
সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত
আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডেই সব ধাপ সম্পন্ন হয়েছে
প্রকাশ: ২৫ জুন ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শেখ রোকন

পানিসম্পদ, পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। এর আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগে। তিনি আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ছিলেন এবং ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির কারিগরি দলের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ড. নিশাত ২০১৯ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক লাভ করেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৮ সালে পিতার তৎকালীন কর্মস্থল কিশোরগঞ্জে।
সমকাল: এক দশক আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি আমাকে বলেছিলেন যে, ফরিদপুরে পিতার কর্মস্থল থেকে নৌকায় করে কীভাবে দুই দিনে ঢাকা পৌঁছেছিলেন। পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন তো কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র।
আইনুন নিশাত: এটা আসলে আমাদের প্রজন্মের জন্য একটি বিস্ময়কর ঘটনা। আপনারা হয়তো যমুনা সেতু দেখেছেন, আরও সেতু দেখেছেন। আমরা যখন বেড়ে উঠেছি, তখন বাংলাদেশে ছিল সেতুবিহীন নদী ব্যবস্থা। কয়েকটি রেলসেতু ছিল মাত্র। গঙ্গা, যমুনা বা মেঘনার মতো নদীতে সেতুর কথা কল্পনাও করা যেত না।
সমকাল: পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কি প্রকৌশলগত দিক থেকেও নতুন যুগে প্রবেশ করল?
আইনুন নিশাত: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ এখন জটিল ও বড় প্রকল্প নিতে সাহস পাচ্ছে। বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডের যে দিকনির্দেশনা ১৭টি এসডিজিতে দেওয়া আছে, তার একটি হচ্ছে যে কোনো দেশের উন্নতি করতে গেলে উপযুক্ত অবকাঠামো লাগবে। নদীবহুল বাংলাদেশে প্রধানতম উপাদান হচ্ছে সেতু।
সমকাল: পদ্মা সেতু প্রকৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল?
আইনুন নিশাত: পদ্মার মতো খরস্রোতা ও অস্থির একটি নদীতে মাটির গভীরে পাইল বসানোর কাজটিই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আপনাকে মনে রাখতে হবে, পদ্মা একটি পলল নদী। এর তলদেশে রয়েছে হয় বালু না হয় নরম মাটি। শুধু পদ্মা নয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদীর তলদেশে পাথর নেই। পাথর থাকলে পাইলিং বা খুঁটি বসানো সহজ হয়। এক্ষেত্রে সেটা ছিল প্রায় অসম্ভব।
সমকাল: সেই চ্যালেঞ্জ কীভাবে সমাধান করলেন?
আইনুন নিশাত: এজন্য আমরা প্রথমে যেখানে পাইল বসানো হবে সেখানে একটি শক্ত ফাউন্ডেশন তৈরি করতে চেয়েছি, যাতে করে সেগুলো সেতুর ভর ধরে রাখতে পারে। এজন্য নদীতে জিওব্যাগ, কংক্রিটের ব্যাগ ও বড় বড় পাথর বসিয়েছি আগে। পাথরগুলোর এক একটির ওজন এক টন পর্যন্ত আছে। এসব পাথর, জিওব্যাগ, কংক্রিট ব্যাগ নদীর তলদেশেরও মাটির গভীরে বসিয়ে পাইলিংয়ের ফাউন্ডেশন তৈরি করা হয়েছে।
সমকাল: পদ্মায় পানির প্রবাহও নিশ্চয়ই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
আইনুন নিশাত: মনে রাখতে হবে, পদ্মা বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা ও বিপুল প্রবাহ নদীগুলোর একটি। এর চাইতে বেশি পানির প্রবাহ আছে কেবল ব্রাজিলের আমাজন নদীতে। আপনি জানবেন হয়তো, বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্য দিয়ে যত পানি বঙ্গোপসাগরে বয়ে যায়, তার দুই-তৃতীয়াংশ যায় পদ্মা দিয়ে। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় যে দুই নদী, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র, এর যোগফল হচ্ছে পদ্মা।
সমকাল: পাঠকের জন্য আরেকটু ব্যাখ্যা করুন।
আইনুন নিশাত: দেখুন, সিরাজগঞ্জের উজানে ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা গড়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার চওড়া। ওদিকে গঙ্গার প্রশস্ততা প্রায় ছয় কিলোমিটার। কম করেও যদি ধরি, দুই নদীর মিলিত প্রশস্ততা ২০ কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু মাওয়ার কাছে পদ্মা মাত্র ছয় কিলোমিটার চওড়া। তার মানে, ২০ কিলোমিটারের পানি ছয় কিলোমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানে সেতু তৈরি সহজ বিষয় ছিল না।
সমকাল: নদী ব্যবস্থাপনার কাজটি কীভাবে করলেন?
