মানুষ কেন বেঁচে থাকে? এর উত্তর আমি এখনও পাইনি, তবে বেঁচে থাকার কোনো আয়োজনে আমার কখনোই কার্পণ্য ছিল না। এই কথাও ঠিক, জীবনে মুখোমুখি হওয়া সব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার দুরাশা করা উচিত নয়। করিও না। এই চিন্তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, তবে এটাও জরুরি নয় জানা যে, জীবনের সংজ্ঞা আসলে কী? উত্তর যাই হোক নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত জীবন তো বয়ে চলে। উত্তর সেখানে অনাবশ্যক অলংকার মাত্র।
আমি মানুষটা খুব একটা ভালো নই। হ্যাঁ, মানুষ মেরে ফেলিনি, তবে ক্ষতিও কম করিনি। প্রতিটি তথাকথিত খারাপ কাজের পেছনে আমার নিজস্ব যুক্তি আছে। কেন আমি কাজটা করেছি কিংবা কেন আমি কাজটা করিনি কেউ জানতে চাইলে আমি বুঝিয়ে দিতে পারব। লেখার অভ্যাস থাকার কারণে বোঝানোর ক্ষমতা টুকটাক হলেও আছে। কিন্তু কেউ আসলে জানতে চায় না।
একটা কথা বহুল প্রচলিত আছে, মানুষ তার পাপের শাস্তি জীবদ্দশায় পেয়ে থাকে। আমি এসব গালগল্প বিশ্বাস করি না। শাস্তি তারা পায়, যারা একটু কম বুদ্ধিমান কিংবা যারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। আমি এর কোনোটাই নই। তাই হয়তো গভীর কোনো শাস্তি পেতে পেতেও আমি বেঁচে গেছি। অবশ্য যা হয়েছে সেটিকে ঠিক শাস্তিও বলা যায় না।
দোতলার এক বারান্দা থেকেই ঘটনার শুরু বললে ভুল হবে, তবে নিঃসন্দেহে দোতলার বারান্দাটা আমাকে নতুন অনুভবের সামনে দাঁড় করাতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

বৈশাখ শুরু হয়েছে, তবে ঝড় তখনও তাকে সঙ্গ দিতে শুরু করেনি। রাস্তায় বের হলে দুই মিনিটের বেশি লাগে না ঘামে শার্ট ভিজে যেতে। আমি চিরকাল খুব অলস। চেষ্টা করি তাই অফিসের কাজ ছাড়া কোথাও না যেতে। সেদিন কী হয়েছিল কে জানে, দুপুরের পরপর অফিস থেকে বের হয়ে পড়লাম। বের হয়ে যাব কোথায়? বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। অনেকদিন নাহিদের সাথে দেখা হয় না। তাই ভাবলাম ওর অফিস থেকে একটু ঢুঁ মেরে আসি। ওর অফিস শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায়। সেখানেই চলে গেলাম। অভিজাত এলাকা আভিজাত্যের আভা ধরে রেখেছে বটে কিন্তু বাণিজ্যের ছড়িও কম ঘুরছে না।
নাহিদ নিচে নেমে এলো। একটা স্মোকিং রেস্তোরায় বসে জুস আর সিগারেট টানা হলো অনেকক্ষণ। আমরা ঠিক কী নিয়ে গল্প করেছিলাম মনে নেই। এমন হয় বন্ধুদের সঙ্গে। এত অপ্রয়োজনীয় আলাপ করা হয় যে শুধু আলাপের স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই মনে থাকে না। নাহিদের কাছে বিদায় নিতে নিতে শেষ বিকেল। শেষ বিকেলের মন খারাপ করা আলো অবশ্য আমাকে কিংবা এই শহরকে ঠিক ছুঁতে পারে না। তবে বিষণ্ণ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, কিসের পেছনে ছুটছি? কেন ছুটছি? আমার দীর্ঘ একটা বিশ্রাম প্রয়োজন।
এসব ভাবনার ভেতরে কখন যে ওই দোতলার বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম টের পাই নি। বারান্দাটা বিশেষ এই কারণে, চারপাশে সব হাইরাইজ ভবনের পাশে এটিকে ছোট্ট বেণী করা কোনো শিশুর মতো মনে হচ্ছিল। বেণীর প্রশ্ন এলো কারণ, বিশাল বড় একটা গাছ বাসাটিকে ছায়া দিয়ে রেখেছে। গাছের ডালপালাকে আচমকাই ছড়িয়ে থাকা চুল বলে ভ্রম হয়। গাছের নাম কী জানতে হলে নাহিদকে ডাকতে হবে। আবার ওকে কে ডাকতে যায়? রাস্তাটা বেশ বড় নয়। মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরে। ছিমছাম ফুটপাত। কোথাও কোনো ময়লা জমে নেই। শহরের সমস্ত বাতাস যেন এখানেই এসে বিশ্রাম নিচ্ছে। মুহূর্তেই আমার ঘাম শুকিয়ে গেল।
বাসাটার নাম আয়না। আয়নার বারান্দাতেই আমি নীরাকে প্রথম দেখেছিলাম এবং মনে হয়েছিল নীরাকে আসলে যে দেখেনি কখনও সে জানতেই পারবে না সুখ আসলে কী।

দুই.
