
শোকাবহ আগস্ট
ব্যর্থতা ঢাকতে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদকে জড়ানো হয়
সাক্ষাৎকার
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ২০ আগস্ট ২২ । ০২:৩৬ | প্রিন্ট সংস্করণ
হাসানুল হক ইনু

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু। সাবেক তথ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি সমকালকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কামরুল হাসান
সমকাল: বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ- দীর্ঘ এই আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ইনু: বঙ্গবন্ধু সেই নেতা, যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দরজা খুলেছে। তিনি শুধু স্বাধীনতার স্থপতি নন, আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদেরও জনক। গত ১ হাজার বছরে সমগ্র বাংলাদেশে অনেক বীর এসেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পুরো জাতিকে যোদ্ধা জাতিতে পরিণত করে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সেই অপূর্ব রাজনৈতিক কৌশলবিদ, যিনি নির্বাচনী আন্দোলন, গণআন্দোলন, সাংবিধানিক আন্দোলন, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, আইনি লড়াই, সশস্ত্র যুদ্ধের আন্দোলনসহ সব আন্দোলনকে প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আগে হয়নি। কেউ হয়তো যুদ্ধ করেছেন; কেউ অসহযোগ। মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এত বলিষ্ঠ ছিল, সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকেই তিনি 'ছোট বঙ্গবন্ধু' হিসেবে গড়েছিলেন।
সমকাল: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম ও শেষ দেখার স্মৃতি বলবেন?
ইনু: বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে তাঁদের বাসভবনে যাতায়াত ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আমি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৭০ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি আমন্ত্রণ জানাতে যাই। তিনি সম্মতি দেন, বলতে গেলে সেটিই প্রথম দেখা। এরপর সম্মেলন মঞ্চে তাঁকে স্বাগত জানাই ও ভাষণ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়। ওই মঞ্চে পাশাপাশি বসার কারণে কিছু কথাবার্তাও হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে এসে সন্ধ্যার পর হেয়ার রোডের সুগন্ধায় বসতেন তিনি। আমরা যারা ছাত্রলীগ করতাম কিংবা ছেড়ে দিয়েছি, তারা নিয়মিত যেতাম। ১৯৭২ সালের ২৮ মে কৃষক লীগের জন্মলগ্নে আমাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এরপর জুন-জুলাই পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয়েছে।
সমকাল: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে জাসদ- দীর্ঘদিন ধরে এমন বিতর্ক চলে আসছে। এর দায় কি জাসদ এড়াতে পারে?
ইনু: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করলে স্পষ্ট, তাঁকে কোনো জাসদ নেতা হত্যা করেনি। হত্যা করেছে তাঁরই সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তা। আর আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা খোন্দকার মোশতাক, জেনারেল ওসমানীসহ সবাই এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেন। এখানে জাসদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জাসদ ১৯৭৩ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে এবং বাকশালের আগ পর্যন্ত সংসদীয় নীতি অনুযায়ী বিরোধিতা করে, সেটি প্রকাশ্যে। এই বিরোধিতা ছিল রাজনৈতিক। সেটি কখনও সংঘর্ষ-সংঘাতের পর্যায়ে গেছে। কিন্তু জাসদ কখনও অবৈধ পন্থায় বঙ্গবন্ধুকে সরানোর প্রস্তাব দেয়নি। আমরা সামরিক শাসন, মোশতাক, অবৈধ ক্ষমতা ও পাকিস্তান পন্থার বিপক্ষে। জাসদকে নিয়ে এটি একটি মিথ্যাচার। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় লুকাতে চায়, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা তাঁকে বাঁচাতে ব্যর্থ, নিজেদের ব্যর্থতা আড়ালে তারাই জাসদের দিকে আঙুল তোলার চেষ্টা করে। তাছাড়া জাসদ দায়ী হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্জাগরণে জাসদকে নিশ্চয় মূল্যায়ন করতেন না।
সমকাল: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিনের স্মৃতি কিছু বলবেন?
ইনু: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় আমি ঢাকাতেই ছিলাম। ওই সময় বাকশালে যোগ না দেওয়ায় জাসদ নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং দলের নেতারা গোপনে কাজ করতে থাকেন। আমি ঢাকার নারিন্দায় এক বাসায় আত্মগোপনে ছিলাম। আমাকে কর্নেল তাহের সকাল ৮টার দিকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা জানান। মূলত তিনি মেজর ডালিমসহ খুনিদের রেডিও ভাষণ শুনে খবরের সত্যতা যাচাইয়ে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি যখন খোন্দকার মোশতাক, মেজর ডালিমের কথা শুনলাম, তখনই বুঝলাম, এটি গভীর চক্রান্ত। সত্য-মিথ্যা তখনও বুঝতে পারিনি। তবে বাসা থেকে বের হয়ে জানতে পারি বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন। তখনই আমার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিকল্প কোনো সামরিক সরকার হতে পারে না। তাই টেলিফোনে যতটুকু পেরেছি দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধ সামরিক সরকার প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিই। অবশ্য ওই সময়ে বেশিরভাগ এমপি মোশতাকের সরকারে যোগ দেন। অবশ্য আমরা আশা করেছিলাম, এমপিরা প্রতিবাদ জানাবেন, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইবেন। কিন্তু তাঁরা সে ভূমিকা রাখেননি।
সমকাল: ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?
ইনু: ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে আমি একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড মনে করি। এটি তাৎক্ষণিক উত্তেজনাবশত কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল সামরিক কর্মকর্তার কাজ নয়। তারা পরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় এনেছিল। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছাড়াও স্পিকার ছিলেন। কিন্তু তাঁরা সংবিধানবহির্ভূতভাবে খোন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি করেন। পরবর্তীতে জয় বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ও মোশতাকের পরবর্তী কার্যক্রমেও স্পষ্ট হয়, '৭১-এর পরাজিত শক্তি ও তাদের দালাল রাজাকার, আলবদররা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তান পন্থার ঝাণ্ডা হাতে বাংলাদেশ পন্থাকে হত্যার চক্রান্ত ছিল ১৫ আগস্ট। এটি বাংলাদেশের আত্মা ও চেতনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ছিল।
সমকাল: এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় রাজনীতিকদের ব্যর্থতা কী ছিল?
ইনু: বঙ্গবন্ধু নিহত ও ক্ষমতাচ্যুত হওয়া অবশ্যই তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতা। হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাকের নেতৃত্বে সরকারে আওয়ামী লীগের চার জাতীয় নেতা ছাড়া সবাই শরিক হন। সুতরাং প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। বাইরের আক্রমণের চাইতেও অভ্যন্তরীণ সংকটে হৃদয়বিদারক এ ঘটনা ঘটেছে।
সমকাল: ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রভাব কী?
ইনু: পরিকল্পিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক হয়েছে। খোন্দকার মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসন, এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজাকার পুনর্বাসন এবং তারই বর্ধিত অংশ হিসেবে জাতীয় পার্টি ও খালেদা জিয়ার শাসন। এ সময়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের জন্ম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা বাংলাদেশের মোড় বদলের ঘটনা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক লক্ষ্যকেই ধ্বংস করার চক্রান্ত ছিল এই হত্যাকাণ্ড।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com