আইনুন নিশাত: ভালো যে, আপনি নদীশাসন বলেননি। আমিও মনে করি না যে, রিভার ট্রেইনিংয়ের বাংলা নদীশাসন। কিন্তু সেটা চালু হয়ে গেছে। নদীকে কখনও শাসন করা যায় না। পদ্মার মতো নদীকে তো শাসন করতে পারার প্রশ্নই আসে না। পদ্মার এক পাড় ভাঙে তো আরেক পাড় গড়ে। ফলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে নদী ব্যবস্থাপনার কাজ করতে হয়েছে। তবে নদী ব্যবস্থাপনার এখনও শেষ হয়নি। আরও একটি বর্ষা পার হতে হবে।
সমকাল: শেষ হয়নি কেন?
আইনুন নিশাত: কারণ প্রকল্প চলাকালে ফেরি চলাচল বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। বলা চলে ফেরি চলাচল করতে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। আজকে নদী ব্যবস্থাপনার কাজটি অসম্পূর্ণ এই কারণে। আমি এখনও মনে করি, প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে সেতুর তলা দিয়ে ফেরি চলাচল করা উচিত হয়নি। এখনও ওই এলাকা এড়িয়ে ফেরি চলাচল করতে হবে। শিমুলিয়ার উল্টো দিকে শরীয়তপুরে ফেরি চালু করা যেতে। বাংলাবাজার ও চর জানাজাতকে ফেরির আওতায় আনতে হলে ঢাকার বিক্রমপুর থেকে নতুন ফেরি চালু করা উচিত।
সমকাল: শঙ্কা রয়েছে যে, পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় নদী ব্যবস্থাপনার কারণে উজানে বা ভাটিতে নদীভাঙন বাড়তে পারে।
আইনুন নিশাত: পদ্মা নদীর গতিবিধি আগে থেকে বলা মুশকিল। মাওয়া এলাকায় যেহেতু শক্ত কাদা আছে, প্রথম এটাকে দেড় কিলোমিটার করা হয়েছিল, পরে আরও দুই-আড়াই কিলোমিটার যোগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উজানে অল্প কিছু এলাকা ভাঙতে পারে। এছাড়া চর জানাজাতের কাছে আড়িয়াল খাঁর মুখ পর্যন্ত নদী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুরো এলাকাটা নজরে রাখতে হবে। এছাড়া পদ্মা সেতুর ভাটিতে শিমুলিয়া পর্যন্ত নদী ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নদী কোথায় ভাঙবে বলা মুশকিল। কিন্তু সেটা সেতু প্রকল্পে নদী ব্যবস্থাপনার কারণে ভাঙবে বা ভাঙবে না- এমন অনুমান করা ঠিক হবে না।
সমকাল: বড় ধরনের সেতু প্রকল্পের কারণে নদীতে প্রতিবেশগত বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে?
