বাংলাদেশের একাত্তর

১৯৭১: নারীর ভূমিকা

ধারাবাহিক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২২ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আফসান চৌধুরী

নারী তার সমগ্র দিয়ে একাত্তরকে ধারণ করেছিল

[পর্ব :১]

ক্ষীণভাবে হলেও বাংলাদেশের একাত্তরে নারীর ভূমিকার কথা এলে আজও 'নারী কী করেছিল'- এই প্রশ্ন পর্যন্তই ওঠে, কিন্তু নারী তা কেন করেছিল- সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় না। এমনিতেও মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা- এ বিষয়টি আমাদের দেশে সাধারণত দুটো শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিকবৃন্দ, যারা পরবর্তী সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠন করেন; অন্যটি হচ্ছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীকে একাত্তরে বলা হতো নিয়মিত বাহিনী, আর এর সঙ্গে চার বা ছয় সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে যারা যুদ্ধ করত তাদেরকে ডাকা হতো গণবাহিনী নামে। সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক এই দুই শ্রেণিকে নিয়ে একাত্তরে যে ক্ষমতার বলয়টা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; পরবর্তী সময়ে সেটিই হয়ে গেছে আমাদের রাষ্ট্রের এবং ইতিহাস চর্চার ভিত্তি।

এদের ভূমিকার মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল- এই ভাবনার সূত্রটা মূলত ঔপনিবেশিক, পশ্চিমা, সনাতনী; যেটাই আমরা বলি। কারণ যুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে আলাপ করতে গেলে, পশ্চিমা দুনিয়ায় সাম্প্রতিক ইতিহাসে যে ধরনের যুদ্ধ হচ্ছে- সেগুলো হচ্ছে ফ্রন্টাল ওয়ার বা সামনাসামনি যুদ্ধ। যে সকল রাষ্ট্র এই যুদ্ধগুলো করেছে, বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়- তাদের কাছে সেটা সেনাবাহিনীর যুদ্ধ। সেখানে সেনাবাহিনীর লোকেরা ফ্রন্টে যায়, ফ্রন্টে থাকে যুদ্ধ করে। এসব ফ্রন্টাল যুদ্ধের ভিত্তিতে দেখতে গেলে যুদ্ধে আর কারও ভূমিকা থাকে না। এর বাইরে কেবল ভূমিকা থাকে তাদেরকে যারা ফ্রন্টে পাঠায়- যেমন উইনস্টন চার্চিল। এখানে সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। এখানে রাষ্ট্র গঠিত হয় ওপরতলার মানুষদের দিয়ে। বাকিরা সবাই গৌণ হয়ে যায়। একাত্তরের ইতিহাসেও সেরকমই একটা ওপরতলার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের ভূমিকাকে তাই আমরা স্বীকার করতে চাই না। আমরা কেবল স্বেচ্ছায় স্বীকার করছি না তা নয় শুধু, আমাদের মননগঠন বুদ্ধিমত্তা এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে যে ধারণা আছে- সেখানে এই ওপরতলার ভূমিকাটাই প্রতিষ্ঠিত। সে কারণে একাত্তরের মতো একটা যুদ্ধে এর বাইরে আর অন্য কারও ভূমিকা যে থাকতে পারে সাধারণত তা আমরা ভাবতে পারি না।

একাত্তরের ইতিহাসে আমলা আছে, সেনাবাহিনী আছে, রাজনীতিবিদরা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে বিবরণগুলো পাওয়া যায়, সেখানে এর বাইরে আর কেউ নেই। এই বিবরণগুলো সনাতনী যুদ্ধের বিবরণের থেকে খুব একটা আলাদা নয়। আমরা যেটাকে গণযুদ্ধ বা জনযুদ্ধ বলি- যুদ্ধের সে চরিত্র ও বাস্তবতা নিয়ে কিন্তু আমরা আলাপ করি না। এমনকি জনযুদ্ধ নিয়ে কোনো ভাবনাও হয় না আমাদের মধ্যে। এটাকে ভাবা হচ্ছে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ এবং সেই সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেছে যে রাজনীতিবিদরা, তাদের যুদ্ধ। তাই আমরা একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে গেলে কয়েকজন রাজনীতিবিদ আর সেনাবাহিনীর কয়েকজন সেক্টর-প্রধানের কথাই বলি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর কথাই যদি বলি- তাদের ভেতরেও দেখা যাবে বিভিন্ন জায়গায় যেখানে অফিসাররা ছিল না সেখানে সুবেদার, হাবিলদাররা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। প্রতিরোধ পর্বের পরে ভারতে প্রথম ওয়ারকোর্স যেটা হলো- সেখানে কে এম সফিউল্লাহ সাহেব বলছেন যে, আমার তো অফিসারই নেই। অর্থাৎ এখানে প্রতিষ্ঠিত একটা সেনাবাহিনী যে পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে- সেই প্রয়োজনের ভিত্তিতে যুদ্ধের চিন্তাটা উঠে আসছে। যেখানে এটা হয়ে গেল সেনাবাহিনীর বিষয়, এটা হয়ে গেল রাজনীতির বিষয়। রাজনীতির দিকটি হলো মুজিবনগর সরকার- অর্থাৎ সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। সারা দুনিয়ার কাছে এই মুজিবনগর সরকারই পরিচিত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে।

