
কভিড-১৯
শিশুদের আগাম টিকা দেওয়া উচিত
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২১ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন

কভিড-১৯ বিশ্বকে ভ্যাক্সার্স (টিকা গ্রহণেচ্ছু) এবং অ্যান্টি-ভ্যাক্সার্স (টিকাবিরোধী) রূপে বিভক্ত করেছে। একদল রোগের ভয়ে ভীত, অন্য দলটি মুখোশহীন, চিন্তাশূন্য। একদল তাদের সন্তানসহ প্রতি বছর কভিড-১৯-এর টিকা চায়, অন্য দলটি দীর্ঘদিন ধরে টিকার জন্য অপেক্ষা করছে; কভিড-১৯ কিছু টিকা প্রস্তুতকারী বিশ্ববাজার দখল করার জন্য উদগ্রীব তাদের নিজেদের দুর্বলতা আড়াল করে এবং অন্য নির্মাতাদের দুর্বলতা তুলে ধরে তাদের মিডিয়া এবং বিজ্ঞানীদের সাহায্যে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটি (এফডিএ) এমনকি তাদের নিকটতম মিত্রের (অ্যাস্ট্রাজেনেকার) ভ্যাক্সজেভরিয়াকে অনুমোদন দেয়নি।
শিশু এবং অন্যদের মধ্যে কভিড-১৯ :১ জানুয়ারি থেকে ১ এপ্রিল ২০২০ সালের মধ্যে শিশুদের মধ্যে কভিড-১৯ সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র দেখিয়েছে, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে কভিড-১৯-এর সংক্রমণের হার ০.৩৯ থেকে ১২.৩%। তাদের লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে তুলনীয়, কিন্তু শিশুদের মধ্যে লক্ষণহীন সংক্রমণ বেশি। শিশুদের মধ্যে বুকের সিটি স্ক্যানগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই। তবে কিছু পরিবর্তন একান্তই কভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ঘটে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের এই রোগের পরিণতিও অনেক ভালো।
কভিড-১৯-এ শিশুদের মধ্যে বয়স এবং লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার বছর বয়স মৃতদের ৭৬ জন ছিল মেয়ে এবং ৮৩ জন ছেলে ও ৫ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের মধ্যে মৃতদের ১৫৯ জন মেয়ে এবং ১৯৮ জন ছেলে এবং এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৬,৭৭,৮৯৯ মৃত্যুর মধ্যে ৫১৬ হলো ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু, যা প্রতি ১০,০০০ মানুষের মৃত্যুর মধ্যে ৭.৬ জন।
শিশুদের মধ্যে কভিড-১৯-এর টিকার কার্যকারিতা :২,২৬৮ জন ১১ বছরের কম বয়সী শিশুকে নিয়ে একটি পরীক্ষায় প্রাপ্তবয়স্কদের এক-তৃতীয়াংশ ডোজ দিয়ে যে অ্যান্টিবডি মাত্রা তৈরি করে, তা ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী, যাদের প্রাপ্তবয়স্কদের ডোজ দেওয়া হচ্ছে তাদের সমান। তাদের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও একই ধরনের। ফাইজারের এই দাবির পর তারা ২,২০০ জন ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুকে প্রাপ্তবয়স্কদের ডোজ টিকা দিয়ে সংক্রমণ রোধে শতভাগ সফল হয়েছে। টিকাটি ১৬ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে কভিড-১৯-এর গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধে ৯১% কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে।
চীনের সিনোভ্যাক গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় ২,০০০ ছয় মাস এবং তদূর্ধ্ব বয়সের শিশুর মধ্যে করোনাভ্যাকের ট্রায়াল শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী এই গবেষণায় আরও চারটি দেশে- চিলি, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং কেনিয়ার বিভিন্ন বয়সী ১৪,০০০ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ফাইজার এবং মডার্না ছয় মাস থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের জন্য একটি ট্রায়াল শুরু করেছে, যার ফলাফল পাওয়া যাবে জুন ২০২৩ সালের পর। নোভাভ্যাক্স ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১২ বছর বা তার বেশি বয়সের শিশুদের মধ্যে টিকা পরীক্ষা করছে, যা জুন ২০২৩ পর্যন্ত চলবে। কিউবা ২ বছর বা তার বেশি বয়সীদের জন্য সোবারানা-২ টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ট্রায়ালের ওপর ভিত্তি করে। সোবারানা প্লাস নামে একটি বুস্টারের সঙ্গে মিলিত হলে এটি ৯০% কার্যকর বলে দাবি করা হচ্ছে।
