মতামত

বুলিং একটি ভয়াবহ মানসিক সংকট

প্রকাশ: ১২ মে ২২ । ১৭:৪২ | আপডেট: ১২ মে ২২ । ২০:৫৭

শারমিন সুলতানা তন্বী

প্রাপ্তবয়স্কদের একটা অন্যতম মানসিক সমস্যা হলো অন্যকে মজার ছলে ছোট করা। এ সংকটে আক্রান্তরা মানসিক রোগী কিনা, তা নির্ধারণ করা মনোবিজ্ঞানের গবেষণা সাপেক্ষ বিষয়। যদি নাও হয়, তবু এরকম মানুষের সংখ্যা কম নয়। ব্যক্তি মূলত নিজে প্রথমে কোনো না কোনোভাবে অন্যের খারাপ আচরণের শিকার হন, তারপর সে যে খারাপ আচরণ অন্যের কাছ থেকে পায় সেটাই আবার কাউকে না কাউকে, কোনো না কোনো উপায়ে ফিরিয়ে দিয়ে একটি বিকৃত মানসিক তৃপ্তি অনুভব করার চেষ্টা করে। 

ইংরেজিতে বুলিং নামে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে, তার সঙ্গে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মিল রয়েছে। তবে বুলিংয়ের বিষয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যিনি বাজে মন্তব্যটি করছেন তাকে অপরাধী হিসেবে দায়ী করা হয় এবং বুলিং বা বাজে মন্তব্যের শিকার যে তার খারাপ লাগার বিষয়টিকে প্রধান করে দেখা হয়। অবশ্যই এই বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু এর পেছনে ক্রিয়াশীল থাকা প্রত্যয়গুলোও ভীষণ গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার। নয়তো এই বিষয়ের আংশিক আলোচনা হবে, পুরো নয়।

আজকালকার অনেক সচেতন স্কুল-কলেজে বুলিংবিরোধী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়, যা শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো বিষয় হচ্ছে, এর কার্যক্রম কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে?

বেশি হোক আর কম হোক শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ কতটা হয়, তা আজকে ভেবে দেখার মতো। কর্মস্থল, বাড়ি, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের আড্ডা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি প্রায় সব জায়গায় আমরা প্রায় সবাই কমবেশি নিজেদের কোনো না কোনো দুর্বলতার রেশ ধরে নিছক মজার ছলে আপত্তিকর মন্তব্য শুনে থাকি, যা করার অধিকার আমরা কাউকেই দিই না। অনেকেই বিষয়টিকে হেসে মেনে নিলেও ক্রমেই সে একঘোরে হতে থাকে বা লজ্জিত বোধ করে নিজেকে গোটাতে থাকে। এ ক্ষেত্রে আতঙ্ক যে শুধু ভুক্তভোগীকে নিয়ে তা নয়, যিনি করছেন এসব আপত্তিকর মন্তব্য তিনি নিজের অজান্তে নিজেও ভুক্তভোগী হচ্ছেন বা হওয়ার পথে পা বাড়াচ্ছেন। 

অন্যকে ছোট করে কথা বলে, অপমান করে, কষ্ট দিয়ে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা সুস্থ মস্তিস্কের কেউ নিতে পারে না। মান হারানোর ভয়ে আমরা কেউ কথা না বাড়ালেও কথা কিন্তু থেকেই যায়। এ থেকেই মানসিক অবসাদ তৈরি হয় মানুষের মধ্যে, যা স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এবং সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। এ ধরনের অবমাননাকর মন্তব্য সামাজিক দৃঢ় বন্ধন, পারিপারিক সম্মানবোধ, আস্থা, বিনয় ইত্যাদির ওপর হুমকির স্বরূপ, যা সমস্যাকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে মানুষের নৈতিক শিক্ষার গুণগত মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। 

গায়ের রং থেকে শুরু করে মাথার চুল, শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে শরীরের মেদ, অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে শুরু করে পারিপারিক অবস্থান, বুদ্ধিগত চাতুর্যতা থেকে শুরু করে আচরণগত অবস্থান ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ উভয়ই প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের কাছ থেকে নানান ছলে অবমাননাকর মন্তব্য পেয়ে থাকেন। এটি ক্রমেই একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের দিকে আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ এ নিয়ে নেই যথেচ্ছ পরিমাণ সচেতনতা, নেই নিজের আচরণ ও কথামালাকে সংযত করার কোনো প্রয়াস বা প্রচেষ্টা। 

বাংলায় হেনস্তা করা বলে যে ক্রিয়াবাচক শব্দটি রয়েছে, তা এক্ষেত্রে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কারণ ছাড়াই অনেকে অন্যকে ছোট করা বা অপমান করাকে একটা আনন্দের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব উদাহরণ যদিও সমাজের ধনী শ্রেণির শিশু-কিশোরদের মাঝে দেখা যায়, তবু এটিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। মধ্যবিত্তরাও এ ক্ষেত্রে কম অগ্রসর নন। এসব বাধাহীন অসংলগ্ন আচরণই পরবর্তী সময়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডের উৎস হিসেবে কাজ করে। সমাজে শ্রেণি বৈষম্য থেকে শুরু করে বর্ণ বৈষম্য সৃষ্টিতে এই নিছক মজাজনিত আচরণগুলোই দায়ী। কার্যকর নৈতিক শিক্ষার অভাব, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, প্রতিপক্ষের জুরালো প্রতিবাদের অভাব, সামাজিক সচেতনতামূলক শিক্ষা প্রদানের অভাব এ ধরনের আচরণকে প্রশ্নয় দিচ্ছে। একজনের বিকৃত আনন্দের খোরাক হয়ে মানসিক হীনমন্যতায় ভুগছে আরেকজন। অন্যের কাছ থেকে প্রাপ্ত অসম্মানের জবাবে ভুক্তভোগী মনের অজান্তে নিশানা করছেন অন্যজনকে। এভাবে ধীরে ধীরে এ সংকট সংক্রমিত করে যাচ্ছে সবাইকে। 

যদিও সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, তবু মানুষ অন্যকে অপদস্ত করে বিকৃত জিঘাংসা পরিপূর্ণ করছে। আর ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে যে আপত্তিকর মন্তব্যগুলো রোজই কিছু মানুষের সঙ্গী হচ্ছে তার তো কোনো প্রতিকারই নেই। ভুক্তভোগী ধীরে ধীরে কী পরিমাণ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন, তা আমাদের অনুমেয় নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মানবোধ, অবস্থান ও বয়স নির্বিশেষে প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিতকরণের জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়বোধ রয়েছে। তাই অযথা অন্যকে ছোট করা, আপত্তিকর কথা বলা বা অন্যের দুর্বলতার প্রসঙ্গ নিয়ে হাসি-তামাশা করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। কেননা আমাদের সবকিছু মেনে নেওয়া, প্রতিবাদ না করা বা চুপ করে থাকা অন্য পক্ষকে নিজেকে সঠিক ভাবার ভুল তথ্য প্রদান করে। আর এটিই আমাদের সব অসম্মান ও অবমাননার জন্য দায়ী।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com