আমার শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো আমিও কিশোরগঞ্জের সন্তান। আমার বাবা জয়নুল আবেদিনের নাম জানতেন। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভীষণ ভালোবাসতাম বলে একটু বড় হওয়ার পরও যখন আমার সেই ঝোঁক আগের মতোই বজায় থাকল, বাবা আমাকে কথা দিলেন, জয়নুল আবেদিনের কাছে নিয়ে যাবেন। জয়নুল আবেদিন তখন ঢাকার শান্তিনগরে একটা পুরোনো বাড়িতে থাকতেন। আমরা বাড়িতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে পেয়ে গেলাম। পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, কিশোরগঞ্জে আমাদের বাড়ি। ভেতরে নিয়ে বসিয়ে কোমল স্বরে বললেন, ‘কী চাও?’ আমি বললাম, ‘আমি চারুকলায় পড়তে চাই।’ তিনি বললেন, ‘খুব আগ্রহ বুঝি ছবি আঁকার?’ আমি তখন বিভিন্ন ভারতীয় সাময়িকী দেখে দেখে ছবি আঁকতাম। সেইসব ছবির কিছু কিছু ভয়ে ভয়ে তাঁকে দেখাতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘তোমার ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। তুমি কালকেই গিয়ে চারুকলায় অ্যাডমিশন নিয়ে নাও। বলবে, জয়নুল আবেদিন বলেছেন।’ পরদিন আমি চারুকলায় গিয়ে জানতে পারলাম, ভর্তি নেওয়া দুই মাস আগে শেষ হয়েছে। তবু আবেদিন স্যার যেহেতু বলে দিয়েছেন, আমাকে ভর্তি করে নেওয়া হলো।
আমি সদ্য গ্রাম থেকে গিয়ে প্রথম বর্ষে ক্লাস আর কাজের অনেক কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠিনি। তবু মনপ্রাণ ঢেলে নিজের সেরাটা দিতে চেষ্টা করতাম। মাঝেমধ্যে আবেদিন স্যারের কাছে যেতাম, কথা বলতে চাইতাম। তিনি আমাকে উৎসাহ দিতেন। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর কিছু ঘটনা আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকল। তখন আমি জলরঙের কাজ করি, এবং আমার কাজ আবেদিন স্যার খুব পছন্দ করেন। কাজে বৈচিত্র্য আনার জন্য আমি বাড়ি থেকে আমার মায়ের পুরোনো শাড়ি নিয়ে এসে সেই শাড়ি কাগজের ওপর আঠা দিয়ে লেপ্টে, তার ওপর জলরং করতাম। এতে রং আর ছবি দুটোই অন্যরকম হয়ে ফুটত। আবেদিন স্যার আমার এ নিরীক্ষা ভীষণ পছন্দ করলেন। একটা বার্ষিক প্রদর্শনী এলো। আবেদিন স্যার নির্বাচকদের বলে দিলেন, ‘হামিদের কাজ যেন বাদ দিও না।’ অন্যদের দুটো করে কাজ নিলেও আমার চারটার মতো কাজ নেওয়া হয়। আমার ছবিতে ফ্রেম করানোর সাধ্য ছিল না। কিন্তু প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখি আমার ছবিতে ফ্রেম! শুনলাম প্রিন্ট মেকিং বিভাগে কিছু বাড়তি ফ্রেম ছিল। খবর পেয়ে আবেদিন স্যার ওগুলো আমরা ছবিতে জুড়ে দিতে বলে দেন। ছবিগুলো আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছিল। প্রদর্শনী শেষে দেখি ছবিগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। কিনেছেন জয়নুল আবেদিন স্বয়ং। আমি বললাম, ‘স্যার এ কী, আপনি আমার ছবি কিনে নিয়েছেন!’ তিনি বললেন, ‘তোমার ছবি খুবই সুন্দর।’ উৎসাহে, আনন্দে আমার বুক ভরে গেল।
একদিন স্যার বললেন, ‘হামিদ, তোমার কাছে ভালো জামা কি আছে?’ আমি বললাম, ‘স্যার, এগুলোই তো– পাজামা, শার্ট।’ স্যার বললেন, ‘তুমি এক কাজ করো। বাসায় গিয়ে সব ভালো করে ধুয়ে দিও। প্রেসিডেন্ট নে উইন আসবেন। আমি তাঁকে তোমার আঁকা ছবি উপহার দেবো।’ মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট নে উইন, মিয়ানমারের ইতিহাসে অন্যতম সেরা নেতা। আমি রোমাঞ্চিত। যথাসময়ে তিনি এলেন। আবেদিন স্যার আমাকে নে উইনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে, আমার হাত দিয়ে তাঁকে আমার ছবি উপহার দেওয়ালেন। সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। পত্রিকায় নে উইনের সঙ্গে আমার ছবি ছাপা হয়েছিল। আমার কাছে এখনও সংবাদপত্রের কাটিং আছে। এই ছিলেন আবেদিন স্যার। ছাত্রদের উৎসাহ কীভাবে দিতে হয়, তাঁর মতো আর কে জানত? সেদিন আমার ছবি ছাড়াও আজকের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলামের ছবি, হোসনে জামালের ছবি– অপূর্ব ছাপচিত্র করতেন হোসনে জামাল– স্যার নে উইনকে উপহার দিয়েছিলেন। এমনটাই ছিলেন আবেদিন স্যার, ছাত্র অন্তঃপ্রাণ। শতপথে উৎসাহ দিয়ে যেতেন।