নীরার সঙ্গে আমি একই অফিসে চাকরি করব, এত কপাল নিয়ে জন্ম হয়েছে আমার? কিন্তু সত্যি তাই হয়েছে। আমি বহু নারীর সঙ্গে মিশেছি, থেকেছি, শুয়েছি কিন্তু নীরা তাদের সবার চাইতে আলাদা ছিল। ও সামনে এসে দাঁড়ালেই আমি ভীষণ শান্ত হয়ে যেতাম।
নীরার সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে আমার সময় লাগল না। সত্যি বলতে কি, এই প্রথম কাউকে দেখে এবং মিশে মনে হচ্ছিল সম্পর্কটা এগোনো যায়। সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে আমি ভীষণ পাকা। নীরার বেলাতেও সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হচ্ছিল। আমি ঠিক আমার স্বভাবজাত চার্ম কাজে লাগাতে পারছিলাম না। নীরা একটা জায়গায় দেওয়াল তুলে রাখছিল।
নীরা দশটা কথা বললে একটা কথা থাকত তার মাকে নিয়ে। সুতরাং আমার মনে হলো এই জায়গা দিয়েই আমাকে নীরার ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। শরীরে নয় শুধু, মনেও।
'তোমার মা নিশ্চয় খুব দার্শনিক, তাই না?'
কাজের ফাঁকে নীরার কাছে জানতে চাইলাম।
নীরা বলল, 'আপনি কীভাবে বুঝলেন?'
'সেদিন বললে না, মা বলেছে ট্রেন যদি ছুটে যায় তবে ট্রেনের পেছনে ছুটে যাবে কেননা পরের ট্রেনে তুমি যা চাইবে তা নাও থাকতে পারে। অন্তত চেষ্টা করবে। নিজের বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা খুব জরুরি।'
নীরা হেসে ফেলল। বলল, 'দারুণ না?'
এতটুকু আলাপের পর কথা এগোতে পারলাম না। তো বারবার এরকমই হচ্ছিল। আমি কিছু একটা তুলি আর নীরা খুশি হয়। কিন্তু খুশি হলেও পরের ধাপে আর যাওয়া হয় না। মাঝে যদিও একদিন লাঞ্চ করতে গিয়েছিলাম। সেদিনও খুব একটা গতি করতে পারিনি। এতটুকু বুঝতে পারছিলাম অবশ্য নীরা অন্তত বন্ধুর জায়গা থেকে আমাকে একটা স্থান দিয়ে রেখেছে।
একদিন সাহস করে জানতে চাইলাম, 'বিয়ের কথা ভাবছেন কিছু?'
নীরা বলল, 'ভাবি তো। আমি বিয়ে করতেই চাই। কিন্তু মায়ের কাছে যখন কাউকে নিয়ে যাই তখন আর তাকে বিয়ে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।'
আমি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। মায়ের গল্প যতটুকু শুনেছি এত জাঁদরেল হওয়ার কথা নয়, মনে মনে ভাবলাম আর মুখে বললাম, 'আপনার মাকে তো রাগী মনে হয় নি আমার।'
নীরার চোখে প্রথমবারের মতো একটু যেন অন্ধকার দেখলাম। মনে হলো, প্রথমবারের মতো ওর চোখ থেকে যে আলো বের হয় সেটা নিভে গেছে। বলল, মানুষ যে ভালো নয়। আমার মা সব বুঝতে পারেন।

তিন.
