- মতামত
- হামলা-মামলা নয়, সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা চায় শিক্ষার্থীরা
হামলা-মামলা নয়, সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা চায় শিক্ষার্থীরা

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- সমকাল
বেশ কিছুদিন থেকে ক্যাম্পাসের কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে লাগাতার হামলা চালানো হচ্ছে ছাত্রলীগ ও পুলিশ দিয়ে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন খোদ ভিসি মহাশয়। আমার এখনও ইচ্ছা করছে ঘটনাটি অবিশ্বাস করি। না দেখার ভান করি। অন্তত কিছু একটা নাটক করে এই সংকট পার করে দিই। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ঢুকে কীভাবে? জলকামান-মারণাস্ত্র নিয়ে গেট দিয়ে প্রবেশ করে কীভাবে?
এখানেই শেষ নয়, সোমবার (১৭ জানুয়ারি) ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। মামলার এজাহারে কাজে বাধা প্রদান, গুলিবর্ষণ এবং হত্যার উদ্দেশ্যে মারধরের অভিযোগ আনে তারা। প্রযুক্তির বদৌলতে দেখতে পেলাম, আদতে কী ঘটেছিল সেখানে। আর কাজে বাধা বলতে পারতাম যদি শিক্ষার্থীরা থানার সামনে কিংবা পাবলিক এরিয়াতে গিয়ে পথ অবরোধ করত। নিজেদের ক্যাম্পাসে ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল শিক্ষার্থীরা। তারা কি পুলিশকে বলেছিল বিষয়ের সমাধান করতে? নাকি কোনো সাংবিধানিক নিয়ম! তাদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রকাশ্য আলোতে রাবার বুলেট, জলকামান, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে রক্তারক্তি করে দিয়েছিল পুরো এলাকা। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন আচরণ সংবিধান পরিপন্থি হয় না?
বাংলাভাষী শক্তিশালী কবি নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, 'যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না আমি তাকে ঘৃণা করি একজন কবি হিসেবে। একজন সাংবাদিক হিসেবে। একজন সচেতন কিংবা সাধারণ নাগরিক হিসেবে শিক্ষাযন্ত্রের নোংরা এ খেলায় তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করি। এ হামলা এবং মামলার দায় উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদ ও তার পেছনের শক্তিকে আমি ঘৃণা করি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছি।'
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে এই শিক্ষার্থীরা। পরিবার, উঠতি বয়সের বন্ধুবান্ধব- পরিচিত সব তারুণ্য ফেলে চলে এসেছে এখানে। নতুন করে নিজেকে শিখছে। পড়াশোনা, আড্ডা, গান, আলোচনা- এসবের ভেতর মিশে তৈরি করতে চলেছে একটা সিরিয়াস লিডিং জেনারেশন। যে জেনারেশনটা আগামীকাল হাল ধরবে দেশের। কেউ রাজনীতি করবে, ব্যবসা করবে, শিল্পী হবে, কৃষিবিদ হবে, শিক্ষক হবে। এদের সেভাবে তুলে ধরাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। তাদের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত বীজ দিয়ে কৃষক উন্নত শস্য ফলাবে। উন্নত উদ্ভাবন করবে। প্রকৃত উন্নয়ন করবে। আজকে তারা দক্ষিণ এশিয়ার একশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও আসতে পারছে না।
আজকে তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান সন্ধানের দিকে থাকা দরকার। থাকার কথা গবেষণা নিয়ে। কিন্তু এখন অবধি বের হতে পারছে না ক্যাম্পাসের দূষণ থেকেই। ক্যাম্পাসের সংকট, দুর্নীতি, অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ক্লিন ক্যাম্পাস না থাকলে এভারগ্রিন মাইন্ড সেটআপ আদতে কি সম্ভব? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গভীরভাবেই জানার কথা। শাবিপ্রবির শিক্ষকরা কোথায়? সংকটগুলো কি শুধু শিক্ষার্থীরাই দেখছে? এতসব শিক্ষার্থী মার খেল। তাদের নিয়ে শিক্ষকদের বক্তব্য কোথায়?
