
অমর একুশে গ্রন্থমেলার সময় বাংলা একাডেমি নানা কারণেই আলোচনায় উঠে আসে; প্রায় প্রতি বছরই দেখে থাকি। এবারও আলোচনায় এসেছে, তবে ভিন্নধর্মী একটি কারণে। এর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাডেমির সম্পর্ক বিষয়ে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা শুনছি।
বাংলা একাডেমি এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্তাব্যক্তির কথিত অবস্থান বা নির্দেশনা নিয়ে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে- বাংলা একাডেমি সরকার বা মন্ত্রণালয়ের আর দশটা বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মতো কিনা। নাকি জাতির মনন ও মেধার প্রতীক বাংলা একাডেমি আর দশটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মতোই চলবে?
একটি পক্ষ বলছে- ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাসকৃত বাংলা একাডেমি আইনের ৩-এর ২ ধারা মোতাবেক বাংলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে কার্যনির্বাহী পরিষদ। এই পরিষদে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন সদস্য থাকবেন। এ ছাড়া থাকবেন একাডেমির মহাপরিচালকসহ শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অন্য সদস্যরা। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাঁরাই নেবেন। প্রশ্ন উঠেছে, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মতামত বা অভিপ্রায় কতটা প্রতিফলিত হতে হবে?
মনে রাখা জরুরি, আমাদের দেশের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা কীভাবে বজায় থাকবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, এটা নিয়ে সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভাগের সঙ্গে সংঘাত বেশ পুরোনো। নানা প্রসঙ্গ ও পর্বে সংঘাতের বিষয়টি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বা আলোচনায় চলে আসে।
এই দফায় আলোচনা উঠেছে- বাংলা একাডেমির স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে কীভাবে। বাংলা একাডেমির পক্ষে সরব পক্ষগুলো মনে করছে, প্রতিষ্ঠানটিকে 'নিয়ন্ত্রণ' করতে চাইছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। যদি বাংলা একাডেমি আইন দেখি, তাহলে এভাবে নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। কোনো অবস্থাতেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব একাডেমির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জেনেছি, সম্প্রতি সংস্কৃতি সচিব একুশে গ্রন্থমেলাকেও বাংলা একাডেমির বদলে সরাসরি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছেন। একাডেমির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে নাকি এমন কথাও বলা হয়েছে- কীসের স্বায়ত্তশাসন!
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা একাডেমির 'স্বায়ত্তশাসন' কীভাবে চর্চিত হবে। কারণ আইন হলেই হয় না; এর জন্য বিধিমালা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, সেই বিধিমালা আমি দেখিনি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা- আমরা যখন কাজ করেছি তখন অধ্যাদেশের অধীনে কাজ করেছি। সেই অধ্যাদেশে কোথাও আবার 'স্বায়ত্তশাসন' কথাটি লেখা ছিল না। তবে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক কতটুকু স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করতে পারেন, সেটির ওপর নির্ভর করবে একাডেমি কত স্বায়ত্তশাসিত থাকবে।
এই যে 'গ্রে এরিয়া'; এর মধ্য দিয়েই কাজ করতে যেতে হয়। বাংলা একাডেমিতে কাজের ক্ষেত্রে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। দায়িত্ব গ্রহণের দ্বিতীয় দিনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি এলো, তাতে একজন উপসচিব স্বাক্ষর করেছেন। চিঠিটিতে বলা হয়েছিল- সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও যে যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের সব প্রধানকে নিয়ে একটি সভা হবে। তাতে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবেই আমাকে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়েছিল।
চিঠিটি পেয়ে আমি তৎকালীন সংস্কৃতি সচিবকে ফোন করলাম। তাঁকে জানালাম, এই সভায় আমি যাব না। কারণ, বাংলা একাডেমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি অধীন নয়। ওই সময় যিনি সংস্কৃতি সচিব ছিলেন, তিনি একজন মার্জিত এবং সংস্কৃতবান মানুষ ছিলেন বলে আমি মনে করি। তিনি বিষয়টির গুরুত্ব হৃদয়ঙ্গম করলেন এবং আমার কাছেই পাল্টা জানতে চাইলেন, তাহলে কী করা যেতে পারে। আমি আমার সাধ্যমতো পরামর্শ দিলাম। এর পর দুই ঘণ্টা পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে একটি নতুন চিঠি ইস্যু করা হলো। সেটার ভাষ্য ভিন্ন। পরে আমি সেই সভায় অংশ নিয়েছিলাম এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে হৃদ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছিল। পরেও বাংলা একাডেমি ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো সংঘাত ও মতবিরোধ তৈরি হয়নি। আমরা যখন যে সহযোগিতা চেয়েছি, মন্ত্রণালয় আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেছে। 'অধীন' সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করেনি।
আমি যখন মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলাম, চেষ্টা করেছি আইন ও সরকারি ব্যবস্থার মধ্যেই বাংলা একাডেমির স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে। মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি দুটি ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। একটি অপরের উপরস্থ বা অধীন নয়, বরং সম্পূরক। এটা ঠিক, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাংলা একাডেমির কার্যক্রমে ততটুকুই হস্তক্ষেপ করতে পারে, যতটুকু আইনে বিদ্যমান। তারপরও বাংলা একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনীতিবিদ ও আমলারা। অপরদিকে বাংলা একাডেমি পরিচালনা করেন বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা জাতির মেধা, মনন ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিনিধিত্ব করেন- সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এই বাস্তবতা বুঝতে হবে।
আমি মনে করি, যিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হবেন, তাঁকেও বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানে দৃঢ় থাকতে হবে। বাংলা একাডেমিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কতটা 'নিয়ন্ত্রণ' করতে চাইবে বা পারবে, সেটা বহুলাংশে নির্ভর করে এর মহাপরিচালক কতটা দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেন।
বাংলা একাডেমি নিয়ে আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করি। বাংলা একাডেমি আইন তৈরি করার সময়ে আইন মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছিল। তারপর আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপিত হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময়ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একটি সভায় আমার বক্তব্য ছিল বাংলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। সেই সময় একজন মন্ত্রী, যিনি বর্তমানে প্রয়াত; তখন আপত্তি তুলে বলেছিলেন- সরকারি টাকায় বাংলা একাডেমি স্বায়ত্তশাসন চায় কীভাবে? তখন আমি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে বলেছিলাম, সরকারের টাকা বলতে কিছু নেই। টাকা হচ্ছে জনগণের।
ওই সময় আমি আরও বলেছিলাম- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, টাকা আপনারও নয়, আওয়ামী লীগেরও নয়, সরকারেরও নয়। তাই বাংলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আমার মত। একাডেমির দায় থাকবে, কিন্তু স্বাধীন থাকতে দিতে হবে। স্বাধীনতা এবং দায়বদ্ধতা গুলিয়ে ফেললে চলবে না। পরে সেই আইনটি হয়েছিল।
এখন একাডেমির স্বাধীনতা কীভাবে রক্ষিত হবে- এমন প্রশ্ন যখন সামনে আসে তখন আমি মনে করি, এর সমাধানে মহাপরিচালককে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তাঁর সঙ্গে থাকবেন দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানুষেরা।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
মন্তব্য করুন