প্রতিরোধেও শামিল ছিল নারীরা

 

পৃথিবীর এই হিসাবের মধ্যে কিন্তু সাধারণ মানুষ নেই। বিষয়টা হলো পৃথিবীতে বেশিরভাগ ইতিহাসের যে মডেলগুলো তৈরি হয়, সেগুলো তৈরি হয় পশ্চিমা দেশেই। পশ্চিমা দেশের যে আন্দোলন-বিদ্রোহ, তাতে তো সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। কারণ তাদের কাছে তো সাধারণ মানুষের যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতাটাই নেই। বাংলাদেশের যুদ্ধ মৌলিকভাবে সাম্প্রতিক সময়ের পৃথিবীর সকল যুদ্ধ থেকে আলাদা। তা না হলে এ যুদ্ধ সম্ভবই ছিল না। কেন এটা আলাদা যুদ্ধ, কেন এটা সাধারণ মানুষের যুদ্ধ- এ বিষয়টা বুঝতে হলে আমাদের একাত্তরের সামগ্রীক অংশগ্রহণের দিকে তাকাতে হবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে তিনটা ফোর্স তৈরি করা হয়েছিল- খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান এবং কে এম সফিউল্লাহর নামে কে ফোর্স, জেড ফোর্স এবং এস ফোর্স; এই ফোর্সগুলো কতটা সফল হয়েছিল তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেখানে জেনারেল ওসমানীও সেনাবাহিনীর সনাতনী ভাবধারার অনুসারী ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সামনাসামনি যুদ্ধ করে জিততে পারবেন। কিন্তু এটা তেমন সফল হয়নি। আমাকে ভারতীয় সেনাবিদরাও বলেছিলেন যে, আমরা তো এটার পরামর্শও দিতাম না, কারণ বাংলাদেশে ঢুকে সামনাসামনি যুদ্ধের সক্ষমতা অর্জন করতে আমাদেরই লেগেছে ৯ মাস। অর্থাৎ আমাদের সামনাসামনি যুদ্ধ করার ক্ষমতাটা সীমিত ছিল। যে কারণে গেরিলাদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এবং ডিসেম্বর মাসে যখন যৌথ বাহিনী আক্রমণ করে, তখনই যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনটা হয়।

নারী তার সমগ্র দিয়ে একাত্তরকে ধারণ করেছিল


চালচুলোহীন একটা দেশ, যে দেশের সরকার অন্য দেশে প্রায় আশ্রিতের মতো রয়েছে- সে দেশের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধের সক্ষমতা অর্জন করাটা খুবই কঠিন। পাকিস্তান আর্মিও এটা জানত। হামুদুর রহমান কমিশনে তারা বলছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধে জিততে পারবে না। সে কারণেই নিয়াজি এবং ইয়াহিয়ার বোঝা উচিত ছিল এর মানেই হচ্ছে যে পাকিস্তানকে হারাতে হলে ভারতকে সরাসরি আক্রমণ করতে হবে। ভারত কেবল মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে এখানে স্বাধীন দেশ করতে পারবে না- এটা ছিল পাকিস্তানিদের ধারণা।

আমাদের সেনাবাহিনীর সীমাবদ্ধতা ছিল, সীমাবদ্ধতা ছিল অস্থায়ী সরকারের- তারা কতটা করতে পারবে? এই বাস্তবতাগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শেষ পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রকে দখলদারমুক্ত করতে সম্মুখ সমরেই যেতে হলো, এবং সেই সম্মুখ সমরে ভারতকে তার সেনাবাহিনী নিয়ে আসতে হয়েছে।

একটা যুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায় থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কারা রেখেছিল? পাকিস্তান আর্মির মনোবল চূর্ণ হয়ে গেছে, নদী পার হতে পারছে না, রাস্তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তাদের পক্ষে কেউ নেই, তাদের কোনো প্রশাসন নেই, খাবার নেই- ৯ মাসে তাদের একেবারে হতচ্ছাড়া, পর্যুদস্ত একটা অবস্থা করে ফেলা হয়েছে। এসব কারা করেছে? করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং তাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা। এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধও করেছে সাধারণ মানুষের সহায়তায়। তারা যদি আশ্রয় না দিত মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করত কী করে? পৃথিবীর কোন দেশে এটা হয়? ভিয়েতনাম যুদ্ধে কিছুটা হয়েছে, এ ছাড়া আর কোথাও এই চিত্র দেখা যায় না।


