নিউইয়র্কের রাস্তায়

.
রিজওয়ানুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৩ | ২২:৩১
স্ট্রিট ফুড আর স্ট্রিট মার্কেট যে কোনো শহরকে দিতে পারে কিছু বৈচিত্র্য। নিউইয়র্ক এর ব্যতিক্রম নয়। বাদাম-চিপস, বেগল-বার্গার থেকে শুরু করে কাবাব-ফালাফাল, জাপানি, মেক্সিকান, চাইনিজ কী নেই! এসব খাবার মূলত বিক্রি হয় এক ধরনের গাড়ি থেকে, স্থানীয় ভাষায় যা ‘ফুড কার্ট’। আর শহরের– বিশেষ করে ম্যানহাটানের প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় ফুড কার্ট। তৈরি খাবার ছাড়াও রয়েছে সবজি, ফল, পানীয়, খবরের কাগজ-ম্যাগাজিন, ছোটখাটো স্ন্যাকস, ইত্যাদি। এসব দোকানে বিক্রির কাজ যারা করে তারা প্রায় সবাই অভিবাসী মানুষ।
আমি নিউইয়র্ক গেলে এ ধরনের দোকান থেকে মাঝে মাঝে জিনিসপত্র কিনি। কিনতে কিনতে ওদের সাথে একটু আলাপ করি। আলাপে আলাপে ওদের জীবনের অনেক কথা জানা যায়। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ অবশ্য এসব দোকানের খাবারের মান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে। কী ধরনের মুরগির মাংস ব্যবহার করে, ডিমগুলো কী বদ্ধ জায়গার ফার্মে নাকি ‘ফ্রি রেঞ্জ’ (খোলা জায়গায় চরে বড় হওয়া) এসব অনেকেরই ভাবনার বিষয়। মুরগির, এগুলো তাদের প্রশ্ন। আমি অল্প দিনের জন্য সেখানে যাই বলে এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাই না।
কভিড মহামারির সময় ফুড কার্টগুলোর ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কর্মজীবী মানুষ তাদের প্রধান ক্রেতা, আর ঘরে বসে কাজ করা হয়ে গিয়েছিল রীতি। জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হয়ে আসার পরও দেখা গেল যে প্রতিদিন অফিসে গিয়ে কাজ করার রেওয়াজ আর ফেরেনি। বেশির ভাগ অফিসেই লোকজন সপ্তাহে কয়েক দিন আসে। ফলে রাস্তার খাবারের দোকানের ক্রেতা বেশ কিছুটা কমে গেছে। কম দামে খাবার চাইলে যেতে হবে তাদের কাছে। যদিও মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের খাবারের দামও বাড়াতে হয়েছে, এখনও তাদের কাছে সাত-আট ডলারে কাবাব আর রুটি পাওয়া যায়।
আমার বড় ছেলে সুজয়ের বাসা থেকে এক মিনিট হেঁটে গেলে লিঙ্কন স্কয়ার; সেখানে অনেক দিন থেকে দেখি কাবাবের দোকান ‘কাসবা’ (যার কথা আগে অন্যত্র লিখেছি)। আরও কাছে একটি ছোট কার্টে কফি আর নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসে এক ইজিপশিয়ান তরুণ। ওর কাছে রোলের ভেতর ডিম এবং চিজ দিয়ে গরম খাবার পাওয়া যায়। দাম চার ডলার থেকে শুরু। খেতে বেশ ভালো। তার দোকানের গায়ে নিউইয়র্ক নগর প্রশাসন থেকে পাওয়া পরিচ্ছন্নতার ‘এ গ্রেড’ সার্টিফিকেট লাগানো আছে। কয়েক দিন বাদ দিয়ে এক দিন যেতেই সে আমাকে একটি সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে বলল, “অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে।” এক বন্ধু যেমন বলে আরেক বন্ধুকে।
