিকিৎসকের কাছে ২০ টাকায় রোগী দেখা যায়, বিকেলে সেই চিকিৎসকের কাছে মানুষ ৪০০ টাকা দিয়ে কোনো দেখাবেন? এ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সরকারি হাসপাতালে আরও চাপ বাড়বে। বাড়তি রোগীর সেবা দেওয়ার সক্ষমতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা- এটিও ভেবে দেখা জরুরি। সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের সব মানুষকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেওয়া। এটা যদি সরকারের নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে সম্ভব না হয়, সরকারি ও বেসরকারি জনবল সমন্বয় করা দরকার। তাহলেই স্বাস্থ্যসেবার বিকাশ সম্ভব। সরকারি খাতে যখন সেবা দেওয়া হবে, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ ফির পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ওষুধ ইত্যাদি সরকারিভাবে করার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, এটি ভালো উদ্যোগ। নীতিমালা প্রণয়ন ও পরামর্শ ফি নির্ধারণে কাজ চলছে। খুব শিগগির বৈঠক ডেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। বৈঠক এ সপ্তাহে হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৬ হাজার চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। তবু প্রতিবছর অন্তত ৫ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নেন। সরকারি হাসপাতালে মানসম্পন্ন চিকিৎসার অভাব এবং বেসরকারি হাসপাতালে অত্যধিক খরচের কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
মন্তব্য করুন