আইনুন নিশাত: আমরা প্রথম থেকেই নিশ্চিত করতে চেয়েছি, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারণে নদীর প্রতিবেশ যাতে ক্ষতগ্রিস্ত না হয়। এজন্য আপনি দেখবেন, বিদেশের অনেক প্রকল্পের মতো নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কোথাও ঘুরিয়ে দেওয়া হয়নি। আসলে সেতুর কারণে কী প্রভাব পড়তে পারে, এ ব্যাপারে আগেই সমীক্ষা চালানো হয়েছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সমকাল: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে আপনি বলেছেন যে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইলিশের প্রজনন চক্র বিবেচনা করা হয়েছে। ব্যাখ্যা করবেন?
আইনুন নিশাত: দেখুন, আমরা দেখেছি যেখানে নদীর গভীরতা বেশি সেখানে ইলিশ চলাচলের মৌসুমে কাজ বন্ধ রেখেছি। যাতে করে ইলিশ মাছ স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে। পাইলিংয়ের সময়ও শব্দ পরিমাপ করা হয়েছে, যাতে করে ইলিশ ভীত হয়ে পদ্মা নদী ছেড়ে না যায়। এছাড়া নদীর পশ্চিম পাশে চর জানাজাতের কাছে কচ্ছপের প্রজননস্থল সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আপনি দেখবেন, পদ্মা সেতুর দক্ষিণে একটি সংরক্ষিত চরাঞ্চল রয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য। আপনাকে বলতে পারি, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবেশ ব্যবস্থা বা মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আর কোনো সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
সমকাল: যমুনার পর পদ্মা সেতুতে বহুলাংশে দেশীয় বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশল ও উপকরণ ব্যবহূত হলো। সম্পূর্ণ দেশীয় ব্যবস্থাপনায় মেগা প্রকল্প করা সম্ভব?
আইনুন নিশাত: আমি মনে করি, সম্ভব। তবে বুঝতে হবে যে, দেশীয় মানে সবকিছু দেশীয় নয়। প্রয়োজনে বাইরে থেকে ব্যক্তি, সংস্থা বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করা যাবে। বিদেশিরাও করে। যেমন আমরা নদী ব্যবস্থাপনার বিশেষজ্ঞ আনি নেদারল্যান্ডস থেকে। তারা প্রথম এনেছিল আমেরিকা থেকে। যেমন পদ্মা সেতু প্রকল্পের অ্যাপ্রোচ রোড করছে সেনাবাহিনী। যমুনা রেল সেতুও সেনাবাহিনী তৈরি করছে। কিন্তু তারা প্রয়োজনমতো বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞকেও বিদেশিরা নিয়ে যান। এতে কোনো ক্ষতি নেই। মূল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন অর্থনৈতিক ও কারিগরি দিক থেকে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম।
সমকাল: বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পন্ন হলো। এর বিশেষজ্ঞ প্যানেল সদস্য হিসেবে আপনার কেমন লাগছে?
আইনুন নিশাত: যমুনা সেতু নির্মাণের সঙ্গে যখন জড়িত হই, ভয় করত কাজ সম্পন্ন করতে পারব তো? পদ্মা সেতুর কাজটি আরও কঠিন ছিল। কারণ এটা জোয়ার-ভাটার নদী। যেখানে পাথর ফেলা হচ্ছে, তার উজানে বা ভাটিতে পড়তে পারে। ফলে সবসময়ই একটা সতর্ক থাকতে হতো। নির্মাণকাজ ভালোভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর বেশ স্বস্তি লাগছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংক না থাকলেও আন্তর্জাতিক মানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। আমরা সেই বিষয়ে ছাড় দেইনি। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডেই সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকদিন আগে সম্পূর্ণ প্রস্তুত পদ্মা সেতুতে গিয়েছিলাম। সেতুর এপার থেকে ওপার গাড়িতে গিয়েছি, কোথাও কোথাও থেমে উজান বা ভাটিতে নদী দেখেছি। একটি বড় স্থাপনা নির্মাণের পর তার ওপর দাঁড়িয়ে যে অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতি ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com