ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে নিজের ভিডিওচিত্র আপলোড করে আশরাফুল হোসেন ওরফে 'হিরো আলম' পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর মিউজিক ভিডিও দেখেন না, এমন অনেকেও এখন নামটির সঙ্গে পরিচিত। কারণ, সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। সম্প্রতি বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হিরো আলম মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরে গেছেন। হারার পর হিরো আলম অভিযোগ করেছেন, তিনি অশিক্ষিত বলে তথাকথিত শিক্ষিতরা তাঁকে মেনে নিতে চান না। তাঁর মতো একজনকে 'স্যার' ডাকতে হবে বলে কারচুপি করে নির্বাচনের ফল পাল্টে দিয়ে তাঁকে হারানো হয়েছে।

হিরো আলমের এমন অভিযোগ সত্যি কিনা তা অনুসন্ধানের বিষয়। এই লেখায় এ সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু হিরো আলম উপনির্বাচনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেয়েছেন। সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাচ্ছে- বগুড়ার ওই আসনে যে নতুন ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে, সেই তরুণদের প্রায় সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং তাঁরা হিরো আলমের কনটেন্টের নিয়মিত দর্শক। তাঁদের ভোট হিরো আলম পেয়েছেন- এটি ধারণা করা হচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যমে হিরো আলমের ফলোয়ার অনেক- বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এমন তথ্য গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু হিরো আলমের এই জনপ্রিয়তা বর্তমান সমাজের রূপ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তৈরি করে। যে ধরনের ভিডিওর কারণে হিরো আলম বর্তমান সময়ে অনেক মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন, মানুষের চিন্তা আর রুচির ওপর এমন ভিডিওর প্রভাব নিয়ে কি গভীরভাবে চিন্তা করা হচ্ছে আমাদের সমাজে? এমন কনটেন্টের দর্শকপ্রিয়তা বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের বহু মানুষের মন আর সাংস্কৃতিক রুচি সম্পর্কে কী নির্দেশ করে- তা বিশ্নেষণ করা কি জরুরি নয়?

উপনির্বাচনটিতে হিরো আলম একতারা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন। যে একতারা বাংলার গ্রামের বাউল আর বয়াতিদের ঐতিহ্যবাহী গানের গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতীক, নির্বাচনের জন্য হিরো আলম সেই প্রতীক বেছে নিলেও, যে ধরনের ভিডিওতে তাঁকে গান গাইতে বা অভিনয় করতে দেখা যায়, সেখানে বাউল সংগীতের দার্শনিক গভীরতা আর চিন্তাশীলতার ছিটেফোঁটাও নেই। বরং বাণিজ্যিক লাভের জন্য চটুলতা ও ভাঁড়ামি প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেসব ভিডিও। গানের কথা ও অভিনীত দৃশ্যে চিন্তাঋদ্ধতা নেই; আছে স্থূলতা ও তারল্য।

হলিউডের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে পুরুষ দর্শকের দৃষ্টিকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য নারীদের উপস্থাপন করা হয়- এমন প্রবণতার কথা নিজের এক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন ইংরেজ চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক লরা মালভে। হলিউডের বাইরেও নানা দেশে গণমাধ্যম উপাদানে দেখা যায় নারীর এমন উপস্থাপন। হিরো আলমের ভিডিওতেও প্রায়ই দেখা যায়, নারী উপস্থাপিত হয়েছেন পুরুষ দর্শকের মনোরঞ্জনের বস্তু হিসেবে।

নারীর জন্য অবমাননাকর উপস্থাপন বাণিজ্যিক হিন্দি চলচ্চিত্রে বহু বছর ধরে চলছে। এর অন্ধ অনুকরণ দেখা যায় আমাদের দেশের বাজারধর্মী কিছু ছবিতেও। ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে দেশের বহু মানুষ- বেশিরভাগই কম বয়সী- নিয়মিত দেখছে হিরো আলম নির্মিত ও অভিনীত এমন ভিডিও। বিপুল দর্শক থাকার ফলে নির্মাতার আর্থিক লাভ হচ্ছে; কিন্তু চটুল, স্থূলতাসর্বস্ব বিনোদন বিতরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজ। কারণ, এমন বিনোদন মানুষের মনে সুরুচি আর সচেতনতা তৈরি করতে পারে না।


সামাজিক মাধ্যমের চটুল বিনোদনধর্মী ভিডিওতে অংশ নিয়ে জনপ্রিয় হলেই কি তাঁদের প্রশংসা করা যায়? বহু মানুষ কোনো নেতিবাচক দিকে ঝুঁকে পড়লেই তো আর সেই নেতিবাচক দিক ইতিবাচক হয়ে যায় না। সামাজিক পরিবেশ মানুষকে যেভাবে প্রভাবিত করে, তার মাধ্যমেই সমাজের রূপ নির্ধারিত হয়। বিভিন্ন সামাজিক আর রাজনৈতিক সমস্যা সমাজে দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির নাচ-গান অনুকরণ এবং নারীকে যৌন বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে তৈরি উপাদানে যে সমাজে বহু মানুষকে বুঁদ করে রাখা হয়, সেখানে বিভিন্ন সামাজিক অন্যায় কেন ঘটছে এবং কীভাবে অন্যায় বন্ধ করা যায়, সেই বোধ সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হবে- তা আশা করা যায় না।

গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দর্শককে পারসুয়েড বা প্ররোচিত করা। যখন চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপন, মিউজিক ভিডিওতে চটুল উপাদান খুব আকর্ষণীয়ভাবে দেখানো হয় তখন দর্শককে তা কোন ধরনের আচরণে উদ্বুদ্ধ করে? কবি ও লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- 'তুমি কনটিনিউয়াসলি সেক্স এবং সেক্স সংক্রান্ত অ্যাড দেবে আর তারপর একটা রেপের ঘটনা ঘটলে অবাক হয়ে বলবে- আমাদের দেশটা কোথায় যাচ্ছে! তুমি সারাক্ষণ তাকে টিটিলেট করছ, সারাক্ষণ।' চটুল উপাদান তাই সাধারণ মানুষের কোনো উপকার করে না। তা সাধারণ মানুষকে করে বোধহীন। আর বোধহীন মানুষের সংখ্যা বাড়লে তাদের শোষণ করা যায় খুব সহজেই।

গ্রামের কিংবা নিম্নবিত্ত শ্রেণির একজন ব্যক্তি হালকা বিনোদনসর্বস্ব উপাদান তৈরি করলেই তা সাধারণ মানুষ বা গ্রামের সংস্কৃতি হয়ে ওঠে না। চটুল উপাদান যাঁরা তৈরি করেন তাঁরা নিম্নবিত্ত বা সুবিধাভোগকারী হোক, তাঁদের লক্ষ্য একই। তা হলো- আর্থিক মুনাফাপ্রাপ্তি। এমন সাংস্কৃতিক উপাদানে দর্শকের মধ্যে সুরুচি আর চিন্তাশীলতা তৈরির তাগিদ থাকে না।

হিরো আলমকে সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপনের একটি প্রবণতাও সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়। কিন্তু যে ধরনের ভিডিওতে অংশ নিয়ে হিরো আলম জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, সেই ধরনের গভীরতাহীন ভিডিও কেন সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি হবে? সাধারণ মানুষ কেবল চটুল বিনোদনসর্বস্ব উপাদান দেখবে আর চিন্তাশীল সাংস্কৃতিক উপাদান কেবল শিক্ষিত মানুষের জন্য- তা তো নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যেও যেন বিবেচনাবোধ আর চিন্তার গভীরতা তৈরি হয়- এটি নিশ্চিত করা জরুরি।

গ্রামের মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে তৈরি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা চলচ্চিত্র যেমন- 'পথের পাঁচালী', 'সূর্যদীঘল বাড়ি', 'মাটির ময়না' কি সাধারণ মানুষের দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়? এমন চলচ্চিত্র গণমানুষকে দেখার সুযোগ না দিয়ে তাদের চটুল বিনোদন উপভোগে অভ্যস্ত করে আর্থিক মুনাফা অর্জনের চেষ্টার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে চিন্তাসমৃদ্ধ উপাদান পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। বিনোদনও মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভাঁড়ামি, চটুলতা আর যৌন সুড়সুড়ি কখনোই সুস্থ বিনোদন নয়।

যে ধরনের সাংস্কৃতিক উপাদান হিরো আলম এবং আরও অনেকে নির্মাণ এবং বিতরণ করছেন, তেমন উপাদান মুখরোচক হলেও, তা মনের স্বাস্থ্যের কী ক্ষতি করছে- এটি ভাবতে হবে। তবে কাহালু-নন্দীগ্রাম আসনের উপনির্বাচনে এই এলাকার যে বাসিন্দারা হিরো আলমকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের কিছু বক্তব্য নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। তাঁরা বলেছেন, রাজনীতিবিদ নন- এমন একজন সাধারণ মানুষ সংসদে গেলে তাঁদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে পারতেন। এক তরুণ ভোটার জানিয়েছেন, হিরো আলম সব সময় গরিবের পাশে থাকেন। অন্যরা ভোট নিয়ে জনগণের খোঁজ রাখেন না। তাই তাঁরা হিরো আলমকে ভোট দিয়েছেন।

সাধারণ মানুষ কেন রাজনীতিবিদদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কি আদৌ চিন্তিত? সংসদ সদস্য হতে হলে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর মূল্যবোধ থাকা দরকার, বর্তমান সময়ে জনপ্রতিনিধিদের আচরণে কি সেই গুণগুলোর প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি? নানা অনিয়ম আমাদের চোখে পড়ে। বহু মানুষের মধ্যে চিন্তাশীলতা ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি হলেই মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে নিয়মহীনতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করবে। আর অন্তঃসারশূন্য চটুল সংস্কৃতিতে বেশিরভাগ মানুষ আচ্ছন্ন থাকলে শোষণের বিরুদ্ধে কখনোই প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

ড. নাদির জুনাইদ: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়