লিঙ্কন স্কয়ার আমার প্রিয় একটি জায়গা। সেখানে ব্রডওয়ে আর কলাম্বাস অ্যাভিনিউর মাঝখানে এক চত্বরে নগর কর্তৃপক্ষের চেয়ার-টেবিল পাতা। যে কেউ বসতে পারে। চত্বরের এক পাশে কার্টে পাওয়া যায় কলম্বিয়ার কফি, ক্রোয়াসঁ, ইত্যাদি। আমার খুব পছন্দ সেই কফি। সপ্তাহে দু’দিন সেখানে বসে খোলা বাজার– ফারমার্স মার্কেট। শাকসবজি বিক্রি করে দুটি দোকান। একটি বেকারি, যাতে পাওয়া যায় নানা ধরনের রুটি, কেক, স্কোন, ইত্যাদি। অক্টোবরের শুরুতে একটি সুন্দর দিন পেলাম। রোদে ঝলমল। সেই বেকারি থেকে কিনলাম গীতশ্রীর প্রিয় খাবার স্কোন, আর কফির কার্ট থেকে কফি। দুজনে বসে গেলাম একটি টেবিল-চেয়ার নিয়ে। চলমান জীবন দেখতে দেখতে ভালো কাটল বেশ খানিকটা সময়।
বাড়ির কাছেই এক সবজি আর ফলের দোকান। সুদর্শন এক যুবক সেখানে বিক্রেতা। একদিন সে তার ফোন থেকে শুনছিল আরবি গান। আমি আন্দাজ করলাম মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকার মানুষ হবে সে। জিজ্ঞেস করতে বলল, সে তিউনিসিয়ার। অন্যদিকে লিঙ্কন স্কয়ারের উল্টোদিকে এক সবজির দোকানে প্রায় সব সময় দেখা যায় একজন বাঙালিকে। মাঝবয়সী। আলাপে জানলাম, মেয়ের সাথে থাকেন তিনি। জীবিকার জন্য তাঁর কাজ করতে হয় না। কিন্তু তবু শনি-রোববার কিছুটা কাজ করেন– নিজের পকেটমানি হয়ে যায় তাতে। সপ্তাহের অন্যান্য দিনে নাতি-নাতনিদের স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজে সাহায্য করেন। বাংলাদেশে রেলে চাকরি করতেন। তাঁর সাথে কথা বলে আসতে আসতে ভাবছিলাম, বাংলাদেশে থাকলে তিনি হয়তো রিটায়ার করে এ রকমই একটি জীবন কাটাতেন। এখানে কি তিনি তার চাইতে ভালো বা বেশি আনন্দে আছেন?
কোনো কোনো সপ্তাহান্তে– বিশেষ করে রোববারে বিভিন্ন রাস্তার একটু একটু অংশ বন্ধ করে দিয়ে জায়গা করা হয় ছোট ছোট দোকানের। সেখানে পুরোনো বই থেকে শুরু করে অনেক ধরনের দোকান বসে যায়। মাঝখানে অনেকটা জায়গা খালি রাখা হয়ে মানুষের হাঁটাচলার জন্য। পুরো রাস্তাই সেদিন পথচারীদের দখলে। সুজয়ের বাসা থেকে বের হলেই কলাম্বাস অ্যাভিনিউ। সেখানেই একদিন দেখলাম এই ব্যবস্থা। আরেক দিন দেখলাম কোনো দোকান নয়, টেবিল-চেয়ার পাতা। পাড়ার লোকেরা পিকনিক করছে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। সব মিলিয়ে একটা আনন্দের পরিবেশ।
কোনো কোনো রাস্তায় সপ্তাহান্তে বসে যায় ছবির হাট। ইউনিয়ন স্কয়ারের সামনের চত্বরে রোববারে বেশ কয়েকটি স্টলে শিল্পীরা নিজেরাই তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে বসে যান। একদিন তেমনই একটি হাটে দেখতে পেলাম একজন আফ্রিকান-আমেরিকান এঁকে এনেছেন উজ্জ্বল রঙে আঁকা কিছু ছবি। তাদের মধ্যে মানুষের মুখ বা দেহের অংশবিশেষ যেমন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন প্রাণীর ছবিও। কয়েক বছর আগে হারলেমের স্টুডিও মিউজিয়ামে দেখা আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীদের শিল্পকর্মের চাইতে এগুলো বেশ আলাদা। এক নারী নিয়ে এসেছেন গতানুগতিক ধারার বেশ কিছু ছবি– ক্যানভাসে তেল-রং। তিনি নিউইয়র্কের এক মিউজিয়ামে কাজ করেন। বললেন, ছবি দেখতে দেখতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন ছবি আঁকার ব্যাপারে। তাঁর বেশির ভাগ ছবিই ম্যানহাটানের বিভিন্ন জায়গার দৃশ্য। একটিতে সেন্ট্রাল পার্কের বিখ্যাত বো (ধনুকাকৃতি) ব্রিজ আর তার আশেপাশের গাছপালার শরতের রং। খুবই পছন্দ হয়েছিল ছবিটি; কিন্তু সামর্থ্যের বাইরে বলে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।
নিউইয়র্ক, লন্ডন এসব শহরের রাস্তায় অথবা পাতালরেলের করিডোরে গিটার বা সে রকম কিছু একটা বাজিয়ে গান করার দৃশ্য বেশ দেখা যায়। কিন্তু নিউইয়র্কে স্ট্রিট মিউজিকের পরিসীমা অনেক বড়। বড় পার্কগুলোতে শুধু একক শিল্পী নয়, অনেক সময় দেখা যায় বেশ বড়সড় একটি দল গান করছে। বিশেষ করে সেন্ট্রাল পার্কে এ ধরনের অনুষ্ঠান মাঝে মাঝেই দেখা যায়। এবারেও এক বিকেলে বেথেসডা টেরেসের কাছে দেখলাম রীতিমতো এক ব্যান্ড দলের অনুষ্ঠান। আর তাদের সামনে লোকেরা যেভাবে পেরেছে সেভাবেই বসে গিয়েছে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে। কেউ নিজের ভাঁজ করা চেয়ার পেতে নিয়েছেন, কেউ কেউ একটা নিচু রেলিং পেয়ে সেখানেই অথবা ঘাসে বসেছেন। আমি দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ উপভোগ করলাম সেই ‘অনুষ্ঠান’। কেউ কেউ শিল্পীদের সামনে রাখা যন্ত্রের ডালায় কিছু ডলারের নোট রেখে যাচ্ছেন।
পশ্চিম হারলেমে মেয়ের বাসায় ছিলাম এক রোববারে। ও জানাল যে নদীর পাড়ে এক পার্কে জ্যাজ মিউজিকের ব্যান্ড আসবে বাজাতে। ওর বাসা থেকে একটু পশ্চিমে গেলে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। তার পশ্চিমে সেই পার্ক– একেবার নদীর পাড়ে। অক্টোবরের মাঝামাঝি হলেও রোদেলা ছিল দিনটি। আমরা ইউনিভার্সিটির কাছে লাঞ্চ খেয়ে গেলাম গান শুনতে। ছোট্ট একটি তাঁবু বানিয়ে চারজন শিল্পীর দল গান করল। দলনেতা যখন নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন তখন জানা গেল যে তারা ম্যানহাটান স্কুল অব মিউজিকে গান শিখছেন। সুতরাং তাদের গানকে স্ট্রিট মিউজিকের পর্যায়ে ফেলা ঠিক হবে না। বেশ উপভোগ্য ছিল অনুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানের শেষে একটু নতুন ধরনের এক অভিজ্ঞতা হলো। দর্শকদের জন্য শিল্পীদের তাঁবুর সামনে বেশ কিছু চেয়ার পাতা ছিল। বুঝতে পারলাম সেখানকার স্থানীয় লোকদের এই আয়োজন। অনুষ্ঠান শেষে দর্শক-শ্রোতাকে অনুরোধ করা হলো আমরা যেন চেয়ারগুলো ভাঁজ করে পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে যাই। নারী-পুরুষ বয়স নির্বিশেষে সবাই অনুরোধমতো চেয়ারগুলো রেখে এলাম। ফলে দু-তিন মিনিটেই পুরো কাজটা সুন্দরভাবে হয়ে গেল।