নেচার মেডিসিন জার্নালে জুন মাসে প্রকাশিত একটি আকর্ষণীয় গবেষণায় ইসরায়েলে শিশুদের ওপর প্রাপ্তবয়স্কদের টিকার প্রভাব পরীক্ষা করা হয়েছে। গবেষকরা দেখেছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ২০ শতাংশ টিকাদান বৃদ্ধির জন্য, টিকা ছাড়াই ১৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে কভিড-১৯ অর্ধেক হ্রাস পেয়েছে।
শিশুদের কভিড-১৯ টিকা দেওয়ার আগে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বর্তমানে উপলব্ধ টিকার কার্যকারিতার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের সহযোগী সম্পাদক পিটার দোশি বলেছেন, টিকার কার্যকারিতার শতকরা হার আপেক্ষিক। কারণ এটি নির্বাচিত সুস্থ তরুণদের পরীক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। টিকার কার্যকারিতা জনগণের মধ্যে বাস্তব জীবনের আলোকে মূল্যায়ন করা উচিত। তিনি ইঙ্গিত করেছেন, ফাইজার ৩,৪০০-এর বেশি 'সন্দেহজনক কভিড-১৯ কেস' তার মূল্যায়ন থেকে বাদ দিয়েছে, যা অন্তর্বর্তী বিশ্নেষণে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া মডার্না এবং ফাইজার উভয়ই বেসলাইনে অন্য করোনা পজিটিভদের বর্জনের প্রয়োজন ছিল। উভয় কোম্পানি তাদের মূল তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। ইসরায়েলে ফাইজার টিকার সাম্প্রতিক কার্যকারিতা ৩৬% এবং সিডিসির ঘোষণা, ডেলটার বিরুদ্ধে এই টিকা ৬৬% কার্যকরী এসবের সঙ্গে তাদের ৯০ প্লাস কার্যকারিতার দাবি মেলে না।
হিউস্টনের বেইলর কলেজ অব মেডিসিনের ন্যাশনাল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডিন পিটার হোটেজ বলেন, 'আদর্শিকভাবে, আপনি চাইবেন যে টিকা দুটি কাজ করুক। প্রথমত, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস হবে এবং রোগ সংক্রমণকে বাধাগ্রস্ত করবে। দোশি যেমন বলেছেন, কখনও ট্রায়ালই 'হাসপাতালে ভর্তি, নিবিড় পরিচর্যার ব্যবহার বা মৃত্যুর মতো গুরুতর ফলাফলের হ্রাস শনাক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি।' মডার্নার প্রধান মেডিকেল অফিসার স্বীকার করেছেন, 'আমাদের ট্রায়াল সংক্রমণ প্রতিরোধ প্রদর্শন করবে না।' ২০২১ সালের জুলাই মাসে ফিলাডেলফিয়ার প্রভিন্সটাউন কাউন্টিতে টিকা সম্পন্ন করাদের মধ্যে ৭৪% সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে এই স্বীকারোক্তির মিল দেখা যায়।
কভিড-১৯ টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নথিতে সাধারণত উল্লেখিত হয় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের নিজস্ব দেশের টিকাগুলোর অনুমোদন দিতে বেশি আগ্রহী।
মেসেঞ্জার আরএনএ টিকাগুলো মায়োকার্ডাইটিস (হূৎপিণ্ডের পেশির প্রদাহ) এবং পেরিকার্ডাইটিসের (হূৎপিণ্ডের আবরণের প্রদাহ) সঙ্গে যুক্ত। সমস্যাটি ঘটে কভিড-১৯ টিকার দ্বিতীয় ডোজের পরে এবং টিকা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে। গত জুন মাসের মধ্যে, সিডিসি প্রায় ৩০ কোটি এমআরএনএ টিকাগ্রহীতার মধ্যে ১,২২৬টি মায়োকার্ডাইটিসের উল্লেখ করেছে, যার বেশিরভাগ ১২ থেকে ৩৯ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে (অন্য এক জরিপে এর হার ০.০০১% এরও কম পাওয়া গেছে)। উল্লেখ করা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সামান্য ছিল এবং সময়মতো ওষুধ গ্রহণ এবং বিশ্রামের পরে বেশিরভাগই ভালো হয়েছিল। হূৎপিণ্ড সম্পর্কিত লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং দ্রুত ঝাঁকুনি। টিকা নির্মাতাদের মতে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমরা এমন প্রতিবেদনও পেয়েছি, যা এই দাবি যে সঠিক তা বলে না।