সাতষট্টি সালে যখন ফাইনাল ইয়ারে তখন, একটা ভয়ানক দুর্ঘটনায় পড়ি। আমি আর শিল্পী আবদুর শাকুর শাহ সাইকেলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। মাথায় ভয়াবহ আঘাত পেলাম। রক্তে সব ভেসে গেল। আমাকে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজের নেওয়া হলো। অন্যথায় আমার বাঁচার কথা ছিল না। তখন ঢাকা মেডিকেলের প্রিন্সিপাল ছিলেন নামকরা সার্জন ডাক্তার আসির উদ্দিন। আবেদিন স্যার তাঁকে বললেন, ‘ও আমার ছেলে, আপনার যা দরকার হয় করুন, তবু ওকে যেভাবে হোক বাঁচান!’ আমার চিকিৎসার জন্য অর্থায়ন থেকে শুরু করে যা যা দরকার আবেদিন স্যার ব্যবস্থা করলেন। বাড়িতে আমার বাবা-মা জানতেও পারলেন না যে আমি এখানে এত বড় একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম।
আমার মাথায় সফল অস্ত্রোপচার হলো, আমি দ্বিতীয় জীবন পেলাম। সম্ভবত দুই মাস আমি হাসপাতালে ছিলাম। অস্ত্রোপচারের তিন মাস পর যখন একটু-আধটু চলতে ফিরতে পারছি আবার আগের মতো, তখন ডাক্তার আসির উদ্দিন বললেন, ‘হামিদ, তুমি তো ভালো হয়ে গেছ, কিন্তু তোমার আরেকটু চিকিৎসা লাগবে।’ আমার মাথার কিছু অংশে স্কাল ছিল না। খুলির কিছু অংশ। সেটার জন্য পরবর্তী সময়ে বিপদ হতে পারে। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য আমাকে ইংল্যান্ডে যেতে হবে। কিন্তু ইংল্যান্ডে যাব টাকা কোথায়? আবেদিন স্যার বললেন, ‘শোনো, চট্টগ্রামে একটা ক্লাব হচ্ছে, গ্যালারি হবে, আমি উদ্বোধন করতে যাব। তুমি সেখানে ছবি ডিসপ্লে করো, আমি বলে দিচ্ছি।’
আমি ছবি দিলাম, প্রদর্শিত হলো। প্রদর্শনী শেষ হলে আমার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া হলো। কর্তৃপক্ষ বলল, ‘আবেদিন স্যার আপনার কথা বলেছেন যেহেতু, আপনার ছবি ফেরত যাবে না। আমরা আপনার ছবি কিনে নিলাম।’ বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলাম। অনেক কাল আগের কথা। তখন এক টাকায় পাঁচ পাউন্ড। আমি জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ডে চলে গেলাম, এডিনবার্গ। সেখানে আমার বাকি চিকিৎসা হলো। কত খরচ পড়েছে জানতে চাইলাম। ডাক্তাররা বললেন, ‘আমরা বোর্ড মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার কাছ থেকে আমরা কোনো টাকা নেব না। তুমি ছাত্র, তদুপরি তুমি শিল্পী। তুমি আমাদের এখানে আরও তিন মাস থাক। লন্ডনে থাকার ব্যবস্থা করছি। এর ভেতর তোমার কোনো সমস্যা হয় কিনা আমরা দেখব।’
আমি লন্ডনে থেকে গেলাম। সেই সময়টা আমার জীবনের একটা মাইলফলক। আমি ইংল্যান্ডের নামকরা সব জাদুঘরে কিংবদন্তি সব শিল্পকর্ম দেখে বেড়ালাম তিনটি মাস, যাঁদের কথা কেবল বইয়ে পড়েছি, যাঁদের আঁকা ছবিগুলো কেবল বইয়ে দেখেছি। ফেরার পথে প্যারিসে নামলাম। রশিদ চৌধুরী স্যার আমাকে গ্রহণ করলেন, সব ঘুরে দেখালেন। রোমেও নামলাম। সেখানে সাত দিন ছিলাম। সেবারের সেই ভ্রমণগুলো আমার ভেতর এনলাইটেনমেন্ট এনে দিল। সুস্থ আমি যখন দেশে ফিরে গিয়ে জয়নুল আবেদিন স্যারের সামনে দাঁড়িয়েছি, আমি আর আগের আমি নাই। আমার জীবনের এই বাঁকবদলের জন্য আমি আর কার কাছে ঋণী?
