বাংলাদেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। তিনি এ ধরনের অভিযোগের পক্ষপাতহীন, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। চার দিনের সফরে এসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন মিশেল ব্যাচেলেট। তাঁর পর্যবেক্ষণের বিষয় নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন মন্ত্রীসহ দেশের বিশিষ্টজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ রনি ও তাসনিম মহসিন

সমকাল :গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে সরকারকে স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। তাঁর পরামর্শকে কীভাবে দেখছেন?
ড. মিজানুর রহমান :মিশেল ব্যাচেলেট যেহেতু মানবাধিকার হাইকমিশনার, তাঁর সুপারিশ দেওয়ার এখতিয়ার আছে।

বাংলাদেশ সরকারকে এটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে, এমনটি নয়। সরকার প্রয়োজন মনে করলে সিদ্ধান্ত নেবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের স্বাধীন তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন আছে কিনা। আমি বলব নেই। কারণ, আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রয়েছে, সেটিই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। এই কমিশন নিয়ে কথা বলা যেতে পারে, যেটা নানাভাবে 'নখ ও দন্তহীন' করে রাখা হয়েছে। এই কমিশনকে যদি শক্তিশালী করা যায়, তাহলে আর কোনো সংস্থারই প্রয়োজন পড়ে না। এই কমিশনকে প্রতিটি ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার দিতে হবে।

সমকাল :সুপারিশগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন কিনা?

ড. মিজানুর রহমান :যদি কোনো দেশ এ ধরনের সুপারিশ দিত তাহলে অবশ্যই সেটাকে হস্তক্ষেপ বলা যেত। সুপারিশগুলো জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের। তাই এটাকে অযাচিত হস্তক্ষেপ বলা যাবে না। তবে এখানেও কিছু প্রশ্ন এসে যায়, হঠাৎ করে কেন তিনি এ ধরনের সুপারিশ করলেন এবং কখন করলেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর পরও জাতিসংঘের হাইকমিশনার এটাকেই ইস্যু বানিয়েছেন। অথচ তিনি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জোরালো কোনো বক্তব্য দেননি। হাইকমিশনার বলেছেন, তাদের যেন ফেরত পাঠানো না হয়। তাহলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের আবার বাংলাদেশে পাঠাবে। এটি তো স্পষ্টতই মিয়ানমারকে প্রশ্রয় দেওয়া। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে না? বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সমস্যার সামাধান চাচ্ছে, তখন সেটাকে জোর না দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন- এটা বললে অত্যুক্তি হবে না।

সমকাল :স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের বিষয়ে সরকার আগ্রহী না হলে জাতিসংঘের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্কে প্রভাব পড়বে কিনা?

ড. মিজানুর রহমান :প্রশ্নই ওঠে না। সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার বাধ্য নয়, এটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাইরে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আর জাতিসংঘ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এটিও একটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুনের মধ্যে চলে। সেখানে এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না করলে সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে- এমন কিছু নেই। তাছাড়া তারা যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো আমরা মানবাধিকারকর্মীরাও দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছি।
সমকাল :বহির্বিশ্বে আর কোনো দেশে জাতিসংঘের পরামর্শ অনুযায়ী এমন স্বাধীন তদন্ত সংস্থা হয়েছে কিনা, যদি হয়ে থাকে সেটার ভূমিকা কতটুকু?

ড. মিজানুর রহমান :এমন তদন্ত সংস্থা গঠনের নজির কোথাও নেই। বিষয়টি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতিসংঘের মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগের ঘটনা যেটা হয়েছে, সেটি ১৯৯০ সালে ইরাকের ওপর। সেটিও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী। তবে এখন জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার বাংলাদেশকে যে সুপারিশ করেছেন, সেটি তিনি প্রয়োজন মনে করলে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউপিআরে (ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ) পাঠাতে পারেন। ইউপিআর প্রয়োজন মনে করলে সভায় উপস্থাপন করতে পারে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ দিতে পারে। বাংলাদেশ সরকার তখন সুপারিশগুলোর বিষয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরবে। এর পরও যদি বৈঠকে সুপারিশগুলো বহাল থাকে, তাহলে পরবর্তী সভাগুলোতে অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হবে, যেটা জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সব দেশের জন্য প্রযোজ্য।

সমকাল :গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আবারও র‌্যাবকে দায়ী করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে তাদের দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী?
ড. মিজানুর রহমান :দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। রাষ্ট্র কখনও এসব ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন। আর গুমের মতো ঘটনা সব যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে, তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য বা সরকারকে বিব্রত করতেও কেউ কেউ নিজেকে লুকিয়ে রাখেন বা দেশে-বিদেশে আড়ালে চলে যান। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অনেক বিষয়ও জড়িয়ে থাকে। তাই সুষ্ঠু তদন্তই পারে এসব ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করতে। আর র‌্যাবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করে আসছে, তা নতুন নয়। আমাদের এখানকার মানবাধিকারকর্মীরাও দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযোগ করে আসছেন। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেবে- এটা মেনে নেওয়া যায় না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ আনা যায়। মূলত যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ইস্যুটিকে বাংলাদেশ এবং কিছু দুর্বল দেশের ওপরই প্রয়োগ করে আসছে। মানবাধিকার বিষয়টি হলো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার। আমাদের এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করাই বাঞ্ছনীয়।
সমকাল :স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠন করা হলে সেটার রূপরেখা কী হতে পারে?

ড. মিজানুর রহমান :নতুন কোনো কমিশন বা সংস্থার প্রয়োজন নেই। আমাদের যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আছে, সেটাকেই আরও শক্তিশালী করা যায়। নতুন কিছু করা হলে সেটা হবে অবসরপ্রাপ্ত কিছু ব্যক্তির আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করা। তাই নতুন কিছু না করে মানবাধিকার রক্ষার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের ইতিবাচক ধারায় শক্তিশালী করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন যাঁরা আছেন, তাঁরা যাতে আরাম-আয়েশে দিন পার করে দায়িত্ব শেষ না করেন, তা নিশ্চিত করলেই মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি অনেকাংশে নিশ্চিত করা যাবে।