গত ৮ মে পর্যন্ত ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সির (ইএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার ফলে ৫,৩৬৮ জন মারা গেছেন এবং ১৭০,৫২৮ জন অসুস্থ হয়েছেন। মডার্নার টিকা থেকে মৃত্যুর সংখ্যা ২,৮৬৫ এবং আহতের সংখ্যা ২,৯৮৫। এ দুটি টিকা একসঙ্গে ইইউতে বর্তমানে ব্যবহূত টিকার মোট মৃত্যুর ৭৮% এর জন্য দায়ী। তবে প্রণিধানযোগ্য, রোগ ও প্রতিরোধ সংশ্নিষ্ট প্রক্রিয়াগুলো ব্যক্তি, গোত্র ও জাতিভেদে বিভিন্ন হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তার অফিসিয়াল ভ্যাকসিন অ্যাডভার্স ইভেন্ট রিপোর্টিং সিস্টেম (ভিএইআরএস)- ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ এবং ১৪ মে, ২০২১ এর মধ্যে কভিড-১৯ টিকার কারণে ১৯৩,০০০টি 'প্রতিকূল ঘটনা' নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যে ৪,০৫৭টি মৃত্যু, ২,৪৭৫ স্থায়ী অক্ষমতা, ২৫,৬০৩টি হাসপাতালে জরুরি সেবাগ্রহণ এবং ১১,৫৭২টি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা আছে।
১৮টি ইউরোপীয় দেশ এবং অস্ট্রেলিয়ায় ৬০ থেকে ৬৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা নিষিদ্ধ। আফ্রিকার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো এবং এশিয়ার থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়াও পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত টিকাদান স্থগিত করেছে।
শিশুদের কি আগাম টিকা দেওয়া উচিত :শিশুদের জন্য করোনা টিকা নিরাপদ? এমআরএনএ টিকার এর আগে কখনও মানুষের ওপর ব্যবহার হয়নি। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনও অজানা। অ্যাস্ট্রাজেনেকা যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা অনুমোদিত হয়নি। রাশিয়ান টিকা কিছুটা ভ্যাক্সজেভরিয়ার অনুরূপ (রিকম্বিন্যান্ট টিকা)। এই টিকাগুলো সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসটির কিছু জীবন্ত উপাদান ধারণ করে। সিনোফার্ম, সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক এবং ভারতের কোভাক্সিন পুরো ভাইরাস নিষ্ফ্ক্রিয় করার মাধ্যমে উৎপাদিত। তাই এটি নিরাপদ হওয়া উচিত। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, সিনোফার্ম টিকা ৭৯ শতাংশ কার্যকরী এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা ৭০ শতাংশ।
কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হলো, শিশুদের বিশেষ করে যাদের বয়স ১২ বছরের কম, তাদের কি উল্লেখিত তথ্য এবং পরিসংখ্যানের আলোকে টিকা দেওয়া খুব প্রয়োজন? তাদের এর চেয়ে আরও অনেক বেশি মৃত্যু ঘটাচ্ছে যেসব রোগ, সেগুলো কি কম গুরুত্বপূর্ণ? যদি দিতেই হয়, করোনা টিকা দেওয়া উচিত? কভিড-১৯ একজন সংক্রমিত ব্যক্তির মধ্যে বিশেষত তার মধ্যে যদি রোগের যথেষ্ট পরিমাণে লক্ষণাদি প্রকাশ পায়, তা টিকার চেয়ে অনেক বেশি সংক্রমণ-প্রতিরোধ শক্তি তৈরি করে বলে ইসরায়েলে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর কারণ প্রচলিত টিকা সার্স-সিওভি-২-এর শুধু স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করে। কিন্তু সংক্রমণ পুরো ভাইরাসটির বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করে।
রোগতত্ত্ববিদ; বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কার্যকরী দলের সদস্য
© সমকাল ২০০৫ - ২০২২
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com