কাজলরেখা
বাপ মায়ের কথা, বংশের কথা না সুধাইয়াই, একমাত্র প্রাণ-দাতা বলিয়া রাজকুমার তাকে বিয়া করতে প্রতিজ্ঞা করল।
গান-
ঘরে আছিল ঘিরেত বাতি সদাই অগ্নি জ্বলে।
তারে ছুঁইয়া কুমার পরতিজ্ঞ যে করে।।
ঠিক এমন সময় ছান কইরা ভিজা কাপড়ে কাজলরেখা মন্দিরে প্রবেশ করল। ঢুইকাই দেখে যে তার স্বামী বাঁইচ্যা উঠছে।
গান-
গ্রহণ ছাড়িলে যেমন চান্দের প্রকাশ।
কুমারে দেখিয়া কন্যা পাইল আশ্বাস।।
প্রভাতের ভানু যিনি ছুরত সুন্দর।
একে একে দেখে কন্যা সর্ব্ব কলেবর।।
কন্যারে দেখিয়া কুমার লাগে চমত্‌কার।
এমন নারীর রূপ না দেইখ্যাছে আর।।
পরথম যৌবনে কন্যা হীরা-মতি জ্বলে।
কন্যারে দেখিয়া কুমার কহে মিঠা বুলে।।
'কোথা হতে আইলা কন্যা কি বা নাম ধর।
কিবা নাম বাপ মার কোন দেশে ঘর।।
কিসের লাগিয়া কন্যা ভ্রম বনে বনে।
স্বরূপ উত্তর দাও এই অভাজনে।।
মাও ত নিঠুরা তোমার বাপ ত নিঠুর।
ঘরের বাইর কইরা তোমায় দিল বনান্তর।।'
আগু হইয়া পরিচয় কহে কঙ্কণ দাসী।
'কঙ্কণে কিন্যাছি ধাই নাম কাঙ্কণ দাসী।'

রাণী হইল দাসী আর দাসী হইল রাণী।
কর্মদোষে কাজলরেখা জন্ম-অভাগিনী।।

সন্ন্যাসীর আদেশ মতে কাজলরেখা স্বামীর নিকট আত্ম-পরিচয় দিতে পারিল না। স্বামীর সঙ্গে দাসী হইয়াই স্বামীর রাজ্যে চলিয়া গেল।



কঙ্ক ও লীলা
গোপন দীক্ষা
জুহরী জহর চিনে বেনে চিনে সোনা।
পীর প্যাগাম্বর চিনে সাধু কোন জনা।।
পীরের অদ্ভুত কাণ্ড সকলি দেখিয়া।
কঙ্কের পরাণ গেল মোহিত হইয়া।।
সর্ব্বদা নিকটে কঙ্ক ভক্তিপূর্ণ মনে।
চরণে লুটায় তার দেবতার জ্ঞানে।।
তার পর জাতি ধর্ম সকলি ভুলিয়া।
পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া।।
দীক্ষিত হৈলা কঙ্ক যবন পীরের স্থানে।
সর্ব্বনাশের কথা কঙ্ক কিছুই না জানে।।
জাতি-ধর্ম নাশ হইল রটিল বদনাম।
পীরের নিকটে কঙ্ক শিখিয়ে কালাম।।
পীরের নিকটে যায় কেউ নাহি জানে।
গতায়তি করে কঙ্ক অতি সংগোপনে।।
ভক্তি-মুক্তি-তন্ত্র-মন্ত্র-দেহ মন প্রাণ।
অচিরে গুরুর পদে কৈল সমর্পণ।।
গুরুতে বিশ্বাস আর গুরু ইষ্ট ধন।
দামোদর দাস কহে এই ভক্তের লক্ষণ।।


চন্দ্রাবতী
প্রেম-লিপি
পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।।
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা।
'নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা।।
তোমার গাঁথা মালা লইয়া কন্যা কান্দিলো বিরলে।
পুষ্প বন অন্ধকার তুমি চল্যা গেলে।।
কইতে গেলে মনের কথা কইতে না জুয়ায়।
সকল কথা তোমার কাছে কইতে কন্যা দায়।।
আচরি তোমার বাপ ধর্ম্মে কর্ম্মে মতি।
প্রাণের দোসর তার তুমি চন্দ্রাবতী।।
মাও নাই বাপ নাই থাকি মামার বাড়ী।
তোমার কাছে মনের কথা কইতে নাহি পারি।।
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।
সর্ব্বস্ব বিকাইলাম পায় তোমারে যদি পাই।।
আজি হতে ফুল তোলা সাঙ্গ যে করিয়া।
দেশান্তরী হইব কন্যা বিদায়ে লইয়া।।
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দেও ভর।
যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিঙ্কর।।'


কমলা
কমলা-যৌবনাগমে
দেখিতে সুন্দরী কন্যা পরথম যৌবন।
কিঞ্চিত্‌ করিব তার রূপের বর্ণন।।
চান্দের সমান মুখ করে ঝলমল।
সিন্দুরে রাঙ্গিয়া ঠুঁট তেলাকুচ ফল।।
জিনিয়া অপরাজিতা শোভে দুই আঁখি।
ভ্রমরা উড়িয়া আসে সেই রূপ দেখি।।
দেখিতে রামের ধনু কন্যার যুগল ভুরু।
মুষ্টিতে ধরিতে পারি কটিখানা সরু।।
কাকুনি সুপারি গাছ বায়ে যেন হেলে।
চলিতে ফিরিতে কন্যা যৌবন পরে ঢলে।।
আষাঢ় মাস্যা বাঁশের কেরুল মাটি ফাট্যা উঠে।
সেই মত পাও দুইখানি গজন্দমে হাঁটে।।
বেলাইনে বেলিয়া তুলিছে দুই বাহুলতা।
কণ্ঠেতে লুকাইয়া তার কোকিলে কয় কথা।।
শ্রাবণ মাসেতে যেন কাল মেঘ সাজে।
দাগল-দীঘল কেশ বায়েতে বিরাজে।।
কখন খোঁপা বান্ধে কন্যা কখন বান্ধে বেণী।
কূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী।।
অগ্নি-পাটের শাড়ী কন্যা যখন নাকি পরে।
স্বর্গের তারা লাজ পায় দেখিয়া কন্যারে।।
আষাইঢ়া জোয়ারে জল যৌবন দেখিলে।
পুরুষ দূরের কথা নারী যায় ভুলে।।

বিষয় : মৈমনসিংহ গীতিকা

মন্তব্য করুন