সাধারণ মানুষের যুদ্ধকে ইতিহাসে আমরা কিছু কিছু জায়গায় উল্লেখ করছি। উল্লেখ করছি 'সহায়ক' হিসেবে। কিন্তু মূল আর সহায়কের যে সম্পর্ক- এখানে আমরা বোঝাচ্ছি যে, যা-ই কর না কেন তুমি আমার নিচে আছো। আমি হচ্ছি সবার ওপরে। যুদ্ধের ভূমিকার ক্ষেত্রে এই যে শ্রেণিভেদকরণ, এটা আমাদের প্রয়োজন যে রাষ্ট্র আমরা পেয়েছি তা রক্ষা করার জন্য।

এই এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবস্থানটা তাহলে কোথায়? এমনিতেই নারী তো আছে সমাজেরও সবচেয়ে নিচে। তাই নারীর কথা আলাদাভাবে কী করে আসতে পারে একাত্তরের ইতিহাসে! এটা অসম্ভব, যদি না জনযুদ্ধকে আমরা আগে সংজ্ঞায়িত না করি। এটা না করলে নারীকে আমরা কখনোই সামনে আনতে পারব না। কেউ বলতে পারেন যে, এটাকি নারীবাদী কোনো এজেন্ডা কিনা? না, এটা নারীবাদী কোনো ব্যাপার নয়। মূলত বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধের চরিত্র অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই নারীর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, একাত্তরে নারীর ধর্ষিত-নির্যাতিত হবার ঘটনার ব্যাপারে মানুষের যতটা গুরুত্ব আছে, নারীর অন্য ভূমিকাগুলো নিয়ে তাদের আগ্রহটা কম। যে কারণে নারীর ভূমিকা নিয়ে আমাদের ইতিহাসে কোনো আলোচনা হয় না।

যে কোনো জনগোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় খুব কম কথাই লেখা আছে নারী সম্পর্কে। এবং নারীর এই অদ্ভুত বাদ পড়ে যাওয়াটা আমাদের ইতিহাস চর্চার সীমাবদ্ধতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। আমরা যখন একাত্তরের ইতিহাস তৈরি করছি, আমরা একেবারে অর্ধেক জনগোষ্ঠীকেই বাদ দিয়ে দিয়েছি। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আমরা তাদের ভূমিকাকে গৌণ মনে করি। আমাদের ইতিহাস চর্চা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার পেছনে এটা অন্যতম কারণ। আমাদের কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদ কী করেছিলেন, যোদ্ধারা কী করেছিলেন, এটাই যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আন্তর্জাতিক পরিসরের ইতিহাসের অনুকরণে নিজেদের ইতিহাসকে দেখতে গিয়ে আমাদের ইতিহাসটা যেন রপ্তানি হয়ে গেছে। সেখানেও নারীদের ভূমিকাকে সাধারণত তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করা হয় না।


বস্তুতপক্ষে যে মন নিয়ে আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, সমস্যাটা তার মধ্যেই রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশের ইতিহাস চর্চার পুরোটাই হচ্ছে এলিট শ্রেণির ইতিহাস। আর নারীকে আমরা এলিট শ্রেণির অংশ হিসেবে দেখি না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও তাই আমরা সেইসব অংশগ্রহণকারীর কথা জানি যারা শিক্ষিত, ভদ্রলোক- অন্ততপক্ষে উচ্চ মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত। শহরে হোক, জাতীয় পর্যায়ে হোক, এমনকি গ্রাম পর্যায়ে হলেও। কিন্তু সাধারণ মানুষকে আমরা ইতিহাসে জায়গা দিইনি। যার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতায় নারীর একাত্তরটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আমি যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে কাজ করছিলাম- সেই কাজ শেষে দেখলাম যে ১৫ খণ্ডের কোনো খণ্ডেই নারী নেই। নারী আছে শুধু নির্যাতন-গণহত্যার কিছু বর্ণনায়। এবং সেখানে নারী কেবল একজন নির্যাতিত হিসেবে এসেছে। নারীর যে কোনো ভূমিকা আছে, তার কোনো উল্লেখ নেই। এ ব্যাপার থেকে আমার একটা মৌলিক শিক্ষা হলো, এবং সেই অস্থিরতা থেকেই পরবর্তী সময়ে ইতিহাস চর্চা চালিয়ে গেছি।

