ঢাকা শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩

ক্ষুধা

চলতি পথে কয়েকজন

ক্ষুধা

শিল্পকর্ম :: আবুল বারক আলভী

হাবিব আনিসুর রহমান

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৩ | ২২:৩৬

গভীর রাতের নীরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল দরজায় কারও হাতের ঠকঠক শব্দে। আমাদের কারও ঘুম ভাঙল, কেউ ভীতসন্ত্রস্ত, বড় বাড়ি হওয়ায় কেউ হয়তো টেরই পেল না। বাবা-মা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, উঠে এলেন দরজা ধাক্কানোর শব্দে আমাদের ঘরে, ভাবছেন– কে এলো এত রাতে! এলাকায় ডাকাতি হয় হরহামেশাই। সীমান্ত এলাকা বলে ডাকাতি করে চলে যায় আরামে। কোথাও কোথাও সারা রাত গ্রাম পাহারা হয়, এসব নেই আমাদের গ্রামে। ঠকঠক শব্দ হয়েই যাচ্ছে, বেশ জোরে। মা-বাবা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখে কিছুটা আতঙ্কের ছাপ। আমরা ছোট-বড় সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। অনেকক্ষণ পর বাবা নিচু স্বরে বললেন, কে! তার পরও ঠকঠক শব্দ থামল না, কমলোও না। পুরাতন বাড়ি, সত্যি সত্যি ডাকাত পড়লে যে কোনো কিছু হতে পারে। বাবা আরেকবার জিজ্ঞাসা করলেন, কে! তার পরও কোনো গলার শব্দ ওপার থেকে ভেসে এলো না। ঐ রকম শব্দ হতেই লাগল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাবা দরজার হুড়কো তুললেন হারিকেনের আলোয়। আমরা জানি বাবা খুব সাহসী কিন্তু এই মুহূর্তে বাবার এই সাহস খুব ভালো লাগল না। 
দরজা সম্পূর্ণ খুলে দাঁড়ালেন বাবা, বাইরে মেঝেতে আবছা অন্ধকারে বসে থাকা একটা মানুষের অবয়ব। হারিকেনটা তার সামনে ধরা হলো। এতক্ষণ যে হাতে দরজায় ধাক্কা চলছিল সে হাতে মেঝে থেকে কুড়িয়ে কিছু যেন খাচ্ছে। কী খাচ্ছে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, তবে সে এক হাত দিয়ে খুঁটে খুঁটে কিছু খাচ্ছে। বাবা বললেন, কোথা থেকে এসেছ? কী চাও? সে কোনো উত্তর না দিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা আদিম হাসি দিল। মা বলল, ও মনে হয় কিছু খেতে চায়! লোকটা মায়ের কথা শুনে হাসিটা বিস্তৃত করে উদোম পেটে হাত বুলাতে লাগল। সাথে সাথে মা ছুটল খাবারের সন্ধানে রান্নাঘরের পানে। মায়ের পেছনে আমাদের কয়েকজন ছুটল, তার জন্য কী খাবার মা ব্যবস্থা করে দেখার জন্য। 
এখনও লোকটা আমাদের কাছে ভীষণ অপরিচিত এবং আজবও বটে। একটামাত্র বস্ত্র পরনে, সেটা লুঙ্গি এবং শতচ্ছিন্ন। বাম হাতটা দৃশ্যমান, যে হাতে তখনও কিছু খুঁটে খাওয়ার চেষ্টা করছে। আরেকটা হাত এতই ছোট যে ভালো করে খেয়াল করলে দেখি ঘাড়ের কাছে শুরু হয়ে এক বিঘতেই শেষ হয়েছে।
মা এলেন একটা কাঁসার থালা আর এক ঘটি পানি নিয়ে। থালায় কী আছে আমাদের কৌতূহল। থালা উঁচু করে ভাত, তার ওপরে ঘন মাষকলাইর ডাল আর বেগুন চচ্চড়ি, রাতে আমাদের সবার খাওয়া হয়েছে ঘণ্টা দুয়েক আগে। থালাটা বাবা-মায়ের হাত থেকে নিয়ে তার সামনে রাখলেন যত্ন করে। লোকটা কোনো দিকে না তাকিয়ে এমনকি ঘটির পানিতে একটু হাত ধোয়া পর্যন্ত উপেক্ষা করে গোগ্রাসে খেতে লাগল নাকি গিলতে লাগল হারিকেনের আলোয়। 
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত লতিয়ে পড়া শুষ্ক নোংরা চুল, দুটো স্বচ্ছ চোখ। বয়সটা কত হবে বলা কঠিন, তার অপরিচ্ছন্ন ত্বক, চুল হাত পা কিছুই তার প্রকৃত বয়স নির্ণয়ে সহায়ক নয়। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ– যে কোনোটাই হতে পারে। খেতে খেতে একবার তাকালে তার চোখ জোড়া দেখা গেল উৎফুল্ল। আমরা টের পেলাম হাপুস হুপুস শব্দে চারপাশটা জেগে উঠছে আর বাবা বোধ হয় ভাবছেন তার কাছ থেকে কোনো বাক্য বের করতে পারবেন এবার। খুব অল্প সময়েই তার খাওয়া হয়ে গেলে, আমরা ভাবতে চেষ্টা করি লোকটা কত দিন না খেয়ে আছে! কিংবা লোকটা কত দূর থেকে এসেছে একটু খাবারের জন্য! তার মুখ থেকে কোনো কথা আমরা শেষ পর্যন্ত শুনতে পেলাম না। খাওয়া অবস্থায় বাবাও সে চেষ্টা সামান্যই করলেন। খাওয়া শেষ হলে ঘটিতে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে মাথা নত করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। বাবা শেষবারের মতো আরেকবার তার সাকিন নিবাস জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। 