কোনো এক মলিন সন্ধ্যায় যখন শহর ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিতে, আমরা তখন আটকে আছি অফিসের চোরাগলিতে। মিন্ট মহিতো খেতে খেতে নীরাকে বলে বসলাম, 'তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাই।'
নীরা তার গ্রীবা উঁচু করল অনেকটা যেন প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো করে।
বললাম, 'এতো গল্প শুনেছি, তাই ইচ্ছে করছে।'
নীরা তখনই কিছু বলল না। চুপচাপ মিন্ট মহিতো শেষ করে বলল, 'আমার মনে হয় আপনি প্রস্তুত নন। তাছাড়া...'
'তাছাড়া?'
'তাছাড়া আপনাকে আমার ভালো মানুষ মনে হয়। আমার এই বিশ্বাসটা থাকুক।'
'আপনার এমন কেন মনে হয় মায়ের সাথে দেখা হলে এই বিশ্বাস চলে যাবে?'
'চলে যায়। আমি চাই না কিন্তু চলে যায়।'
বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। মানুষ অল্প অল্প করে রাস্তায় নামতে শুরু করেছিল। অফিসের সামনে পানি জমে না থাকলেও সামনের রাস্তাটা পুরো ডুবে গেছে, এমনটাই শুনছি। নীরাকে পাল্টা জবাব না দিয়ে নিচে নেমে রিকশা খুঁজতে শুরু করলাম। ওকে বলতে চেয়েছিলাম, ভালো-মন্দ খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। আমার ভেতরে যেমন মন্দ আছে, আপনার ভেতরেও থাকার কথা। সত্যি বলতে কী ওই মুহূর্তে নীরাকে আপন করে পাবার চাইতেও মায়ের সম্পর্কে জানার ইচ্ছা আমার প্রবল হয়ে উঠছিল। এটুকু সিদ্ধান্ত নিতে পারি, নীরা না নিলেও এই শুক্রবার আমি সত্যি সত্যি হাজির হয়ে যাব। নীরা জানে না, ওর বাসা আমি চিনি।
শুক্রবার চোখের পাতা ফেলার মতো বিরতিতে এসে হাজির হলো। এত চাপ ছিল কয়েকদিন। আর কোনো আলাপের সুযোগ হয়নি।
নীরার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে কল দিলে ও বলল, 'চলেই এসেছেন?'
'এসে দেখেই যান।'
নীরা নেমে এলো। বাইরের গেটটা খুলে যখন দাঁড়ালো ওকে অচেনা দেখালো। চুল খোলা। মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠে এসেছে। শুক্রবার সকাল। ঘুমিয়েই থাকার কথা। গেটের ভেতরে পা রাখতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ অনুভব করতে পারলাম। গন্ধটা যেন ফুসফুসের সব শাখা-প্রশাখায় নিমেষেই নিজের মহত্ত্বের কথা জানান দিল। আশপাশে পাতাবাহার ছাড়া আর কোনো গাছ নজরে এলো না। আর সেই বড় গাছটি। গন্ধ তো সেখান থেকে আসার কথা নয়। নীরা কি কোনো সেন্ট মেখেছে? হয়তো, হয়তো নয়।
'তোমাদের দারোয়ান নেই?'
