
ভাঙা পা সারাতে এসে প্রাণ গেল শিশু আতিকার, তিন চিকিৎসকসহ গ্রেপ্তার ৪
প্রকাশ: ১৯ মে ২২ । ০১:০২ | আপডেট: ১৯ মে ২২ । ০১:০২
সমকাল প্রতিবেদক

দোলনা থেকে পড়ে ডান উরুর হাড় ভেঙে যায় সাত বছরের শিশু আতিকার। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করানো হলেও সেরে ওঠেনি সে। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে আসা হয়।
সেখানে স্বজনদের ভুল বুঝিয়ে তাকে শ্যামলীর মক্কা মদিনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় দালালরা। তড়িঘড়ি করে অস্ত্রোপচারও হয়। কিন্তু তারপর আর জ্ঞান ফেরেনি শিশুটির। একপর্যায়ে বুধবার ভোরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
স্বজনের অভিযোগ, চিকিৎসক-নার্সসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার কারণেই তার মৃত্যু হয়।
এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে অপচিকিৎসাসহ নানা অনিয়মের দায়ে এই হাসপাতালটি সিলগালা করে দিয়েছিলেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
তখন হাসপাতালের মালিক নূর নবীকে এক বছর এবং ওটি বয় আনোয়ার হোসেন ও আবদুর রশীদকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে চলতি বছরে আবারও চালু হয় এই হাসপাতাল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মৃত্যুঞ্জয় দে সজল সমকালকে বলেন, এ ঘটনায় শিশুটির বাবা মো. আজিম বাদী হয়ে হাসপাতালটির মালিকসহ আটজনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেছেন। এরই মধ্যে অভিযুক্ত তিন চিকিৎসক ও এক নার্সকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে হাসপাতালটি বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অবৈধ হলে তাদের কার্যক্রম বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ ও ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের আজিম ও শিলা দম্পতির মেয়ে আতিকা। রমজানের প্রথম দিন সে দোলনা থেকে পড়ে আহত হয়। মঙ্গলবার শিশুটির মা ও নানা তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
সেখানে এক্সরে করানোর পর চিকিৎসক জানান, ভাঙা পা প্লাস্টার করতে হবে। তবে অনেক দেরি হওয়ায় পা স্বাভাবিক হবে না।
এ কথা শুনে স্বজনরা করণীয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এর মধ্যে মো. শাহজাহান নামে এক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে পরিচিত হন।
তিনি জানান, শ্যামলীর বি-ব্লকে বাবর রোডের ২১/১৪ নম্বর ভবনের মক্কা মদিনা হাসপাতালে অল্প খরচে পা ভাঙার ভালো চিকিৎসা হয়। তার কথার ফাঁদে পড়ে শিশুটিকে নিয়ে তার মা ও নানা ওই হাসপাতালে যান।
সেখানে হাসপাতালের লোকজন বলেন, দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে। এজন্য খরচ হবে ৩২ হাজার টাকা। পাশাপাশি সব ওষুধ কিনে দিতে হবে।
এ পরিস্থিতিতে শিশুটির নানা মো. সিরাজ জানান, ওই পরিমাণ টাকা তার কাছে নেই। তখন তারা বলে, 'যা আছে দেন, তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। পরে বাকি টাকা পরিশোধ করবেন।'
এরপর ডা. একেএম নিজামুল ইসলাম, ডা. দেওয়ান মো. আনিছুর রহমানের (অ্যানেসথেসিয়া) সহায়তায় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে অস্ত্রোপচার শেষ করেন।
পরে শিশুটিকে অচেতন অবস্থায় কোনো অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছাড়া হাসপাতালের দোতলার পুরুষ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে দায়িত্বে ছিলেন ডা. মোস্তাকিম বিল্লাহ ও নার্স মুক্তা ভৌমিক।
বুধবার ভোর ৪টাতেও মেয়ের কোনো সাড়া না পেয়ে তার মায়ের সন্দেহ হয়। তিনি নার্সকে ডেকে আনেন। নার্স মুক্তা শিশুটিকে প্রাথমিক পরীক্ষার পর দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে যান।
এ পর্যায়ে ডা. মোস্তাকিম গিয়ে তার মুখে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি আতিকাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শিশুটির বাবা আজিম বলেন, ঘটনার সময় আমি হাসপাতালে ছিলাম না। শ্বশুরের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে আমি মেয়েকে মৃত অবস্থায় পাই এবং ঘটনার বিস্তারিত শুনি। পরে লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারি, এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তার ও নার্সদের সহায়তায় অধিক মুনাফার আশায় সাধারণ মানুষের অপচিকিৎসা করে আসছে। তাদের অবহেলাজনিত ভুল চিকিৎসায় আমার মেয়ের মৃত্যু হয়।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবদুল লতিফ সমকালকে বলেন, বাদীর অভিযোগ অনুযায়ী শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক অপর আসামিদেরও আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্র জানায়, এ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তার চার চিকিৎসক-নার্স ছাড়া পলাতক চার আসামি হলেন- হাসপাতালের মালিক নূর নবী, হাসপাতালকর্মী আবুল হোসেন, নাসের ও দালাল শাহজাহান।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২২
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com