আমাদের দরজার পাশে একটা ঝোপঝাড়পূর্ণ পুকুর, পুকুরের দিকে ঝুঁকে পড়া বিশাল একটা শিমুল গাছ, সেখানে রাতের দু’একটা পাখি ডানা ঝাপটায়। পূজা গেছে অল্প কিছুদিন, বাতাসে ঠান্ডার আভাস। নানির লাগানো অদূরে কামিনী থেকে মাদকতা ছড়ানো সুগন্ধ বাতাসকে তাজা করে রেখেছে।
আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাই মিজান, সেভেনের ছাত্র সে। কোনার টেরের ঘরে পড়ছিল, দেরিতে টের পেয়ে এসে হাজির। এসেই বলে বসে, এনাকে তো আমি চিনি। আমাদের স্কুলের পাশে বড় বটগাছটার নিচে মাঝে মাঝে বসে থাকতে দেখি, ছাত্ররা তাকে হাম পাগলা বলে! ভিক্ষাটিক্ষা করে না, এমনি বসে থাকে!
বাবা বললেন, হাম পাগলা! নাম কি হামিদ! নানি বললেন, হামিদই হবে! আহারে বাছা আমার!
নানি আমাদের পরিবারের একজন, অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন একটিমাত্র দুধের সন্তান আমার মাকে নিয়ে। মেয়ে বিয়ে দিয়ে সেই থেকে তিনি আমাদের সবচেয়ে বড় অভিভাবক। আমাদের দেখভাল করা ছাড়াও তাকে পাড়াপ্রতিবেশী, অনাহারী দুঃখী কিছু মানুষেরও দায়িত্ব পালন করতে হয়। তো এই হাম পাগলার নাম হামিদ অনুমোদন দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হলেন না। তাঁর গুপ্ত তহবিল থেকে কিছু বরাদ্দ দিলেন। এই তহবিল থেকে আমরা নাতিরা খুব কমই অনুদান পাই যদিও।
লোকটা খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ মাথা নত করে বসে রইল, কৃতজ্ঞচিত্তের নিবেদন নাকি হাঁপিয়ে যাওয়ায় বিশ্রাম আমরা বুঝতে চেষ্টা করি। বস্তুত ডাকাত না হয়ে এমন একটা লোকের আগমন আমরাই বরং তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠি। শিমুল গাছে তখন কী একটা পাখি ডেকে উঠল, অন্যদিন এই দরজার ওপর তক্ষক ডাকে, আজকেও ডেকেছে সন্ধ্যার পরপর। এখন বোধ হয় লোকটাকে দেখছে কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে অধিক রাত হওয়ায়। লোকটা উঠতে উদ্যত হলে নানি বললেন, বসো একটু বাছা! বাবাও তাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। নানিও গেলেন এবং ফিরে এলেন দ্রুত। একটা পুঁটলি তার হাতে দিলেন, ধারণা করি তাতে চিড়ামুড়ি থাকবে। লোকটা পৈঠা থেকে নামতে বেশ কষ্ট পেল। লিকলিকে পা জোড়া নিয়ে অনেক কষ্টেসৃষ্টে সে নামল। আমরা এবার পৈঠায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে লাগলাম। মা বলল, ক্ষুধা লাগলে এসো মাঝে মাঝে।
আমাদের মূল সীমানা প্রায় একশ ফুট দূরে। ওখানে একটা বাঁশের ভাঙা দরজা। গরু-ছাগল ঠেকালেও মানুষ ঠেকানো যায় না। ঐ দরজা পর্যন্ত যেতে তার কতটা সময় লাগল, ঐ গাঢ় অন্ধকার রাতে সে কথা এখন আর মনে নাই।
তারপর লোকটা আসে মাসে এক-দুইবার, একই সময়। মনে হয় সন্ধ্যার পর রওনা হয়ে রাতের এক প্রহর পর এসে পৌঁছায়। দরজা ধাক্কার শব্দে আমরা বুঝতে পারি কে এলো। নানি প্রস্তুত থাকতেন পুঁটলি তৈরি করে। মায়ের কোনো প্রস্তুতি লাগে না, বড় পরিবারে হাঁড়িতে 
কিছু ভাত থাকেই। কোনো দিন তরকারি না থাকলে ভাতপাতে একটা সবরি কলা কিংবা একটা পাকা আম কিংবা তেলে টইটম্বুর দুটো লাল পাকা কুলের আচার দিয়ে বলবে, আজ এই আছে বাছা, কষ্ট করে খেয়ে নাও। সে আগের মতোই গোগ্রাসে সশব্দে খেয়ে নেবে, যথারীতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া ভাত কটা খুঁটে খাবে আমরা তা না চাইলেও। মুক্তিযুদ্ধের বছর কয়েক পর বাবা চলে গেলেন, নানিও চলে গেলেন পরপরই, তখনও হাম পাগলা আসে। অসুস্থ হয়ে মা বিছানায় থাকার সময়ও সে আসত, ভাবিরা মায়ের দায়িত্ব পালন করেছে। হাম পাগলাকে  আমরা কবে থেকে দেখতে পেলাম না, জানি না। তার প্রস্থান নিয়ে তেমন কোনো সংবাদ আমাদের কাছে না এলেও আমরা তার না আসা মেনে নিই। ততদিনে পুরাতন বাড়ির স্থানে নতুন দোতলা উঠেছে, তক্ষক যে কখন আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে টেরই পাইনি। 

আরও পড়ুন