ছয় বছর আগে শুরু হওয়া এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পের কাজ গত বছর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজের অর্ধেকও সম্পন্ন না হওয়ার বিষয়টি হতাশাজনক। বস্তুত দেশের প্রায় সব প্রকল্পেই অভিন্ন পরিস্থিতি দেখে আসছি। নির্ধারিত সময়ে কাজ না হলে যেমন খরচ বেড়ে যায়, একই সঙ্গে মানুষের দুর্দশাও চরমে ওঠে। রোববার সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পটির মূল ব্যয় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা হলেও নতুন করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মেয়াদ বাড়ানোর ফলে ব্যয় আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। কিন্তু প্রকল্পটির বর্তমান যে অবস্থা তাতে ওই বর্ধিত সময়েও এর কাজ শেষ হবে কিনা, সে শঙ্কা রয়েছে।

সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়কের তিনটি বড় স্পটে এক বছর ধরে কাজ বন্ধ এবং বাকি ছয় স্পটের কাজেও শম্বুকগতি। সামনে বৃষ্টির মৌসুমে কাজ আরও শ্নথ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ১৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির এ উন্নয়ন কাজ দেশ-বিদেশের পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি। আগেভাগে শুরু করেও কাজ বাস্তবায়নে অন্য ঠিকাদারদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে এ প্রতিষ্ঠান। আমরা মনে করি, এর দায় কেবল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির একার হতে পারে না। চলমান প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অংশের কাজ এক বছর ধরে যেভাবে বন্ধ রয়েছে, সেখানে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কী করছে?

আমরা জানি, চারটি আন্তর্জাতিক করিডরে যুক্ত হবে এই টাঙ্গাইল-রংপুর সড়কটি। স্ব্বপ্নের চার লেনে এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) এবং বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডরে (বিসিআইএম) নতুন করে বাংলাদেশের আটটি মহাসড়ক যুক্ত হবে। ওই সড়কগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬০০ কিলোমিটার। এরই মধ্যে সাসেক-১ এর আওতায় গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে চন্দ্রা হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হলেও সাসেক-২-এর আওতায় এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর পর্যন্ত মহাসড়কের বর্তমান গতিহীনতা স্পষ্ট।

আন্তর্জাতিক মানে এ মহাসড়কটি গড়ে তোলার কথা বলা হলেও সেখানে নির্মাণে ঝামা ইটের খোয়ার মান নিয়ে সরকারের প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) যে প্রশ্ন তুলেছে, তা উদ্বেগজনক। আইএমইডি যথার্থই বলেছে, ইটের মান ঠিক না থাকলে মহাসড়ক টেকসই হবে না। প্রকল্প পরিচালক যদিও বলেছেন, 'আইএমইডি কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকায় গিয়ে কিছু পোড়া ইট দেখেছেন। তবে ওই ইট আমরা সড়কে ব্যবহার করিনি।' তার পরও আমরা মনে করি, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা উচিত। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ২০২০ সালের নভেম্বরে এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পের ব্যাপারে আইএমইডির পক্ষ থেকে 'নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হলে ঠিকাদারকে জনবল ও নির্মাণসামগ্রীর মোবিলাইজেশন বাড়াতে হবে' মর্মে তাগিদ দেওয়ার পরও আমরা সেই পরিণতিই দেখছি!

বলার অপেক্ষা রাখে না, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই পথ ব্যবহার করেন। রাজধানী থেকে উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার যাত্রীরা বলা চলে দুর্ভোগের মধ্যেই যাত্রা করেন। আশুলিয়া, চন্দ্রায় তীব্র যানজট পার হয়ে তাঁদের এই চার লেনের কাজের কারণে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত আবার দীর্ঘ যানজটের দুর্ভোগে পড়তে হয়। প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হতে যত দেরি হবে, যাত্রীদের দুর্ভোগ তত লম্বা হবে। সেই সঙ্গে প্রকল্প খরচের বিষয়টি তো রয়েছেই।

চার লেনের প্রকল্পটি যেন পথ হারিয়েছে। মহাসড়কে গতি আনয়নের প্রকল্পই যদি গতিহীন হয়, তার চেয়ে হতাশা আর কী হতে পারে! আমরা চাই, প্রকল্পটির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক। যাদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করে প্রকল্পে গতি আনতেই হবে। দেশের প্রকল্পগুলো যেভাবে স্বেচ্ছাচারিতা, অপব্যয়, সময়ক্ষেপণ আর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা চলতে পারে না।