পরে কাজ করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, নারীর যে একটা বহুমাত্রিক ভূমিকা আছে সেটা ইতিহাসে আসে না। এবং তা না জানার ফলে আমাদের ইতিহাসটাকেও বোঝা যায় না। আমাদের নারীর চারটি বড় ভূমিকা আছে স্বাধীনতায়। প্রথম হচ্ছে নারী যোদ্ধা। স্বল্প সংখ্যক হলেও নারী সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে। এটা আমাদের ইতিহাসে খুব কম আসে। মাঝে মাঝে হয়তো দুয়েকটা জায়গায়, তাও ভাসা ভাসা। দ্বিতীয় হচ্ছে নারী সহযোগী। যদিও এই সহযোগী শব্দটায় আমার আপত্তি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীরা সমস্ত কিছুকে আগলে রেখেছে- সে যোদ্ধার অস্ত্র হোক, গোলাবারুদ হোক, গোপনে লুকিয়ে রাখা হোক। যুদ্ধের এই তীব্র ভয়াবহতার মধ্যে সমস্ত কিছু কিন্তু নারীই রক্ষা করেছে। আমরা সেই দামটা তাকে দিইনি। দিইনি এ কারণে না যে, আমরা নারীবিদ্বেষী- দিইনি, কারণ আমাদের সেই সচেতন চোখটা নেই। কারণ আমরা তো সরাসরি মানুষের কাছ থেকে ইতিহাস শিখতে যাই না। আমরা দলিলে ইতিহাস দেখি, নেতার কাছ থেকে ইতিহাস শুনি, সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে ইতিহাস জানি। এর ফলে যা হয়েছে আমলাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, কিন্তু নারীর কোনো ইতিহাস নেই। ধর্ষিতা হিসেবে আছে, মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে আছে- কিন্তু নারী তার নিজস্ব অবস্থান থেকে কোনো লেখাতেই নেই।

তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে নারীর সংসার সামলানো। ছেলেরা যখন যুদ্ধ করতে চলে গেছে, তখন সংসারের রক্ষণাবেক্ষণ করেছে কে? এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে যে, যুদ্ধে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ভূমিকা পালন করেছে নারী। আমরা তার খোঁজও করিনি। আমরা খোঁজ করতে গিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছি- 'আপনি কি যুদ্ধ করেছেন?', মেয়েকে জিজ্ঞেস করিনি- ৯ মাস আপনার কেমন করে কেটেছিল? কী রকম পরিস্থিতিতে নারীকে কতরকম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, সেটা আমরা জানিই না। আমরা কেবল একটা ধারণার সৃষ্টি করেছি যে, পাকিস্তান আর্মি লাফ দিয়ে পড়ে নারীকে নির্যাতন করে তারপর চলে গেল। বাস্তবে ঘটনাগুলো তার চেয়েও বিস্তৃত এবং মর্মান্তিক।

বহু জায়গায় আর্মি আর রাজাকাররা গিয়ে বলেছে মেয়ে দাও- না দিলে সবাইকেই মেরে ফেলব। বাঁচার জন্য তখন তারা মেয়েদের দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই মেয়েদেরকে ভোগ করে যখন ফেরত দেওয়া হয়েছে, সেই সমাজই আবার মেয়েগুলোকে অস্বীকার করেছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, বেশিরভাগ মেয়েই হয়তো আর জীবনযাপন করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। তারপরেও আমরা ইতিহাসে যে অস্বীকারটা করেছি নারীকে, এর কারণটা হচ্ছে আমরা ঔপনিবেশিক ইতিহাসই তৈরি করেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আমরা গণযুদ্ধ আর জনযুদ্ধই বলি না কেন, তার ইতিহাসটা আমরা জানি না। কারণ আমরা গণযুদ্ধ বুঝিই না। যে কারণে নারীকে বাদ দিয়ে এক ধরনের অসম্পূর্ণ এবং ভ্রান্ত ইতিহাস তৈরি করে চলেছি।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে নারী নির্যাতিত হয়নি, সাহসের পরিচয় দেয়নি। যে নারীগুলো ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে রুজি করে গেছে ৯ মাস, একেকটা গণহত্যার পরে যে নারীগুলো বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে আগলে রেখেছিল- তাদের কথা আমাদের তুলে আনতে হবে। নারীর সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা আসলে ইতিহাসের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা। যতক্ষণ আমরা নারীকে ইতিহাসে তার নিজ মর্যাদায় স্থান দিয়ে সাহসের সঙ্গে বলতে না পারব যে, এই তুমি টিকেছ বলেই বাংলাদেশ টিকেছে- ততক্ষণ বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ শুধু নয়, একটা ভিন্নগামী ইতিহাস হবে।

[ক্রমশ]

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com