ফিরে এসে আমি আবেদিন স্যারকে বললাম, ‘স্যার, আমার মনে হচ্ছে এখন ভাস্কর্যই সবচেয়ে আধুনিক মাধ্যম।’ আমি আমার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করলাম। ‘ভাস্কর্যে অনেক ডাইমেনশনের কাজ করা যায়, বাইরে রাখা যায়।’ মনে হচ্ছিল, ভাস্কর্যে নিজেকে অনেক বেশি ব্যক্ত করতে পারব আমি। স্যার বললেন, ‘তুমি

আবদুর রাজ্জাকের কাছে যাও। আমি বলে দিচ্ছি।’ যখন যে পথে আমি আগ্রহ প্রকাশ করতাম, আবেদিন স্যারের উদার উৎসাহ আমাকে জড়িয়ে রাখত। আমি আবদুর রাজ্জাক স্যারের

সঙ্গে কাজ করতে শুরু করার কিছুকালের ভেতর ১৮০ টাকা বেতনে ভাস্কর্যের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলাম।
জয়নুল আবেদিন স্যার একটা আমেরিকান বৃত্তি নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরেছিলেন। তখন তাঁর ভেতর জানা ও বোঝার একটা বিপুল জগৎ তৈরি হয়। তিনি শিল্পের সম্পদ, সম্ভাবনা সমস্ত দেশে, মানুষে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন, সঙ্গে নিজের আঁকাজোকা চালিয়ে গেছেন। প্রায় তিন হাজার ছবি আছে তাঁর, জানতে পারি। সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে তিনি যে শ্রম ও সময় ব্যয় করেছেন, তা যদি নিজ আঁকার পেছনে ব্যয় করতে পারতেন, বিশ্বনন্দিত হতেন। বিশ্বকবির মতো সারাবিশ্বে মর্যাদা পেতে পারতেন। তাঁর মতো আঁকার হাত গোটা ভারতবর্ষে ছিল কিনা সন্দেহ। তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো বিশ্বের মাঝে দুর্লভ। কী ভয়ানক শক্তিধর সেসব ছবি! নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা যেমন, আমার কাছে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো তেমন মনে হয়। তারপর তিনি নবান্ন, মনপুরার মতো বিরাট চিত্রকর্ম দাঁড় করিয়েছেন। অত বড় ক্যানভাস কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন আজও আমার কাছে বিস্ময়। আমার সৌভাগ্য যে কিংবদন্তি কাজগুলোর নির্মাণ আমি কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি।
যদিও তাঁর শিল্পকর্ম আরও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে একটা আক্ষেপ জাগে, তবু এ-ও সত্যি, আবেদিন স্যার যদি আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা না করতেন, আমরা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম। জনসন রোডের একটামাত্র ঘর থেকে চারুকলাকে তিনি বিশ্বমানের একটা কাঠামোয় উত্তীর্ণ করে দিয়ে গেছেন। স্বল্পায়ু ছিলেন, কিন্তু কী বিপুল তাঁর কাজ! সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর করেছিলেন, আরও কত কী পরিকল্পনা যে ছিল! ফোক জিনিসের প্রতি তাঁর অফুরান আগ্রহ ছিল। একবার গুজরাট গিয়েছিলাম, সেখান থেকে তাঁর জন্য একটা কাপড়ের পুতুল নিয়ে এলাম। গুজরাটি লোকশিল্পের একটা নিদর্শন ওটা। তাঁকে দিতে এলাম যখন, আমার কাঁধে ছিল একটা গুজরাটি ব্যাগ। সেটাও ফোক নিদর্শন ছিল, সন্দেহ নাই। স্যার বললেন, ‘যাওয়ার সময় ব্যাগটাও রেখে যেও।’ এই ছিলেন স্যার। যেমন দরদি অভিভাবক, তেমনই রসিক বন্ধুপ্রতিম একজন মানুষ।  
ভারত থেকে তখন বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, আবেদিন স্যার আমাকে নির্বাচন করলেন। ভারতে আমার বেশ একটা বড় সময় কাটল এরপর। যখন আমি বরোদায় পড়াশোনার শেষ দিকে আছি, হঠাৎ একদিন একটা খবর এলো আবেদিন স্যার আর নেই। আমি বিদেশে কীভাবে সেই শোক সামলেছিলাম জানি না। আবেদিন স্যারের আশীর্বাদ নিয়ে যখন বিভুঁইয়ে পা বাড়াচ্ছি, ঘুণাক্ষরেও যদি জানতাম, সেই ছিল আমাদের শেষ দেখা!