দেশে সর্বমোট দুটি আন্তর্জাতিক, ৫৮টি পাবলিক ও অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষা, আবাসন, ব্যবস্থাপনাসহ সব সেক্টরের তেলেসমাতি আমাদের চোখের সামনেই। আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কীভাবে ত্রাসের রাজনীতি চালানো হচ্ছে। শত বছরের গর্বিত ক্যাম্পাসগুলোর আবাসনে কী মানবেতরভাবে থাকে তারা। উঁইপোকা আরশোলার যন্ত্রণায় দুই তিন পরশন রেপিন দিয়ে তারপর ঘুমাতে হয়। কোনোভাবে দুটি টিউশনি জুটাতে পারলে ক্যাম্পাসের বাইরে ম্যাচ ভাড়া করে থাকতেই শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। খাবারের মান ওই শিঙাড়া আর সমুচা। সর্বোচ্চ ভালো খাবারের মধ্যে দুই টুকরো মাংস আর এক বাটি ঝোল।
এর আগে একটা ছোট অভিজ্ঞতা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক দুপুরের ২০ টাকা টোকেনের খাবার খেতে গিয়েছিলাম আমানত শাহ হলে। ডালের বোল থেকে এঁটো পানির বোলের ঘনত্ব এবং রং বেশি সুন্দর। তরকারির বাটি থেকে সাঁতরে খুঁজে বের করতে হয় এক টুকরো মাংস। এ ছাড়া হলগুলোতে নতুন শিক্ষার্থীরা উঠলে দশ বছর থেকে সিট দখলে রাখা রাজনৈতিক বড় ভাইদের টর্চার। দিন নেই রাত নেই যখন তখন ফরমায়েশ খাটা। অনিচ্ছায় মিছিলে যাওয়া। অনিচ্ছায় এসব কাজ করে থাকে অনেকেই। এসবের ভুক্তভোগী হচ্ছে খোদ শিক্ষার্থীরাই।
এতসবের পরও শিক্ষার্থীরা কথা বলতে পারবে না। পারবে না অন্যায়কে অন্যায় বলতে। কথা বললে আবরার মারা যায়। হাফিজুর অন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে লাঞ্ছিত হতে হয়। সাত জন্মের ভাগ্য আমাদের; এখনও শিক্ষার্থীরা কথা বলছে। নিরাপদ সড়কের জন্য রাস্তা অবরোধ করছে। এখনও শিক্ষার্থীরা মনে করে দেশটা একদিন সুন্দর হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। আশা ধরে রেখেছে তারা। এখনও মনে করে পচে যাওয়া এ দেশ একদিন ঠিক হবে। সে জন্যই এত বিক্ষোভ এত আন্দোলন। এগুলো এভাবে দমাবেন না দয়া করে। এদের মেরুদণ্ড গোড়াতেই ভেঙে দিলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন না আপনারাও।
আরেকটু সদয় হোন। এই শিক্ষার্থীদের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিন। ভিসিরা রাজনীতি করবেন তাতে কেউই আটকাচ্ছে না। বরং শিক্ষকরা রাজনীতিতে এলে দেশের ফায়দা। কিন্তু সে ফায়দা লুটপাটে ব্যবহার করা আসলে কতটুকু নৈতিক! আপনাদের অবস্থান থেকেই একবার ভেবে দেখুন। এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, কোনো সহযোগিতার হাত বাড়াননি শিক্ষকরাও। রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের সংহতির নামে নিজেদের দল ভারী করার ফন্দি আঁটছে। বুদ্ধিজীবীদের কথা উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। সে ক্ষেত্রে ছাত্ররা একাই আলাপ তুলছে নিজেদের অধিকার নিয়ে। সংগঠিত করছে নিজেদেরকে।
রাষ্ট্র বা সরকার নামানোতে কোনো ইচ্ছা নেই তাদের। নয় তারা জঙ্গি বা সন্ত্রাসীও। তারা জানে সময়ে সময়ে অন্যায্যতার বিপক্ষেই লড়াই ছিল ছাত্র সমাজের। তারা হটাতে চায় নৈতিক অবক্ষয়। একটি সুন্দর দেশ চায়। সুন্দর পৃথিবী চায়। দয়া করে দমাবেন না এসব সম্ভাবনাময় কণ্ঠস্বরগুলোকে। শিক্ষার্থীদের আটকানোর চেষ্টা করলে এর ফলাফল কী ভয়ংকর হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসই তার অকাট্য প্রমাণ। শিক্ষার্থীদের দমাতে চাইলে অদূর ভবিষ্যতে এর ফল ভালো হবে না। মনে রাখা দরকার, কখনও কোনো দেশে অত্যাচার দিয়ে তারুণ্যকে আটকানো যায়নি। আর যাবেও না। হামলা মামলা নয়। রাষ্ট্রের কাছে সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা চায় শিক্ষার্থীরা।
মন্তব্য করুন