বিজয়ের রক্তাক্ত পথ

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২২ । ১১:৫৬ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২২ । ১১:৫৯

মো. শাহিনুর রহমান

১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারত বিভাজনের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমানদের অবদানই যে সর্বাধিক ছিল- এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটি সর্বজনবিদিত পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকে; হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ওপর নব-ঔপনিবেশিকতাবাদী স্টিম রোলার চালানোর কারণে।

পরের বছর ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিদের এ মনোভাবের সর্বপ্রথম নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যখন পাকিস্তানের জাতির পিতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় ঘোষণা করেন :'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সচেতন জনসমাজ জিন্নাহর এ উক্তির চরম প্রতিবাদ জানায়।

১৯৫২-তে যে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির জাগরণ শুরু হয়েছিল, তার অগ্রদূতের ভূমিকায় ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনে শাহাদাত ও জেল-জুলুম বরণকারীর প্রায় সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবী সমাজ সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছে। ১৯৬৬-তে আওয়ামী লীগের দেওয়া ছয় দফা 'বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ' আখ্যা পায় এবং ছয় দফার প্রণেতা শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন 'বাংলার নয়নমণি'। '৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটার পর বাংলার মানুষ শেখ মুজিবকে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করে- যা পরবর্তী জীবনেই শুধু নয়, মৃত্যুর পরও তাঁর নামের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে আছে।

পর্যায়ক্রমিক এই আন্দোলনের ফলে জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। পরবর্তীকালে যা তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীরা একদিকে পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচারের ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করেছেন। অন্যদিকে বাঙালির সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ত্বরান্বিত করেছেন। এসব কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক জান্তার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছিল।

একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে ১৪ ডিসেম্বর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটায়। এ জাতি যাতে শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিক থেকে হীনবল হয়ে পড়ে, এই ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়েই পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। তবে বাঙালি জাতিকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে যুদ্ধের একদম শুরু থেকেই।

অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ২৫ মার্চ কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী গণহত্যার সূচনাই করেছিল শিক্ষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মূল আওয়াজটা যেখান থেকে আসছিল, তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে সে রাতেই হত্যা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ফজলুর রহমান খান, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাসহ বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে।

দেশের অন্যান্য জেলা ও মহকুমা সদরেও একইভাবে রাজনীতিকদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয় মাস রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাও চলেছে সমানতালে। তবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পূর্বক্ষণে পাকিস্তানি এবং তাদের এদেশীয় দোসররা বীভৎসতা ও নারকীয়তার সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। পরাজয় অত্যাসন্ন বুঝতে পেরে ১৪ ডিসেম্বর রাতে তারা তাদের প্রতিহিংসাবৃত্তির চরম পরিচয় দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের বর্বরভাবে হত্যা করে, যার দ্বিতীয় নজির বিশ্বের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

একাত্তরের ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর মাত্র দুই দিনের ব্যবধান ছিল না; প্রতীকীভাবে তা ছিল রক্তের এক সাগর পেরিয়ে একটি জাতির নবজন্মের স্বর্ণতোরণে পৌঁছা। দীর্ঘ ৯ মাস কিংবা আড়াই দশক ধরে একটি দেশের জাতির অনেক আত্মত্যাগ, সংগ্রাম, রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে এক বিশাল অর্জনের সারসংক্ষেপ নিহিত এ দুটি দিনে। ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর প্রভৃতি তারিখকে শুধু দিবস পালনের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে আগামী প্রজন্ম যেন সঠিক ইতিহাস জানার মাধ্যমে এসব দিনের শহীদ মহামানবদের চেতনার ধারা বহন করে বেড়ে ওঠে, সে চেষ্টা আমাদের অব্যাহত শুধু নয়, জোরদার করতে হবে।

জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদানকারী শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যে মৌল চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, যে কোনো মূল্যে তা অক্ষুণ্ণ রাখা হোক।






© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com