'দারোয়ানের প্রয়োজন পড়ে না।'
আমি ভেবেছিলাম নিচতলায় নিয়ে যাবে নীরা। বাসার ভেতরে থাকবে ডুপ্লেক্সের সিঁড়ি। কিন্তু নীরা আমাকে সরাসরি দোতলাতেই নিল, যে দোতলার দখিনের বারান্দায় নীরাকে আমি প্রথম
দেখেছিলাম। গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মনে হচ্ছে ফুসফুস পার হয়ে একেবারে যেন স্টোমাকে সুর বাজাচ্ছে। এখান থেকেই তাহলে গন্ধটা আসছে।
বসার ঘরটা খুব সাধারণ। বহু যুগ আগের রাজসিক সোফা। ধুলো জমে আছে। টেবিলে একটা পুরোনো টিসু বক্স। বুকসেলফ শূন্য। বই তো নেই, একেবারে কিছুই নেই। দীর্ঘকাল কি এই বাড়িতে অতিথি আসেনি? খাবার টেবিলে ফলের ঝুড়িটাই যা একটু জীবন্ত। সত্যি বলতে কী, মনের একটা অংশ আমাকে থামতে বলছিল। আমি পাত্তা দিচ্ছিলাম না।
নীরার কাছে জানতে চাইলাম, 'বাড়িতে আর কেউ নেই?'
নীরা অসম্ভব শান্ত স্বরে বলল, 'ছোট ভাই বাইরে। মা আছে। মায়ের সাথে দেখা করতেই তো এসেছেন।'
'চলুন।'
এটা বলে নীরা আচমকা আমার হাত ধরে বসল। অনুভূতি বোঝার আগেই সরিয়ে নিয়ে বলল, 'আশা করি আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না।'
লোহার দরজা দেখে অবাক হলাম। ঘরের ভেতরে এমন লোহার দরজা?
নীরা দরজাটা খুলল। সাথে সাথে ভীষণ শীতল এক হাওয়া আমাকে স্পর্শ করল। নীরা কোথা থেকে যেন একটা চাদর এনে পরিয়ে দিল, নিজেও গায়ে দিল। ঘরের ভেতরে যেন বরফ উড়ছে। ঘরের সব জানালা লাগানো। লাল একটা আলো জ্বলছে।
নীরা দরজাটা লাগিয়ে দিল, শ্মশানের নীরবতা নেমে এলো। এতক্ষণ চোখে পড়েনি বিছানায় একজন মানুষ শুয়ে আছেন। নীরার মা।
আমি সালাম দিতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। টের পেলাম আমার শরীরের কোনো অংশ কাজ করছে না। কথা বলতে চাইলাম, চিৎকার দিতে চাইলাম, পারলাম না। নীরা আমার হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে গেলো।
'মা, শারিদ এসেছে।'
মায়ের চোখ খোলা। কোথাও কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই।

চার.
আমি ঠিক কীভাবে সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম আমার মনে নেই। জ্বরে পড়লাম। প্রায় পনেরো দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হলো। ছুটির দিন নীরা এসে দেখা করল। একটু হাসার চেষ্টা করল কিন্তু আমার তাকাতেও ভয় লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম হূৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হচ্ছে।
'আপনাকে বলেছিলাম দেখা করার প্রয়োজন নেই। আপনার সম্পর্কে সব জেনে গেলাম। একজন বন্ধু হারালাম। তবে আপনি কি জানেন আপনি কি হারিয়েছেন?'
আমি চুপ করেই থাকলাম।
'আপনি সুস্থ হয়ে মারুফার সাথে দেখা করবেন। মারুফাও এই হাসপাতালে ছিল। ওর বাচ্চাটা মারা গেছে।'
'মারুফা? বাচ্চা?'
'ভুলে গেছেন সম্ভবত। আপনি কি জানেন সারাজীবনে আপনি বহুবার প্রেমে পড়েছেন? প্রেম টেকে না। কিন্তু কখনো মোহে পড়েননি। মোহ টিকে যায়। যদিও এই কথাটা আমরা উল্টো করে জানি। মারুফাও আপনার তেমন একটা প্রেম ছিল। সেন্টমার্টিন। রাত। মনে পড়ে? এমন হতে পারে না, বাচ্চাটার সাথে আপনার কোনো সংযোগ ছিল?'
নীরা চলে গেল। আজ ছুটি হয়ে যাবে আমারও। কিন্তু এই জীবন নিয়ে আমি কোথায় যাব? একটা রাস্তা। দীর্ঘ। কোথাও গিয়ে শেষ হয় না। ওদিকে মৃত্যু একটা ফুল স্টপ। চাপা দিয়ে যাবে এমন একটা গাড়িরও দেখা মেলে না।